ধারাবাহিক অনুবাদ গল্পে পূর্বা দাস (পর্ব – ২)

যুদ্ধের প্রহর

কুঞ্জবিহারীর বন্ধুরা তাদের দুঃসাহসী খেলার মাশুল খুব বড় করেই দিয়েছিল সেদিন। সত্যিই ওরা নেমেছিল নদীতে আর সেখানে বেশ বড়সড় সিলিন্ডারের মতন কিছু পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিল। এতদিন ওরা বিমানের ভেঙ্গে টুকরো হওয়া জিনিসপত্র পেয়েই সন্তুষ্ট ছিল। এবারে প্রায় অক্ষত কিছু পাওয়াতে ওরা ভুলে গিয়েছিল যে এই যুদ্ধবিমান গুলির কাজ শুধুই ধ্বংস করা। তাছাড়া এসব ব্যাপারে কতটুকুই বা জ্ঞান ছিল ওদের! ওরা ওই বিশাল জিনিসটাকে কায়দা করে তুলে এনেছিল নদী থেকে। বয়ে নিয়ে এসেছিল ওদের গ্রামে, যেখানে ওরা ছোটখাটো কামারশালা তৈরি করেছিল। এর কিছুক্ষন পরেই কুঞ্জবিহারী একটা বিকট আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে অনেক জ্বলন্ত ধাতুর টুকরো উড়ে এসে পুকুরের জলে পড়তেই পুকুর টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করল। ওর হতভাগ্য থাংজম গোষ্ঠীর বন্ধুদের বেশিরভাগই সেদিন মারা গিয়েছিল।কয়েকজন মাত্র সাংঘাতিকভাবে আহত হয়ে বেঁচে রইল। ওরা জানত না যে, ওরা একটা বোমাকে খুঁচিয়ে খুলে ফেলতে চেয়েছিল যেটা কিনা তখনও সক্রিয় ছিল।
যুদ্ধ চলছিল। পৃথিবী জোড়া যুযুধান দুই শিবির, কে কোন উপায়ে পরস্পরের ওপর আঘাত করতে পারে সেই চিন্তায় ব্যস্ত ছিল। অথচ কুঞ্জবিহারী কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারছিল না কেন এই যুদ্ধ। কেন ওর দেশের মানুষেরা এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে দিন দিন। সে নিজেকে অভিশাপ দিতে শুরু করল। ভয়ঙ্কর এই সময়টাতে ওর জন্মানোর কি দরকার ছিল! এমন তো কিছু বেশি চাওয়ার নেই ওর জীবনের কাছে। পূজো পার্বণ, মেলাতে মানুষের সঙ্গ পাওয়া, কখনো কখনো রাজকীয় নাটমন্দিরে রাসলীলার নাচ দেখা আর মাঝেমধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গুলতানি – সুন্দর সুন্দর মেয়েদের নিয়ে আলোচনা; এই – ই তো। এইটুকুই তো সতেরো বছর বয়সের কাছে এক পৃথিবী আনন্দ। এখন এও দুষ্প্রাপ্য। কুঞ্জ দু হাত গালে দেখে দুঃখী হয়ে থাকে সবসময়। কিভাবে ওর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা ওকে হয় বিছানার নিচে বা ট্রেঞ্চে লুকিয়ে কাটাতে হচ্ছে। কোনো মানে হয়! অবশ্য তার মানে এই নয় যে, ও বোকার মত জীবনের ঝুঁকি নেবে। যেমন ওর থাং জ ম বন্ধুরা করেছিল। যুদ্ধ নিশ্চয়ই থেমে যাবে একদিন। কি লাভ যদি তখন ও নিজেই না থাকে!
