বাস কন্ডাক্টরের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল অরিন্দমের। সিটে বসে কখন যে তার চোখ এঁটে এসেছিল জানে না। শহর ছাড়িয়ে শেষপর্যন্ত কাজ করতে এই গ্রামে আসতে হবে সে আগে কখনো ভাবে নি। কর্মসূত্রে ছেলেমেয়েরা শহরে যায়, দেশ বিদেশে যায়। সরকারি চাকরি হলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু সামান্য একটা কাজের জন্য অরিন্দম গ্রামে এল ! এইসব সাত- পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিষণ্ণ ক্লান্তিতে আর মুক্ত পরিবেশের ঠান্ডা হাওয়ায় কখন যেন তার ঘুম এসেছিল। ভাগ্যিস কন্ডাক্টর ছেলেটিকে সে আগে থেকে বলে রেখেছিল, “ভাই, ডাক্তারবাবুর ঢাল এলে আমাকে বোলো। আমি এদিকে আগে আসি নি তো, চিনি না।” তার চেহারায়, কথাবার্তায় শহরের ছাপ দেখে অল্প বয়সি ছেলেটি সমীহ করে বলেছিল, “দাদা আপনি টেনশন লিবেন না,আমি বলে দিবো। এখন অনেকটাই দেরী আছে।”
গ্রাম সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই খুব একটা আগ্রহ ছিল না অরিন্দমের। তবে গ্রামের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তার মায়ের বাপের বাড়ি ছিল গ্রামে। ছোটবেলায় কয়েকবার সে দুর্গাপুজো, বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন এসব উপলক্ষে মায়ের সঙ্গে গ্রামে এসেছে। তখন দাদু দিদা বেঁচে ছিল। অরিন্দমকে তাঁরা খুব ভালোবাসতেন। অরিন্দমের বাবা বিশেষ কোনো কারণে খুব বেশি শ্বশুরবাড়িতে আসতেন না। তিনি গ্রামে আসতে পছন্দ করতেন না , নাকি শ্বশুরবাড়িতে আসা পছন্দ করতেন না তা বুঝতে পারত না অরিন্দম। শান্ত স্বভাবের মা এ বিষয়ে একটু চুপচাপ থাকত।কলকাতায় নিজস্ব বাসস্থান করতে পারেন নি অরিন্দমের বাবা, পৈত্রিক ভিটেমাটি তাঁর ছিল ফরিদপুরে। হঠাৎ ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং মাত্র এক মাসের মধ্যেই মারা যান অরিন্দমের বাবা। সামান্য প্রাইভেট চাকরি করা বাবার জমানো পুঁজি বেশি ছিল না। অরিন্দম সদ্য বি.কম পরীক্ষা দিয়েছে তখন। তার মা ঠিক করলো আর কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থেকে লাভ নেই। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে গ্রামের বাড়িটা আর সামান্য কিছু জমি অরিন্দমের মা পেয়েছিল। শহরে সেই সময় রোজগারের চেষ্টা করলেও কিছু দিন তো অপেক্ষা করতেই হতো। কী ভেবে এই সময় ফার্মেসির একটা ডিপ্লোমা কোর্স করেছিল সে। সেই সুবাদে এই চাকরিটা সে পেয়েছে।
ডাক্তারবাবুর ঢালে নেমে অরিন্দম চারপাশে তাকালো। কোথাও কোনো ঘরবাড়ির চিহ্ন নেই। চারদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের খেত।সর্ষে, ছোলা এসবের চাষ জমির মাঝখানে এয়োতি চুলের সিঁথির মত একটা সরু মোরামের রাস্তা গ্রামের দিকে নেমে গেছে। এখন শীতের হালকা আমেজ। বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। এই পথেই যেতে হবে ঝিঙেপোতা গ্রাম। পাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রাম দেখা যায় না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। ত্রিসীমানায় কোনো লোকজন নেই অনেক দূরে দু- একটা গরু চড়ছে দেখতে পেল । একজন মাঝবয়সী বেশ সুশ্রী চেহারার ভদ্রলোককে হঠাৎ সেই পথে স্কুটি চালিয়ে আসতে দেখে সে অবাক হলেও নিশ্চিন্ত হল এই ভেবে যে গ্রামে ভালো লোকজনও বসবাস করে। তাঁকে থামিয়ে অরিন্দম ‘কমলা ফার্মেসি’ কতদূর জানতে চাইলে ভদ্রলোক বললেন, “সেটি তো এখান থেকে একটু দূরে ,বাজারে। ঐ দূরে দেখা যাচ্ছে ঝিঙেপোতা গ্রাম। সেখানে ওষুধের দোকানের মালিকের বাড়ি।” অরিন্দম কমলা ফার্মেসির মালিকের মোবাইলে একটা ফোন করতেই এতক্ষণে সেটা রিং হলো।