কুঞ্জর মা এতক্ষণ উদ্বিগ্নমুখে বাবা আর ছেলের কথাবার্তা শুনছিল। এখন বেশ রাগত চোখে লোকটির দিকে চাইতেই কুঞ্জ সতর্কভাবে মা’কে বলল, ” কি হল? এভাবে তাকাচ্ছ কেন, মা?”
“ওর সেবা করতে গিয়ে তো মনে হচ্ছে তুই নিজের প্রাণটাই দিয়ে দিবি।” মা শুকনো মুখে তাকায় কুঞ্জর দিকে।
“তা যা বলেছ মা! আমি মরব, না তোমরা ?সারাদিন তো দুজনে ঘরেই বসে থাকো, কখন বোমা পরবে তার অপেক্ষায়। এত যে ট্রেঞ্চ কাটলাম একদিনও গেছ1 সেখানে? “
“ওরে বোকাটা! আমি কি বলছি, বোঝার চেষ্টা কর। লোকটা জেগে উঠে কি মূর্তি ধরবে তুই জানিস? ও কি তোকে ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানাবে? হুঃ!”
” না। সেটা তুমি ঠিকই বলেছ মা।” কুঞ্জ ঢোঁক গেলে। “ও আমার দিকে বন্দুক তাগ করে ছিল।”
” তাহলেই বোঝো! তুই বলেছিলি না, এই যুদ্ধে আমাদের শত্রু বা বন্ধু বলে কেউ নেই। তার মানে এই পরিস্থিতিতে আমরাই সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছি। দু’পক্ষের কাছেই আমরা সমান, তাই আমাদের মেরে যদি ওদের লাভ হয় সেক্ষেত্রে ওরা সাথেসাথেই সেটা করবে। দয়া মায়া খুব ভালো জিনিস, কিন্তু তার জন্য সঠিক সময় সময়ের প্রয়োজন, তাই না! তোর বাবা একদম ঠিক কথাই বলেছে। যত তাড়াতাড়ি পারিস এটাকে ঘাড় থেকে নামা।”
” তুমিও একথা বলছ!” কুঞ্জ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মা’র দিকে তাকিয়ে কঁকিয়ে ওঠে। “কি চাও তোমরা? মেরে ফেলব? মেরে ফেলব এই আধমরা মানুষটাকে? পিতলের বালতিটা দিয়ে আরেক ঘা দিলেই তো…” হতাশায় ভেঙে আসে কুঞ্জর গলা।
“হরে কৃষ্ণ! হরে কৃষ্ণ! কি বলছিস তুই! আমি বলব কাউকে মেরে ফেলার কথা! হায় ভগবান!” কুঞ্জর মা এবার কেঁদে ফেলে। “আমি শুধু বলেছি, ওকে আমাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
“ঠিক আছে মা। এবার তুমি যাও। আমি ভাবছি ওর ব্যাপারে। বাবা তো বলেছে, যে ওর দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। তাহলে আমাকেই ভাবতে দাও কি করব। যাও তো। এখন ও ঘরে যাও।”
মা’কে ঠেলেঠুলে ঘর থেকে বের করে লোকটির কাছে এসে দাঁড়াল কুঞ্জ। মানুষটি এখন শান্তিতে শুয়ে আছে বিছানায়। একটুক্ষণ ও ভাবতে চেষ্টা করল লোকটিকে নিয়ে ও কিভাবে কি করতে পারে। কিন্তু একটা প্রচন্ড দুর্গন্ধ ওর চিন্তাকে ব্যাহত করল। কুঞ্জ ভাবল, আগে ওকে ভাল করে পরিষ্কার করা যাক। তারপর বাকি ব্যবস্থা।
বড় সিলভারের গামলায় উষ্ণ গরম জল আর সুতির গামছা নিয়ে লোকটিকে পরিষ্কার করতে শুরু করল কুঞ্জ। খুব আস্তে আস্তে ও লোকটির নোংরা ইউনিফর্ম খুলে নিল। শরীরে জমে থাকা বহুদিনের ময়লা আর রক্তের দাগ পরিষ্কার করল নরম কাপড় দিয়ে। একদম স্থির হয়ে শুয়ে রইল মানুষটি অজস্র ক্ষত আর ঘায়ে ভরা শরীর নিয়ে। পরিষ্কার করা হলে নিজের একটা রোব ওর গায়ে জড়িয়ে ভাল করে কম্বল ঢাকা দিয়ে দিল।
কুঞ্জর বাবা-মা ওর কান্ডকারখানা দেখেও দেখছিল না। ওকে সাহায্য করতেও এগিয়ে এল না তারা। তবু সে তার মনস্থির করতে পারছিল না। বাবা-মার চূড়ান্ত অমত সত্বেও মানুষটিকে ত্যাগ করতে ওর মন সায় দিচ্ছিল না। যতবার সে অসুস্থ, প্রায় বিছানার সাথে মিশে যাওয়া দেহটার দিকে তাকায়, তার মন করুণায় ভরে উঠতে থাকে। অপরাধবোধে বিচলিত হয় সে বারবার।
রান্নাঘরে বসে বাবা-মার সাথে নৈশাহার সারে কুঞ্জ। খুব অল্পই খেল সে আজ। সারাক্ষণ দুজনেই ঘ্যান ঘ্যান করে গেল, কুঞ্জ যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অচেনা সৈনিকটিকে ঘর থেকে বিদায় করে। মা যখন শেষপর্যন্ত একথা বলল যে, লোকটি ঘরে থাকা পর্যন্ত যেটুকু ঘুম তারা সারাদিন ঘুমোতে পারে সেটাও বিসর্জন দিতে হবে, কুঞ্জ ধৈর্য্য হারাল।
“ঠিক আছে, বাবা, ঠিক আছে। কাল সকালেই আমি বরমানি খুড়োকে ডেকে যা করার করে ফেলব। এবার তোমাদের ঘ্যানঘ্যানানি থামাও দয়া করে।”
শুতে যাবার আগে শেষবার ও সৈনিকটিকে দেখতে ওর ঘরে ঢুকতেই একদম চমকে উঠল। লোকটির চোখ খোলা। সাদা মুখে যেন সামান্য রক্তের ঝলক। কুঞ্জর চোখের মণি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। ও একদম স্থির হয়ে গেল। লোকটি হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে কুঞ্জর দিকে তাকাল। কুঞ্জ বুঝল, তার পা কাঁপছে। তবু সে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলল ঠোঁটে। তার মনে হলো সৈনিকটি এতে বন্ধুত্বের আশ্বাস পাবে।