• Uncategorized
  • 0

গল্পেসল্পে পাভেল ঘোষ

গান্ডু’র ভোটনামচা

সেদিন সন্ধ্যায় পাকা চুলে চিরুনির ছোঁয়া দিতেই গিন্নি মুচকি হেসে একটা বান ছুড়লো….
“কি ব্যাপার? বয়স বাড়ছে না কমছে স্যার..?”
“আরে না গো.. ! সাহেব পাড়ায় একটা কালী পূজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাবো। ধসা’র অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারলাম না,বুঝলে গিন্নি..!”
“ধসা..! আহা..কি নাম..!”
গিন্নি এক গাল হেসে রান্নাঘরে পা বাড়াতেই আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
সাহেব পাড়ায় কালী মন্দিরের পাশেই কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো জুতসই স্টেজ।দেখেই মনে হচ্ছে ,জনগণের কাছ থেকে ভালো টাকাই আদায় করেছে পূজো কমিটি।
চারিদিক আলোর নকশা ঝলমল করছে দিনের আলোর মতো।
“আসুন স্যার…!” ধসা আমাকে দেখেই এগিয়ে এলো।
স্টেজে একটা স্টীলের নরম গদির চেয়ারে
বসতেই আরামটা টের পেলাম।সামান্য এই পাড়ার পূজোয় এত আয়োজন..!
সঙ্গে সঙ্গে একটা ‘হুঁকো মুখো ছেলে’ আমাকে জলের বোতল আর কাগজের প্লেটে সাজিয়ে প্রায় তিন চার রকম মিষ্টি দিয়ে গেল।
লোভ সামলাতে পারলাম না।সবে একটা রসগোল্লা গলাধঃকরণ করেছি,একটা চেনা শব্দে গলায় রস গেল আটকে…।
“সার…! কেমন আছেন?”
‘সার’…! একটা চন্দ্রবিন্দু বসলে আর দেখতে হতো না। ‘ষাঁড়’ হয়ে যেতাম।গান্ডুটা কে..?
তাকাতেই দেখি সত্যিই ‘গান্ডু’। আমার প্রাক্তন ছাত্র। স্কুলের মুখটা জীবাশ্মের মতো আটকে আছে নাক থেকে থুতনি পর্যন্ত। চিনতে পারলাম,তবে একটু কষ্টই হলো।
বছর আটেক আগে স্কুলে মিড ডে মিল পাবে না বলে এই গান্ডুই ক্লাস নাইনে উঠতে চাইছিল না।সেদিনে ওর বাঁধ ভাঙা কান্না আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
সেবছরই স্কুল ছেড়েছিল গান্ডু। শত চেষ্টাতেও ওকে স্কুলমুখো করতে পারিনি।
“বিন্দাস আছি সার..!” গান্ডু হাসিমুখে জবাব দিলো।
“এখন কি করছিস তুই ?”
“সারপ্রাইজটা আপনাকে দেবো বলেই ধসাকে বললাম,সার যেন আসে। আমার আ্যচিবমেন’ টা সারকে শোনাতেই হবে। একটু পরেই শুনবেন ..!”
“সে ঠিক আছে গান্ডু। তোর সঙ্গে চামচার মতো ঘুরছে ,ভদ্রলোকটি কে? বড় চেনা চেনা লাগছে বুঝলি? কোথায় যেন দেখেছি…!”
“সিরিয়াল আপনি দেখেন না তো..। আপনি সার চিনবেন কি করে? ও হচ্ছে কুমার ফালতু।এবারের বিধানসভায় আমাদের পার্থি । জনসংযোগ করতে নিয়ে এসেছি…”
হঠাৎ মাইকে শোনা গেল ধসা’র অমায়িক কণ্ঠ,
“আমাদের মধ্যে উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট সমাজসেবী তথা ‘অল ইন্ডিয়া খাই খাই পার্টি’র জেলা সভাপতি মাননীয় ‘গান্ডু দালাল’।
শুনে আকাশ থেকে পড়লাম।গান্ডুর মতো ভ্যাবলা ছেলে জেলা সভাপতি,যে কিনা ক্লাস এইট অব্দি পড়ে স্কুল থেকে পত্রপাঠ বিদায় নিয়েছিল।
“এই যে গান্ডুদার মাস্টার,কেমন আছেন?”