গর্ত খোঁড়া জারি রাখল কুঞ্জ, অন্তত যতদিন না এই নরকযন্ত্রণা শেষ হয়।
বেশ কিছুদিন পর গ্রামের সবার মনে হল যথেষ্ট পরিমাণে বাঙ্কার তৈরি করা গেছে। এখন চাইলে গ্রামের সব মানুষই একসাথে লুকোতে পারবে। তারা কিছুদিন বন্ধ রাখল গর্ত খোঁড়ার কাজ। কুঞ্জ এখন দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়ির ভেতরেই কাটায়।ওর বাড়িটা বেশ বড়সড়। মোটা করে খড়ের ছাউনি দেওয়া ছাদ এবং শক্তপোক্ত মাটির দেওয়াল। পেছনে ছোট উঠোনটা পেরোলেই একটা পুকুর আর পুকুরের চারদিকে অনেকটা দূর পর্যন্ত ঘন বাঁশ ঝাড়। কুঞ্জ মাঝে মধ্যেই বাড়ির চারদিকে টহল দিয়ে বেড়া য়, যেন পাহারা দিচ্ছে ওর ছোট্ট ঘর, ওর বাবা-মা’কে। অথচ নিজেই জানত যে সেটা কতটা হাস্যকর। বোমা যদি সত্যিই পড়ে তাহলে এই ঘর, দু’চারটে আসবাব, পুরনো আমলের রান্নার সরঞ্জাম, মাটির উনোন – সব ছাই-মাটি হয়ে যাবে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কুঞ্জ এসবই চিন্তা করছিল। পেটটা গুড়গুড় করে উঠল বেশ জোরে। মনে পড়লো কাল রাতের খাবারে ‘ইয়ংচাক এরনবা’র কথা। এই খাবারটা মা বানায় বিনস আর আলু সেদ্ধ করে। আর কি কি মসলা দেয় কে জানে! খেতে শুরু করলে থামতে পারেনা কুঞ্জ। কিন্তু এখন ডাক পাড়া পেট আর জ্বলন্ত পশ্চাৎদেশ নিয়ে কুঞ্জকে দৌড়তেই হবে বাইরের দিকে।
খুব তাড়াতাড়ি ও পুকুর থেকে এক বালতি জল নিয়ে পায়খানায় ঢুকে পড়ল। প্রাচীন রীতিতে তৈরী ওদের গ্রামীণ শৌচালয়। সত্তর আশি বছর আগে এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তিনদিক ঘেরা ছোট্ট ঘর যাতে কোনো দরজা থাকত না। কুঞ্জ ওর ‘ খুদেই’ টা ফাঁকা জায়গা তে ফ্ল্যাগের মত টাঙিয়ে দিল যাতে ওর বর্তমান কার্যকলাপ নিয়ে কারও সন্দেহ না থাকে। ওটুকুই ওর পক্ষে যথেষ্ট নিশ্চিন্ত ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ছিল, মন খুলে পেট পরিষ্কার করার জন্য।
কুঞ্জর গোপন কম্মটি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় হুড়মুড় করে কেউ ঐ দরজাহীন শৌচঘরে ঢুকে এল। মুহূর্তের স্নায়ুর তাড়নায় কুঞ্জ উঠে দাঁড়ালো বেশ একটু ভয় আর বিরক্তি নিয়েই। কে এমন অশালীন অনুপ্রবেশকারী! পেছন ঘুরতেই কুঞ্জ একদম স্থির হয়ে গেল। ভয়ার্ত কুঞ্জ দেখল, উল্টোদিকের মানুষটিও একইরকম বিহ্বলভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। লোকটির পরনে সবুজ- বাদামী মেশা মিলিটারি ইউনিফর্ম, লাল রঙের ব্যাজ ওয়ালা কলার। মাথায় সাহেবী হ্যাট। কুঞ্জ যখন দেখল, আগন্তুক একটা লম্বা বন্দুক ওর দিকে তাক করে আছে, অসম্ভব প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সে তার হাতের পিতলের বালতিটা সোজা ছুড়ে দিল লোকটির মাথা লক্ষ্য করে। কিন্তু তখনও কুঞ্জ র কোন ধারনাই ছিলনা যে, তার এই পিতলের বালতি পৃথিবীর ইতিহাসের চলন পথে কি পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।