।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় পম্পা দেব

‘মাৎস্যন্যায়’, নাট্যদর্পণে অন্য ইতিহাস, একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া

‘প্রিয় মানব, তুমি জেনো রাজা রাজাই থাকেন , বয়স্য থাকেন বয়স্য, নির্বোধ ভাঁড় শেষ পর্যন্ত ভাঁড় হয়েই জীবন কাটান আর রাজকর্মচারী কোনো সৈনিক শেষাবধি থাকে অনুগত ও শিষ্টাচারী। এমনকী রাজাও নিমেষে তাঁর চেহারা পরিবর্তন করে কারও পদলেহন করতে পারেন , বংশবদ হতে পারেন , ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারেন , গবীর জলাশয়ে পক্ক রোহিত মৎস্যের মতোই গায়ে গুল্ম শৈবাল জড়িয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে পারেন প্রকৃত সময়ের জন্য, তারপর তাঁর সেই সময় এলে ধারণ করতে পারেন স্বমূর্তি ও শরীরে স্বৈরাচারের তীব্র মদমত্ততা। কিন্তু সৈনিক তার ধর্ম ত্যাগ করতে পারে না, তার ধর্ম হল যুদ্ধ করা , যুদ্ধ করা এবং যুদ্ধ করা। এই মহাসমর কখনও শত্রুর বিরুদ্ধে, কখনও রিপুর বিরুদ্ধে আবার কখনও-বা নিজের বিরুদ্ধে । সংগ্রাম তার ধর্ম, আত্মক্ষয় ও ধ্বংস তার অন্তিম পরিণাম । কিন্তু প্রকৃত সেনাপতি কোনো পিশুন কুৎসায় আহত হতে পারেন না, কোনো অবিমৃশ্যকারীর চক্রান্তে বেদনাবিদ্ধ কাতর হতে পারেন না , এমনকী স্বয়ং ঈশ্বর যদি সেই সৈনিকের পথের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাত তুলে তার অন্তিম দিনক্ষণ ঘোষণা করেন, প্রকৃত সৈনিক তখন তার তরবারি তুলে দ্বিখণ্ডিত করতে চায় সেই নিয়তিসদৃশ ঈশ্বরকে। আর তাই মাৎস্যন্যায়ই আমার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ , যে সময়ে আমি সৃজন করতে পারি, বিস্তার ঘটাতে পারি, বিশাল মহীরুহ হয়ে অগণিত চারাগাছ রোপণ করে যেতে পারি এবং শেষ পর্যন্ত একমাত্র নিজেই নিজের ধ্বংস ডাকতে পারি মহাকালকে বিদ্রুপ করে …’

‘মাৎস্যন্যায়’ ,শেক্সপিয়র থেকে বাণভট্ট , কান্যকুব্জ থেকে ঘুরে ঘুরে ভেসে আসা এক আশ্চর্য নাটক , যা 1594 থেকে অনায়াসে এসে পড়ে আজকের 2020 র বিশ্ব তথা ভারতবর্ষে। গোটা পৃথিবীতেই যখন অতিমারীর প্রকোপ, অর্থনৈতিক ভারসামহীনতা , জাতপাত, ধর্মান্ধতা , বর্ণবিদ্বেষ, এবং সর্বাপেক্ষা বৃহৎ অর্থে যে রাজনৈতিক মুষলপর্ব চলেছে , এই মুহূর্তে এই নাটকের এক আশ্চর্য আবির্ভাব । জন্ম। সৃষ্টি।

