ধারাবাহিক অনুবাদ গল্পে পূর্বা দাস (অন্তিম পর্ব)

যুদ্ধের প্রহর

– Echi, Nii, Saan…
সৈনিকটির দুর্বল স্বর কুঞ্জর কানে আসতেই ও চোখ তুলে তাকাল। সত্যিই সে মৃদুস্বরে কিছু বলে চলেছে। খুব উদাসভাবে, যেন হারানো কিছু খুঁজছে, এভাবে লোকটি উচ্চারণ করে,
– Noga shoriye no
Koshin shimashou
Nowa eikoto
Shori shimashou…
কুঞ্জ বোঝে, লোকটি গান গাইছে। ও এক মনে শুনতে থাকে। দুর্বল নীরস কণ্ঠস্বর কুঞ্জর কাছে মনে হয়, সুদূর কোন জগত থেকে ভেসে আসা আবেগ। লোকটি বার বার পুনরাবৃত্তি করছিল লাইনগুলি। কুঞ্জও ওর সাথে হারিয়ে গেল এক অচেনা দেশে।
যুদ্ধ চলতে থাকল। যদিও কিছু ভাল খবর ইম্ফল থেকে গ্রামেগঞ্জে ভেসে আসছিল। কিন্তু সন্ত্রাসের কামাই ছিলনা। কাছে দূরে বোমাবর্ষণ আর সাথে প্রাণহানির বিরাম নেই। সৈনিকটি চুপচাপ থাকাই পছন্দ করত এবং কুঞ্জবিহারীও চেষ্টা করেনি ওর শান্তিতে ভাগ বসাতে।
বেশ কিছুদিন পর প্রতিদিনের মতোই সন্ধ্যেবেলা ও সৈনিকটিকে দেখতে ঘরে ঢুকতেই লোকটি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। এই প্রথমবার কুঞ্জ ওকে হাসতে দেখল। কুঞ্জও অপ্রস্তুতভাবে একটা ফ্যাকাসে হাসি ফেরত দেয়। সৈনিকটির স্বাস্থ্য তুলনামূলকভাবে এখন অনেকটা ভাল হয়েছে।
– কুঞ্জবিহারী! লোকটি বলে।
হায়! হায়! কখন শিখে ফেলে আমার নামটা? কুঞ্জ খুশি ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু বিস্ময় কাটে না ওর। কিভাবে! তুমি… মানে… অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই ও উত্তরটা খুঁজে পায়। আর শিখবে নাই বা কিভাবে! মা যা চীৎকার করে ডাকে আমায় সারাদিন। না শেখাই তো আশ্চর্যের।
– সেইফুকু…সৈনিকটি বলে। হাত দিয়ে নিজের ইউনিফর্মটা দেখিয়ে দেয়। ওটা পরিষ্কার করে কেচে মা দরজার পাশে ঝুলিয়ে রেখেছিল, ও এখানে আসার পরের দিনই। কুঞ্জ ওটা এনে দিলে লোকটি নীচু হয়ে ওকে অভিবাদন জানায়। প্রশান্তির ছায়া ওর চোখেমুখে।
– তুমি চলে যাচ্ছ? কুঞ্জ উদ্বিগ্ন। কোথায় যাবে তুমি? যদিও জানে এ প্রশ্নের বিন্দুবিসর্গও লোকটির বোঝার কথা নয়।
সৈনিকটি ধীরে ধীরে তার ইউনিফর্ম পড়ে নেয় আবার সে তার প্রিয় গান টা গুনগুনাতে থাকে।
– Noga shoriye no
Koshin shimashou
Nowa eikoto
Shori shimashou…
কুঞ্জ সামান্য বিষন্নতা নিয়ে ঘর ছেড়ে বাবা-মার কাছে যায়। তাদের জানায় সৈনিকটির বর্তমান হালচাল। তারা কোন উত্তর দেয়না। কুঞ্জ সৈনিকটির গাওয়া গানটি নিজের মনে গাইতে গাইতে বাইরের দিকে চলে যায়। বিদেশি ভাষার গানটি ওর মনে গভীরভাবে গেঁথে গেছে এই কদিনে।
সেদিন রাত্রে কি মনে করে কুঞ্জ ওদের ঘরের পিছনের দরজাটা খোলাই রেখে দেয়। যদিও রাত্রে এভাবে দরজা খোলা রাখাটা বেশ বিপদজনক, কিন্তু পূর্ণিমা রাতে রূপোলী চাঁদের আলো যেভাবে বাড়ির পেছনের দিকের বাঁশবনকে এক অলীক মায়ার রাজ্য করে তুলেছিল, কুঞ্জ লোভ সামলাতে পারল না।
পরের দিন সৈনিকটিকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। বাঁশের হাতলওয়ালা একটা ছোরা ওর বিছানায় রাখা ছিল। কুঞ্জ বুঝল, এটা সৈনিকটির তরফ থেকে বিচ্ছেদ উপহার।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ থামল। মিত্রশক্তির জয় হয়েছে – এরকম কিছু খবর আসতে থাকে ইম্ফল থেকে। বড় বড় পণ্যবাহী গাড়িতে করে মৃতদেহের স্তুপ রাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া শুরু হল। বিজয় উৎসব পালন হচ্ছে এখানে-ওখানে। কুখ্যাত জাপানি সেনাদের বিমান হানার কথা আজও মণিপুরের মানুষ স্মরণ করে।
সত্তর বছর কেটে গেছে তারপর। কুঞ্জবিহারী মৃত্যু শয্যায়। ছোট নাতিটি দাদুর পাশে সারা দিন চুপ করে বসে থাকে। দাদুর কোচকানো চামড়াওয়ালা হাতে হাত বোলায়। কুঞ্জর চোখের মনি এই ছোট্ট কুড়োটা। কিন্তু এখন ওর চোখ সেই দরজার দিকে, যা সে সত্তর বছর আগে এক রাত্রে অবচেতন মনে খোলা রেখেছিল। আজও দরজা তেমনি ভাবে খোলা। আজও সেখানে তেমনি ঘন বাঁশগাছের জঙ্গল।
বাঁশের হাতলওয়ালা ছোরাটা সে সারাজীবন নিজের কাছে রেখেছে। এক অমূল্য উপহার, অঘোষিত এক বন্ধুর কাছ থেকে। কুঞ্জর ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায়। সৈনিকটির স্মৃতি, সেই কয়েকটা দিনের আশ্চর্য মুহূর্তগুলো ওর মনের মধ্যে ভাসতে থাকে। এত বছরে এমন কোনও দিন হয়নি যে সে তার কথা মনে করেনি। তার সেই প্রথম মোকাবিলার গল্প কতবার যে কতজনকে শুনিয়েছে তার সীমা নেই। কুঞ্জর সেই গর্বের মোকাবিলা।
– দাদু, আমি যদি তোমার সবচেয়ে পছন্দের গানটা গাই, কেমন হয়? ও দাদু, তুমি শুনছ
তো? ছোট্টটা দাদুকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্রশ্ন করে। কুঞ্জ মাথা নাড়ানোর আগেই সে শুরু করে দেয় –
Noga shoye no
Koshin shimashou
Noga eikoto
Shori shimashou…
দুজনের কেউই অর্থ জানে না এই গানের। কিন্তু অদ্ভুত এক আনন্দের আলো ছড়িয়ে আছে দুজনের মুখে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।