।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় পিনাক বিশ্বাস

মান্টোর শেষ দিনটি

উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম উর্দু সাহিত্যিক (উর্দু ভাষায় জীবনে পাশ করতে পারেননি) মারা যান ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। সিরোসিস অফ লিভারে শরীর খেয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর পাঁচমাস আগে এপিটাফ লিখে গিয়েছেন, যে গল্পকারকে হজম করার সাহস ছিলনা পাকিস্তান সরকারের।
কৃষান চন্দর সঠিকভাবেই বলেছেন,
‘আপনি মান্টোর সাথে আড্ডায় যদি জিন্নাহ বা গান্ধির প্রশংসা করেন তাহলে সে পাড়ার মুচির ব্যক্তিত্বের মহিমা গাইবে’।
একের পর এক মামলায় বিপর্যস্ত, বিদ্রুপ, অপমান, অর্থকষ্টে দিশেহারা হয়েছেন তিনি। শেষ কটা দিন মদ্যপান এতই অস্বাভাবিক বেড়ে যায় যে তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় একরকম জোর করে। সেখানে থাকতে চাইতেননা। ডাক্তাররা তাঁকে ছুটি দিয়ে দেন।
বাড়ি এসে যথারীতি মদ্যপান।
একদিন রক্তবমি হয়। ভাগ্নের ছ বছরের ছেলে সেটা দেখে ফেললে তিনি বলেন “না, ওগুলো পানের পিকের দাগ, বাছা তুমি কাউকে কিছু বলোনা”
পুঁচকে ছেলেটা তাঁর কথা রেখেছিল, কাউকেই বলেনি। ফলে কেউ জানতে পারেনি মান্টোর শরীর কতখানি ক্ষয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে।
১৮ তারিখ ভোরবেলায় স্ত্রী শাফিয়াকে ডেকে বলেন “মনে হয় লিভার ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, অনেকটা রক্তক্ষরণ হয়েছে”।
ডাক্তার এলেন। ইঞ্জেকশন যখন দিলেন, ভাবেননি লোকটির আয়ু আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।
চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া গেলোনা, হাসপাতালে পাঠাবার কথায় তার প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো ‘আমাকে আর নড়াচড়া কোরোনা, এই কলঙ্কিত জীবনের এখানেই শেষ হোক, কেউ কাঁদুক আমি তাও চাইনা’
অ্যাম্বুলেন্স আসার আগে শুধু বললেন ‘খুব ঠান্ডা লাগছে, কবরে যতটা ঠান্ডা লাগবে তার চেয়েও বেশি, আরো কয়েকটা লেপ নিয়ে এসো’।
তারপর একটু থেমে…. ‘আমার পকেটে তিন টাকা আট আনা আছে, আর কিছু বেশি টাকা কাউকে দাও, কিছুটা হুইস্কি এনে দিক’
এত জোরাজুরি যে তাকে শান্ত করার জন্যে সত্যিই বোতল আনা হলো,
বললেন -এক পেগের মত আমাকে দাও।
তাঁর মুখে এক চামচ পানীয় দেওয়া হলো, কিন্তু গিলতে পারলেননা, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো পানীয়! জ্ঞান হারালেন মান্টো।
প্রথমবার এবং শেষবার।
হাসপাতালে পৌঁছালে ডাক্তাররা জানান এম্বুলেন্সের ভেতরেই মৃত্যু ঘটেছে সাদাত হোসেন মান্টোর!
বন্ধুহীন, অভিমানী মান্টো মারা গেলেন। কথাকার মান্টো মরেও বেঁচে রইলেন।
দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতার যন্ত্রণা, ছিন্নমূল জনতার হাহাকার শুধু নয় নিপুণ দরদে সমাজের নিচুতলার মানুষ, ফুটপাতের ভিখিরি, ড্রাইভার, ধোপা, দালাল, বেশ্যা ও শ্রমিকের জীবনযন্ত্রনা এঁকেছেন, লিখেছেন ওপরতলার গ্লানি, পাপ, ভন্ডামী ও রিরংসার মিশ্র জীবনকাহিনী।
১৯৫০ সালে স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপে লেখেন ‘এক দিন হয়তো পাকিস্তান আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।’ হয়েছিলও তাই।
তাঁকে মরনোত্তর ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল সেদেশের সরকার। যিনি তাঁর ‘এপিটাফ’-এ লিখে গিয়েছিলেন, ‘এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই ছোটগল্পকার, যে ভাবছে, কে বড় লেখক? খোদা, নাকি সে নিজে?’
অবশ্য মৌলবাদীদের উৎপাতের ভয়ে মান্টোর পরিবার তাঁর সমাধিতে এটা খোদাই করার সাহস পায়নি।
পরিশিষ্ট:
মৃত্যুর আগের দিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে দুটি অন্তিম ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তিনিঃ
১) হানিফ মহম্মদের ধীরস্থির ও সতর্ক ব্যাটসম্যানের টেস্ট ম্যাচ দেখার।
২) এক নিসঙ্গ অল্পবয়সী তরুনীর মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে কিছু লেখার। এই মেয়েটির নগ্ন মৃত শরীর গুজরাটের রাস্তায় পাওয়া গিয়েছিল। সংবাদপত্র অনুসারে মেয়েটি ও তার ছোট্ট শিশুকন্যা ঠান্ডায় মারা যায়। বাস টার্মিনালের ওয়েটিং রুম থেকে কিডন্যাপ করে প্রায় আধডজন মানুষ অমানবিক অত্যাচার চালায় তাদের ওপর। সেই হিমশীতল রাতে মেয়েটি কোনো রকমে পালিয়ে এলেও গায়ে একটুকরো কাপড় পর্যন্ত ছিলোনা। এই ভয়াবহ সংবাদ মান্টোকে বিচলিত করে। গুজরাটের কিছু মানুষের সাথে দেখা হলে এদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইতেন তিনি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।