মৌলিক নাট্যকার হিসেবে শ্রীব্রাত্য বসুর যে ধারাবাহিক অবদান বাঙলা তথা ভারতবর্ষের থিয়েটার এবং সাহিত্যের শীর্ষ স্থানকে ক্রমাগত পুষ্টি দান করে চলেছে , এবং তাঁর অন্যান্য ঐতিহাসিক বা ইতিহাস ও সাহিত্যের ঐতিহ্যগত নাটকগুলির পাঠ ও মন্ঞ্চ অভিনয় দর্শক নন্দিত , পাঠক ধন্য , যেখানে যে ভাষা ও শব্দের ব্যবহার ইতিহাসের সময় ও স্থান নির্ভর , যা গবেষণাধর্মী , এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এক পাঠসুখ প্রদানকারী টেক্সট, যার ছত্রে ছত্রে তীক্ষ্ণ শ্লেষ, বেদনা , ক্রোধ, ধিক্কার, মুখরিত হয়ে উঠেছে। বলা ভাল, এই বেদনা , এই এক্সট্রিম স্যাটায়ার পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরে আজকের ভারতবর্ষীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট ।

রাজনীতির যে ইতিহাস, যে বেদনাসিক্ত অতীত , যে বিশ্বাসঘাতকতা , চক্রান্ত, হঠকারিতা, ন্যয়নীতির ভারসামহীনতা, বিচার ব্যবস্থার অন্ধত্ব , ছক ভাঙা গড়ার অনৈতিক খেলা , যে দর কষাকষি, তা সেই সৃষ্টির আদি থেকেই বিদ্যমান। ব্রাত্য বসুর নাটকে , ইতিহাস নির্ভর নাটকে বারবার সেইসব ফিরে আসে নানান ফর্মে । তা সে ‘ইলা গূঢ়ৈষা ‘ হোক বা ‘অনুসোচনা’ বা ‘হেমলাট, দ্য প্রিন্স অব গরানহাটা ‘ বা ‘ পেজ ফোর , ইটস অলসো আ গেম’।

আমরা জানি, নাট্যকার শ্রীব্রাত্য বসুর লেখায় কীভাবে সেন্স অব হিউমার ব্লেন্ডেড থাকে সিরিয়াস ডায়ালগে। কী অসম্ভব মেধা , শ্রম ও দ্রষ্টব্য শক্তি থাকলে , এবং যে লেখায় প্রতিমুহূর্তে নিজেকেই নিজে লেখক হিসেবে, ,নাট্যকার হিসেবে, নাট্য নির্দেশক হিসেবে, এবং একজন নির্বাচিত জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন , এক খাদের ধার থেকে আবার এক উপত্যকার পৃষ্ঠে এনে দাঁড় করাতে পারেন , শিল্পের মোড়কে রক্তাক্ত জীবনের গল্প বলতে পারেন , সেই আশ্চর্য, অনুপম জাদুশক্তি কোন বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে, তা গভীর ভাবে ভাবায়। একজন প্রকৃত পাঠকের কাছে এই পাঠ এক সাংঘাতিক অতিক্রমণ ।

প্রতি অঙ্কে প্রতি দৃশ্য শুরু ও শেষে কেবলই মনে হয়েছে , এই নাট্যাভিনয় যখন হবে , তার কী রূপ তৈরি হবে। কে করবেন মহাবাহু বা টাইটাস অ্যান্ড্রেনিকাস , কেইবা রাজ্যবর্ধন বা হর্ষবর্ধন , মূলা তামোরা , বা কৃষ্ণ বর্ধন , শশাঙ্ক। কেমন হবে সেই অভিঘাত। শুধু পাঠেই যে অভিঘাত তৈরি হয়েছে, যে তীব্রতা সৃষ্ট হয়েছে, মন্ঞ্চ অভিনয়ে তা কী ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ হয়ে উঠবে তা ভাবলে শিহরণ জাগে মনে।

