সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (দ্বাত্রিংশত্তম পর্ব)

একটা ঘোরের মধ্যে যদি কেউ সামান্য একটা ধাক্কাও মারে তাহলে যে শুধু ঘোর ভাঙে সেটাই না, পায়ে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। হঠাৎ করে অবচেতনের গভীর থেকে ভেসে আসা মহিলা কণ্ঠস্বরের ধাক্কায় আমি যেন মুহূর্তে বাস্তবতার কাঠিন্যে এসে দাঁড়ালাম।
ততক্ষণে খিলখিল হাসির শব্দটা যেন নদীর জলে ভেসে আসা ঢেউয়ের মাঝে দুলছে। আমি এগিয়ে গেলাম। নদীর জল যেন একটু থমকে দাঁড়িয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো।
–” তুমি কেমনতর পেমিক গো ঠাকুর! ভালোবাসার জনের মন বোজ না। ”
আমি কী বলি ! সব কথার যে উত্তর হয় না। এতোক্ষণ ধরে যে পরিমন্ডলে ছিলাম, সেখানেও আলোচ্য বিষয় ছিলো ভালোবাসা। কিন্তু তার প্রেক্ষিত ছিলো ভিন্ন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যে ভাবের ঘরের দোরে এসে দাঁড়িয়েছি, সে চৌকাঠের ওপারেও যে কুটুমের বাসাবাড়ি সে বাসাবাড়ির মূল ফটকের দরজাতেও লতপত করছে এক শায়েরীর ঢঙে লেখা বিজ্ঞপ্তি। সে বিজ্ঞপ্তিতেও যে অক্ষরেরা জ্বলজ্বল করছে, সে শায়েরীর বাংলা মানে করলে যে কথাগুলো নিরুচ্চারিত উচ্চারণে উচ্চারিত হয়ে গেলো সেও বুঝি ভালোবাসারই উচ্চারণ।
–” কী দুঃখ তুমি দিয়েছো
সেটা বোঝার কী এমন প্রয়োজন!
ওর অশ্রুসিক্ত আঁখিপাতায় যে কবিতা লিখে দিলে
সে কবিতার মানে কি ওকে বোঝালে? “
— ” তোমাকে কোনো জ্ঞান দেবুনি গো ঠাকুর। শুদু একটাই কতা, পেমিকের কাচে গালমন্দ খেতেও খারাপ লাগে না গো, কিন্তু কি বলো দেকি, পেমিকের সামনে দাঁইড়ে যদি কেউ তাকে সামান্য কটু কতাও বলে তালে পর পেমিকার বুক ভেইঙ্গে যায় গো। কোনো সান্ত্বনার কতাই তকন আর সে আগুনলাগা বুকে জল ঢাইলতে পারে না গো। ”
–” তোমার সাথে কি ওর দেখা হয়েছে গো নদী? ”
নদীর তরঙ্গভঙ্গের শব্দ যেন এক পলক থমকে দাঁড়ালো।
–” হয়েচে –”
–” কী বলেছে ও তোমায়? ”
–” কিচুটি বলে নি –”
–” তাহলে –”
–” তালে আমি জাইনতে পারলাম কীভাবে, তাইতো? ”
আমি নীরবে ঘাড় নাড়লাম।
— ” আমি যে ওকে পইড়তে পারি গো, ওর মনে কোন তরঙ্গের ওটাপড়ায় ওর দু’চোক ভেইঙ্গে পেলাবন এনেচে সেটা যে আমি… ”
আমার কি এখনও আশ্চর্য হওয়ার বাকী আছে? একটি নদী সেও নাকি থটরিডার! সেও নাকি কোনো মানুষের সুখদুঃখের সমস্ত কথা…
–” ঠাকুর, তুমি যদি ঠিকমতো ভালোবাইসতে পারো, তালেপর একটা পাতরের বুকের বেতরেও ঝর্ণা দেইকতে পাবে। পাখপাকালিদের সাতে কতা কইতে পারবে, গাচেদের পাতা ককন কোন কারণে দোল খায়, সুকে নাকি দুকে সেসব তোমার জ্ঞানচক্কুতে পরিষ্কার দেইকতে, বুইজতে পাইরবে গো ঠাকুর… ”
এ কোন আজব জটিল গোলকধাঁধায় এসে পড়েছি? এখানে ভাববাদ আর বস্তুবাদের মিশেলে জীবন একাকার হয়ে যায়, এখানে সত্যিই কি নদী — পথ — আলো মানুষের সাথে মতবিনিময় করে? নাকি মনই মনের সাথে এমনভাবে কথা বলে, যে কথাগুলো নদী, পথ, আলোদের সাথে বাকবিনিময়ের ক্ষেত্র গড়ে তোলে! আমি যে কী বুঝছি আর কী বুঝছি না, সেটা বুঝে ওঠাই আমার কাছে দুষ্কর হয়ে উঠছে ক্রমশ।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।