• Uncategorized
  • 0

গদ্যানুশীলনে পায়েল চ্যাটার্জী

কর্মক্ষেত্র- আকাশবানী কলকাতা শখ- লেখালিখি, বইপড়া, গীটার বাজানো, ছবি তোলা।

স্বপ্নের ফেরিওয়ালিরা

মুম্বাইয়ের শাহিদা। বয়স ছাব্বিশ বছর। শহর থেকে দূরে একটা ছোট্ট বস্তিতে থাকে। স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। কেমন যেন ঘিনঘিনে। ছায়া মাখানো। গলিঘুঁজি দিয়ে আলোরা ফিরে যায় অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে। পরিবারের মানুষগুলোর মুখে লেগে থাকে অন্ধকার। জীবনযুদ্ধের ছাপ।
২০১৮ সাল। কেরালার এক ক্লিনিকে শাহিদা এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে ওই দালাল। আর শাহিদার নিজের ক্ষত-বিক্ষত মন। ‌ ক্লিনিকের দেওয়ালেই থুক করে পানের পিক ফেলল দালাল ছেলেটা। শাহিদার ইচ্ছে করেনি ছেলেটার নাম জানতে। ক্লিনিকে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে ঢুকলো! কিসের গন্ধ? লড়াইয়ের পরে হেরে গেলে এক বিস্বাদ পৃথিবী অপেক্ষা করে থাকে শাহিদাদের জন্য। সেই তেতো গন্ধ!সব পেরিয়ে ও পৌঁছে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। এই চেম্বার পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার বিনিময়ে ওর পরিবারের মানুষজন দুধে-ভাতে থাকার আশ্বাসটুকু পাবে। আর এই মোক্ষম সুযোগ ওকে এনে দিয়েছে ওর ডিম্বাণু। শাহিদার মত এরকম অনেক ‘মেয়েমানুষ’রাই তাদের ডিম্বাণু বেচে জীবন যুদ্ধ চালাচ্ছে।
ওভাম ডোনেশন বা ডিম্বাণু দান বিষয়টা আইন স্বীকৃত। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে রীতিমতো এগ সেল ডোনার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এটা পরিচালনা করা হয়। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে ডিম্বাণু দান এবং সংরক্ষণ করা হয়। এমনকি সেখানে দৈহিক ও মানসিক শ্রমের বিনিময়ে পারিশ্রমিকও মেলে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলোতে চিত্রটা এরকম নয়। অর্থের অভাবে ,পরিবারের মানুষজনের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে ,কখনো বা কাছের মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করতে তারা পা বাড়াচ্ছে ডিম্বাণু বেচার মতো অসহায়তার দিকে।
ডিম্বাণু-দাত্রীদের পোশাকি নাম ‘নিকি ডোনার’।
কেরিয়ার, উচ্চাকাঙ্খা,ইচ্ছে-অনিচ্ছের জটিলতা , সব মিলিয়ে মাতৃত্ব অনেকের কাছেই জোনাকি পোকার আলোর মত। অথচ মাতৃত্বের অনুভূতির সেই হিরে মানিকের প্রতি আকর্ষণ উপেক্ষা করা যায় না। ফলে প্রয়োজন পড়ছে শাহিদাদের মত ডিম বেচা মেয়েদের। গত কয়েক বছরে কেরালা, চেন্নাই, মুম্বাই থেকে এরকম অনেক শাহিদারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাড়ি দিচ্ছে নিজেদের ডিম্বাণু বেচতে। শারীরিক ঝুঁকির কথা একবারও না ভেবে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি অস্বাস্থ্যকর কোন ক্লিনিকে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিতে একবারও ভাবছে না তারা।
তাদের সেই ডিম্বাণুর সঙ্গে শহুরে ‘বাবু’দের শুক্রাণুর সঙ্গমে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম। ”অন্ধকার হতে উৎসরিত আলো”।
এক একটি ডিম্বাণু বিক্রির বিনিময় মূল্য প্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার। তবে ‘নিকি ডোনারেরা’ এখান থেকে পায় মাত্র পাঁচ থেকে দশ হাজার। বাকিটা? আবছা আঁধারের শেষেও একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার কী লুকিয়ে থাকে? বোধহয় থাকে। তাই তো শারীরিক, মানসিক কষ্ট সহ্য করে কোনো এক অপরিচিত হবু মায়ের স্বপ্ন সাজিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাদের প্রাপ্যটুকুর বেশির ভাগটাই তুলে দিতে হয় দালালের হাতে। শাহিদাদের মত ডিম বেচা মায়েদের খুঁজে দেওয়ার জন্য বেশ চড়া দাম হাঁকিয়ে বসেন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত দালালরা। তবে ডিম্বাণু-দাত্রী বেছে দেওয়ার ক্ষেত্রে থাকে একটিমাত্র শর্ত। নিকি ডোনারের ‘সৌন্দর্য’। ‘বাহ্যিক সৌন্দর্যের’ ভিত্তিতেই দালালরা তাদের ‘দাম’ নির্ধারণ করে। তারপর কোন এক ক্লিনিকে তাদের শরীর থেকে বার করে নেওয়া হয় ডিম্বাণু। অবশেষে নিষিক্ত ডিম্বাণু গর্ভস্থ ভ্রূণে পৌঁছে যায়। এভাবেই নিজেদের অসহায়তা, দারিদ্র, প্রয়োজনের বিনিময়ে স্বপ্ন ফেরি করে এই জীবনের ফেরিওয়ালিরা।
ঠিক কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয় এই স্বপ্ন ফেরির সময়? প্রথমে দালালের মাধ্যমে খোঁজ মেলে আগ্রহী ডিম্বাণু-দাত্রীর। তারপর হরমোন ইনজেকশন এর মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয় তার ঋতুচক্র। স্ফীত হয় ডিম্বাশয়। খুব কম সময়েই তার পরিবর্তন হয় হরমোনের ফলে। তারপর ডিম্বাণু উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই ডিম্বাণু অপারেশনের মাধ্যমে তাদের শরীর থেকে বের করে নেয়া হয়। সবটাই শুধু শারীরিক নির্ভরশীলতা। এমনকি ডিম্বাণু দাত্রীর সৌন্দর্যটুকুও সেই ভাগেই পড়ে যায়। এই বিষয়টা চলার সময় কোনো এক ক্লিনিকের অস্বাস্থ্যকর ঘরে থাকতে হয় এদের।কেবলমাত্র শারীরিক সক্ষমতা আর আর্থিক অক্ষমতাই মাপকাঠি। মানসিক চর্চার কথা এক্ষেত্রে কোথাও স্থান পায় না। অবশেষে ডিম্বাণু নামের এই কোষীয় স্বপ্নেরা বিক্রি হয়ে যায় টাকায়।
কম সময়ে অর্থের উপার্জন এবং গর্ভ ভাড়া দেওয়ার মতো সময়সাপেক্ষ না হওয়ায় অনেকেই নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন না হয়েও পা বাড়াচ্ছে এই পথে। বয়সের কথা ভাবা তো দূর অস্ত।
এমন ভাবেই নিষিক্ত ডিম্বানু কোন এক হবু মায়ের গর্ভ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। জন্ম নেয় ছোট্ট প্রাণ। আদরের পুঁটুলি। স্বপ্ন ও ইচ্ছেদের মাখামাখি সেখানে। আর সেই ডিম্বাণু-দাত্রী বা নিকি ডোনার? আবার অন্য কোথাও হয়তো স্বপ্ন ফেরি করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।