‘তা হলে এসো প্রতারণা এসো। তার ভ্রাতা চক্রান্ত তুমিও এসো। এসো মধ্যমেধা এসো। ঈশ্বরের বরপুত্র হয়ে তুমি প্রতিজন্মে যেন নবজন্ম লাভ করো মিথ্যা শঠতা আর নিষ্ঠুরতার মাঝে। এসো চাটুকারিতা , প্রবন্ঞ্চনা , আর কুৎসাকারী এসো, জয়ী হও। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে ভর করে , ব্যবহার করে বেঁচে থাকা ভীরু ক্ষমতাজীবীর দল। এসো জন্মে জন্মে , যেন তোমরা প্রতিবার জয়যুক্ত হও, আজ সেই প্রার্থনা করি । এসো মৃত্যু এসো , তুমি আলিঙ্গন করো আমাকে। তুমি জেনে রেখো , জয়ী হতেই শুধু মানুষ তরবারি ধরে না, সংগ্রাম তার স্বধর্ম বলেও সে তরবারি ধরে। হেরে যাবে জেনেও সে লড়ে , লড়তে হবে বলে সে লড়ে ‘
‘মাৎস্যন্যায়’ : নাটক ব্রাত্য বসু ।
শারদীয়া আনন্দলোক পূজাবার্ষিকী 1427

ত্রয়োদশ শতাব্দের পুরনো ও উপকথা-বিষয়ক ল্যাটিন সংকলন থেকে প্রাচ্যের চম্পুকাব্য , শোন নদীর তীর থেকে স্থানেশ্বর , সরস্বতী নদীর তীর ছুঁয়ে মগধ , মালব , প্রাগজ্যোতিষপুর , উৎকল , দক্ষিণ ভারত ব্যাপী শশাঙ্ক, দেবগুপ্ত , ভাস্করবর্মা , চালুক্য , 1594 থেকে 2020। এই নাট্যের বিস্তার এতই সুপ্রাচীন , এতই সমসাময়িক, তার প্রতিটি ভাব বিস্তারে রয়েছে সাহিত্য ও ইতিহাসের নিটোল বুনন, উইলিয়াম শেক্সপিয়র থেকে বাণভট্ট, ‘টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস’ থেকে ‘হর্ষচরিত’ , ইতিহাসের হাত ধরে সাহিত্যের হাত ধরে আবির্ভূত হল , জন্ম নিল , সৃষ্টি হল ‘মাৎস্যন্যায়’।

এই নাটক কি শুধুই ইতিহাসের কথা বলে। নাকি শুধুই রাজনীতির কথা বলে। আরও গভীরে প্রবেশ করতে করতে এই নাটক বলে নারীর ক্ষমতায়ন ও তার অসদ্ব্যবহার। বলে নারীর পৈশাচিক আনন্দ, নিষ্ঠুর মতির কথা , নারী হয়ে অপর নারীর প্রতি হিংস্র, অনমনীয় , ক্রূর, অসম্ভব নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার কথা।
নারীর ব্যভিচারের কথা , অত্যাচারের , প্রতারণা, শঠতা আর চক্রান্তের কথা। নারী হত্যাকারীও , সেই কথা।

ইতিহাস ও রাজনীতির অলিন্দে সিংহাসন জয়ের নেপথ্যে যে শোকগাথা লেখা থাকে , যে বীরের শোণিত লেগে থাকে , অনুগতর যে দুঃখ লেগে থাকে , অত্যাচারিতের অভিশাপ লেগে থাকে , হত্যাকারীর দম্ভ লেগে থাকে , এই নাটক সেই কথাও বলে। এই নাটক ক্ষমতার আস্ফালন, ঔদ্ধত্যের সীমাহীন অনাচারের কথা বলে।

ইতিহাসের ছত্রছায়ায় এক করুণ কাহিনি । যার অন্দরে গ্রহবর্মার হত্যা এবং রাজ্যশ্রীর চোখের জল আছে , দেবগুপ্ত এবং শশাঙ্কের মতো চরিত্রের মধ্যে দিয়ে সমসাময়িক সময়ের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের ছায়া প্রতিফলিত হয় যেন। এবং ব্রাত্য বসুর মতো সত্যদ্রষ্টা লেখকের পক্ষেই ইচ্ছেরূপধারী ‘শলাকা’ নামক মেটাফরের উদ্ভব সম্ভব । বিচক্ষণ, রসিক পাঠক মাত্রই তা উপলব্ধ হবেন।