কানে এলো একটা কর্কশ কণ্ঠ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি,একটা ‘গালে ভুঁড়ি ওয়ালা লোক’ আমার দিকে মরা মাছের মতো চেয়ে আছে। মুখটা বড্ড চেনা লাগলো।
“আমাকে বলছেন..?” আমি জিজ্ঞাসা করতেই বললেন,”যা ব্বাবা… আর কাকে জিজ্ঞাসা করবো..?” ওনার ভ্রু নাচিয়ে কথা বলাটা আমার কাছে অসহ্য লাগলো। আমি মুখ ফিরিয়ে নিতেই দেখি,সামনে গান্ডু হাজির..!
“সার,পরিচয় করিয়ে দিই…, ইনিই আমাদের পার্থি, অভিনেতা কুমার ফালতু…”
আজকাল সিরিয়ালগুলোয় অভিনেতাদের নাম তো দেখায় না,তাই নামে ওনাকে চিনতে পারলাম না।তবে দু একটা সিরিয়াল দেখার সূত্রে বদনটা চেনা চেনাই লাগলো।
“আচ্ছা.! নমস্কার…” আমি হাত জোড় করে পরিচয় করলাম।
“সার,আমি এবার যাই… ধসা’দার ডাক পড়েছে..,আমাকে ইসপিচ দিতে হবে।”
গান্ডু অমায়িক হেসে মাইকের দিকে এগিয়ে যেতেই আমি উঠে পড়লাম।
“মাস্টার,এখন যাবেন না..! আশীর্বাদ করে তবেই যাবেন..,বলে দিলুম।”
ফালতু’র প্রচ্ছন্ন হুমকিটা টের পেলাম।
মটকাটা একটু গরম হয়ে গেলো।হাঁটুর বয়সী ছেলে..! সে কিনা মেজাজ দেখাচ্ছে..! ভিতরে ম্যাগমার আওয়াজটা টের পেলাম।
“এই যে ফালতু, অভিনয় বাদ দিয়ে ভোটের ময়দানে…! কি ব্যাপার..?”
“জনগণের সেবা করবো,এটা আমার অনেকদিনের ইচ্ছা..! সুযোগটা এসে গেলো মাস্টার..।মাইরি বলছি,পুরো জীবন দিয়ে দেব জনগণের জন্য..”
শুনে মনে হলো,কানের গোঁড়ায় দিই একটা।সংযত করলাম নিজেকে।
“জনগণ..! ফালতু না বকে আসল কথাটা বলে ফেলুন তো ফালতুবাবু…! কামাতে এসেছেন..তাই তো?”
“আসল কথাটা যখন ধরেই ফেলেছো মাস্টার,তাহলে বলি…সিরিয়াল,সিনেমা এখন মায়ের ভোগে।আগের মতো পয়সাও নেই।তার উপর আবার দলের লোক না হলে কাজ পাবো না।নতুন ছেলে মেয়েতে মার্কেট ভরে গেছে। কি আর করা…? ঢপ মেরে একবার জিতে গেলে পেনসনটা নিশ্চিত। এখন আবার দল বদলের হিড়িক। ঝোপ বুঝে ঘাই মারলে কোটি টাকা পকেটে,বুঝলে মাস্টার…”
ফালতু’র কথা শুনে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ করে পালিয়ে এলাম স্টেজ ছেড়ে। তখনও গান্ডুর গলা শোনা যাচ্ছে, “সবাই যদি দুবেলা মাংস ভাত খেতে চান,তাহলে খাই খাই পার্টির প্রতীকে ভোট দিতে ভুলবেন না। মনে রাখবেন…”
দিন দুয়েক পর….
বাজারের থলিটা হাতে নিয়ে বাইকে সদ্য স্টার্ট দিয়েছি,কলিং বেলটা উঠলো বেজে।
সদর দরজা খুলতেই দেখি হাসি মুখে কর জোড়ে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। পিছনে আট দশ জন ঝান্ডা ধরে দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে একযোগে হাসছে।
“কি ব্যাপার..?”
“আমরা ‘অল ইন্ডিয়া পকেট ভরো পার্টি’ থেকে আসছি।আমাদের ‘পারতি’ আপনার সামনে,সবার প্রিয় ভেবলিদি…! ‘ভেবলি দালাল’।আপনাদের নিজেদের মেয়ে। খাই খাই পার্টি তো দাঁড় করিয়েছে একটা অকাল কুষ্মান্ডকে। আমাদের একটাই লক্ষ্য,সবার পকেট ভর্তি করা..। দয়া করে ভোটটা ভেবলিদিকে দেবেন…!”