অনেকসময় ধরে চেষ্টা করছিল সে, নেটওয়ার্কই ছিল না। হঠাৎ করে নেটওয়ার্ক চলে আসায় লাইনটা পেল সে ।মালিক সুপ্রিয় সামন্ত মোরাম রাস্তাটি ধরে অরিন্দমকে গ্রামে চলে আসতে বললেন। এখানেই প্রতিদিন তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে একথা চাকরির ফাইনাল কথার সময় সুপ্রিম বাবু বলেছিলেন। ভদ্রলোকটিকে নমস্কার জানিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল। কী মনে করে চলে যাওয়া লোকটি অরিন্দমকে ডাকলেন। বললেন, “তুমি যদি একটু অপেক্ষা করতে পারো তা হলে আমি এই পথেই ফিরবো,তোমাকে পৌঁছে দেব। আমিও এই গ্রামে থাকি।” অরিন্দম বলল,” ঠিক আছে আপনি কাজ সেরে আসুন, আমি ততক্ষণে হাঁটতে শুরু করি। আপনার ফেরার পথে দেখা হলে স্কুটিতে তুলে নেবেন।” ভদ্রলোক চলে গেলেন। অরিন্দম হাঁটা শুরু করল। একটাই রাস্তা, মন্দ লাগছিল না তার। ভাগ্য কাকে কোথায় কখন নিয়ে ফেলে এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে।
হেমন্তের শেষ বিকেলের রোদ দূরে দূরে মাঠের কুয়াশায় তখন মিলিয়ে যাচ্ছিল। খুব বেশি পথ যায় নি সে হঠাৎ পিছনে গাড়ির শব্দে তাকাতেই দেখল সেই লোকটি আসছেন। কাছে এসে বললেন, “গাড়িতে বসো। আমার কাজ শেষ।” অপরিচিত মানুষের সঙ্গে অরিন্দম সেভাবে মিশতে পারে না , কিন্তু এই বৃদ্ধ মানুষটিকে তার ভালো লাগল। আর কোনো কথা বললেন না তিনি। গ্রামে ঢুকে সোজা কমলা ফার্মেসির মালিকের বাড়ির সামনে নামিয়ে তিনি চলে গেলেন। অরিন্দমকে ধন্যবাদ জানানোর অবসরটুকুও তিনি দিলেন না। যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই মুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন। আর তখন বেলা প্রায় পড়ে এসেছিল । সঙ্কোচের সাথে বাড়ির দরজা পেরিয়ে উঠোনে এসে হাজির হল অরিন্দম। সুপ্রিয় বাবু মাটির দাওয়ায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। মাথায় ছোট ছোট চুল। সুশ্রী চেহারা। অরিন্দমকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। দেখে বোঝা গেল অবস্থাপন্ন গৃহস্থ পরিবার। প্রথমেই তিনি অরিন্দমকে মুখ হাত ধুয়ে নিতে বললেন। তারপর সব কথা হবে চা খেতে খেতে। অরিন্দমকে দেখে তিনি খুব খুশি হয়েছেন বোঝা যাচ্ছিল। পাম্পের জলের কল আছে উঠোনে। সেখানে হাত পা ধোয়ার সময় অরিন্দমের চোখে পড়ল একটা হালকা নীল রঙের স্কুটি রাখা আছে। অরিন্দম বেশ কয়েকবার সেদিকে তাকালো। সুপ্রিয় বাবু বললেন, ” এটা বাবার। তিনিই চালাতেন স্কুটিটা। গত মাসে বাবার মৃত্যুর পরে আমার পক্ষে একা দোকান চালানো সম্ভব হচ্ছে না বলে একজন ফার্মেসি জানা লোকের দরকার পড়লো। বাজারের মধ্যে খুব চালু দোকান। তুমিই বলছি তোমাকে। তুমি আসাতে খুব ভালো লাগছে। আরো দুজন ছেলে আছে দোকানে। মাইনে পত্র নিয়ে ভেবো না। কিছু বেশিই দেবো তোমাকে।” অরিন্দমের কানে এসব কথা ঠিক মত পৌঁচ্ছালো কিনা তখন কে জানে ! বারান্দায় টাঙানো বাঁধানো ছবিটার দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।