যৌনতাও একপ্রকার ক্ষমতার জন্ম দেয়। যে ক্ষমতা
নারীও তার অভীষ্ট সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। যৌনতা একটি বিশেষ অস্ত্র । পুরাণ ও ইতিহাসের অভ্যন্তরে পুরুষ ও নারীর এই যৌনাস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তি মাত্রই তা জানেন , যা কিনা বিশ্বের ইতিহাসে মহাকাব্য গুলিরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ।

নিয়তিবাদে নির্দিষ্ট মানবজাতির জন্য যুদ্ধ এবং প্রেম , সংগ্রাম এবং আনুগত্য, বীরত্ব এবং জয় , মৃত্যু এবং প্রতিশোধ , তথাপি এইসব ধ্বংসাবশেষ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সর্বস্ব বিলিয়ে দেবার পরেও কোনো কোনো যোদ্ধা, কোনো কোনো বীর কখনও দৈবাৎ চূর্ণ হতে হতেও তাঁর সমস্ত জীবন দিয়ে মহাজীবনের পথে ধাবিত হন এবং সদর্পে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে যান এক আশ্চর্য বাণী ও আশার বীজ।

কেন ব্রাত্য বসুই শ্রেষ্ঠ নাট্যকার । কেন তিনিই শ্রেষ্ঠ ।
গতবছর ‘আততায়ী ‘ র সিরিজ লেখার পর যিনি এইবছর ‘মাৎস্যন্যায়’ লেখার অসম্ভব প্রতিভাধর হতে পারেন , আশ্চর্যজনকভাবে দুই বিপরীত মেরুর নাটক লিখতে পারেন , নির্মাণ করতে পারেন, পাশাপাশি ‘বেনিল তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল ‘ জাতীয় কবিতাকেন্দ্রীক , অনুবাদ কবিতা, বিশ্ববন্দিত কবি ও শিল্পীদের আত্মজীবনী আলোকিত বইয়ের জন্ম দিতে পারেন , আবার আশ্চর্য সব প্রবন্ধের রচয়িতা হতে পারেন , যিনি সত্যদ্রষ্টা, এবং পাথফাইন্ডার, নাটকের সমস্ত সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়ে অবহিত একজন মানুষ, অবরুদ্ধ পথের মুক্তির ছবি আঁকতে পারেন যিনি , অসময়ে সময়ের সম্ভাবনার কথা বলতে পারেন , এবং দিনান্তে আত্মগত সমস্ত প্রতিভার উদগিরনে সৃষ্টি করতে পারেন অক্ষরের পর অক্ষর , শব্দের পর শব্দের শস্যক্ষেত । যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে চলেছে ভারতবর্ষের থিয়েটার ও সাহিত্যের ঐতিহ্যগত মানদণ্ড ।

পুনশ্চ : ‘হর্ষবর্ধন ‘ একজন প্রসিদ্ধ নাট্যকার ছিলেন , এই নাটক না পড়লে অবগত হওয়া হতনা , ‘উষ্ণ রোহিত , চিঙ্গটি মৎস্য’, ‘ব্রহ্মপুত্রের বৃহৎ চিতল’ , ‘শূলপক্ক মৃগমাংস’ , ‘পুরোডাশ’ , ‘মৎস্য -অন্ন-নালিতাশাক-তালগুড় ‘ ইত্যাদি ইত্যাদি সুখাদ্য গ্রহণের সুখানুভূতি অতি চমৎকার প্রাসঙ্গিকতায় সুচারুরূপে পরিবেশিত হয়েছে যাতে তৎকালীন রাজাবাদশার নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাসের ছবি পরিস্ফুট ট্র্যাজেডি স্থানিক আত্মীকরণে আরেকটি ট্র্যাজেডির মধ্যে দিয়ে মৌলিক অধিকারে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে ।
মহাবাহুর মহত্তর ত্যাগ, নির্লোভ , নির্ভিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা এক অনুপম বার্তা আছে। সেইটিই যেন মূল ভিত্তি, সেইটিই যেন নাটকটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।