আমার প্রশ্নের উত্তরে একটা জীর্ণ,কালো, মাথায় সোনালী রং করা চুলের ছেলে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল।
শুনে আমার গা’টা জ্বলতে শুরু করলো।
রাজ্যের কি অবস্থা…..! একজন খায়,আর একজন পকেটে ভরে।
“স্যার, আপনি গান্ডুর মাস্টারমশাই..?”
হঠাৎ প্রার্থী প্রশ্ন করতেই আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “হ্যাঁ.. কেন বলুন তো?”
“না…,মানে…”
হঠাৎ ভেবলির কথার মাঝে মুঠোফোন বেজে উঠলো।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করতেই দেখি,স্ক্রিনে গান্ডু’র নাম।
ফোনটা ধরতেই অপর প্রান্তে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,”সার, আমি গান্ডু বলছি। ‘ও’…..মানে ভেবলি একটু আশীর্বাদ নিতে গেছে আপনার। একটু দেখবেন…”
“ভেবলি তোর কে হয়?”
“আমার বউ সার..!”
“ওকে আশীর্বাদ দিতে তুই বলছিস কেন? ও তো তোর পার্টির প্রার্থী নয়…”
“এটা সার একটা সেটিং।যে দলই হারুক বা জিতুক আগামী পাঁচ বছর আমাদের কামানোটা থাকবে,এটা নিশ্চিত সার…!”
“বাঃ…গান্ডু। তুইতো জনগণকে আচ্ছা ‘গান্ডু’ বানাচ্ছিস।”
“কি যে বলেন স্যার..! তবে একটা ছোট্ট কথা বলবো সার..?”
“বল…”
“এবার থেকে ছাত্র ছাত্রীদের বলবেন,মন দিয়ে অভিনয়টা শিখতে।চাকরি বাকরি তো পাবে না..”
“কেন..?”
“কামানোর সহজ পন্থা নেতাগিরি। আর নেতা হবার জন্য অভিনয়টা খুব জরুরী সার। আমাদের পাটিতে ঢোকার আগে এক মাসের ওয়াকশপে অভিনয়টা শেখানো হয় আগে।”
“তাই নাকি?”
“তাহলে কি আর বলছি সার..! তবে সার আমাদের কত্তা গিন্নির থিওরি হচ্ছে,যে দল হারবে সেই দলে আমরা থাকবো না।ক্ষমতা ছাড়া পয়সা নেই সার..!এখন রাখি সার..।বিকেল চারটে থেকে আবার খেলা শুরু।”
ফোনটা রেখে দিল গান্ডু।
বুঝলাম,জনতাকে বোকা বানানোর খেলাটা ভালোই শিখেছে গান্ডু। কার কাছে শিখেছে কে জানে…?
দিন সাতেক পর সকালে খবরের কাগজের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় চোখটা গেল আটকে।
“মস্তানগঞ্জের খাই খাই পার্টির প্রার্থী ‘কুমার ফালতু’ দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত..। ওই কেন্দ্রে প্রার্থী হলেন গান্ডু দালাল..”
মনটা খারাপ হয়ে গেল।এই খুনোখুনির রাজনীতি বাংলায় বেশ কয়েক বছর ভালোই আমদানী হয়েছে। কৌতূহলবশতঃ ফোন করে বসলাম গান্ডুকে।
“হ্যালো, গান্ডু…! শুনলাম কুমার ফালতু…”
“হ্যাঁ সার..! খবরটা শুনে কাল থেকে খাই নি।খারাপ লাগছে ফালতুদা খুন হলো বলে।তবে এর মাঝে একটা ভালো খবর,জয় আমার নিশ্চিত।ভেবলি ফালতুদা মরার আগের দিন পর্যন্ত এগিয়ে ছিল। কিন্তু দেখলাম,ওর পাটি ক্ষমতায় এবার আসছে না।তাই ফালতুদাকে মরতেই হতো..!”
“তার মানে ফালতু’র মৃত্যু প্ল্যান্টেড..!”
আমার কথা শুনে মিন মিন করে হায়নার হাসি হেসে বললো গান্ডু, “সহানুভূতির ভোট সার আমার পকেটে।এবার মন্ত্রী হবোই..! কেউ আটকাতে পারবে না। সার,এসব আপনার মাথায় ঢুকবে না , রেস্ট নিন….”
বুঝলাম,জনগণ আমার মতোই মাথামোটা…! জটিল অঙ্ক এদের মাথায় ঢুকবে না। তবে খারাপ লাগছে ফালতু’র জন্য।বেশ অভিনয় করে খাচ্ছিল,রাজনীতির জটিল অঙ্কে জীবনটা ফালতু দিলো…!!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।