তখনো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী র আবেশ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে। আজ সকালে আর প্রাতঃভ্রমনে বের হইনি। সেই ভোরেই ধুতিটাকে সুন্দর করে পড়ে সিল্কের ওড়নাটাকে গায়ে জড়িয়ে একটা থলিতে একটা তোয়ালে, পাজামা, একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর একশো টাকার একখানা নোট নিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে গুটি গুটি পায়ে পাড়ার পুষ্করিণীর দিকে পা বাড়ালাম। কাল রাতেই বাবা মায়ের সাত পুরুষের নামগুলো ভালভাবে দেখে রেখেছি। পুরুতঠাকুরকে বলে রেখেছি আমাকে কিন্তু একদম সাতসকালেই তর্পণটা করিয়ে দিতে হবে। কাজে কাজেই ——–
গিন্নিকে বলে গেলাম এখন আর চা খাবো না এক্কেবারে তর্পণটা সেরে এসেই আজ চা খেয়ে বাজারে যাবো।
ওই সক্কালবেলাতেই পুকুরের ঘাট মানুষে মানুষে ভরে গেছে। দশ বারোজন পুরোহিত আর এক একজন পুরোহিতের পেছনে লম্বা লাইন। ওই ভিড়ের মাঝখানে আমার পুরোহিতকে খুঁজে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা। অবশেষে যখন তাকে আবিষ্কার করলুম তখন বেচারা আমার দিকে যেভাবে চাইলো বুঝলুম ওর পেছনে লাইন দিয়ে থাকা লোকগুলোকে টপকে ও কিছুতেই আমায় আগে মন্তর পড়াতে পারবে না। কি আর করা অগত্যা, মনে মনে ভাবছি আমার খবরের কাগজের ভেন্ডারকে ডেকে পত্রিকাটা ওখানেই আনাবার ব্যবস্থা করা যায় কিভাবে এমন সময় হঠাত মুকুন্দ।
মুকুন্দর কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না, সেই যে সান্ধ্যবাজারে জল দেয় আর পাড়ার লাইব্রেরিতে বসে সব খবরের কাগজ ( বাংলা, ইংরিজী), সব সাপ্তাহিকী, মায় কর্মক্ষেত্রও মুখস্থ করে সেই মুকুন্দ, যার গালে ঘন কাঁচাপাকা চাপদাড়ি আর সারা মাথায় কুঁচকানো চুল, সেই মুকুন্দ, গায়ে একটা হতনোংরা বোতামহীন ফুলশার্ট আর পড়নে একটা তেলচিটে রঙ না বোঝা ফুলপ্যান্ট নারকেলের দড়ি দিয়ে কোমরের সাথে জড়ানো সেই মুকুন্দ, এসে পুকুরপাড়ে দাঁড়ালো। ব্যাস, পুণ্য করতে আসা মানুষগুলোর ভেতর ওর ছোঁয়াচ বাঁচানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আর কি কপাল আসবি তো আয় এক্কেবারে আমার কাছে। “‘ কি দাদাবাবু ? তর্পণ করতে এয়েচেন? ”
এই একজন পাগলকেই দেখলাম আমায় নাম না ধরে দাদাবাবু বলে সম্বোধন করলো। আসলে ওই যে ” রতনে রতন চেনে আর পাগল চেনে পাগলকে — ”
” হ্যা ভাই ” আমি উত্তর দিলাম,
” ওই পুরুতগুলোর কাচে? ”
কি যে বলি ঠিক বুঝে ওঠার আগেই ও বলে উঠলো ” উচ্চারণের মাতা মুন্ডু আচে ওদের? কোন ভাষায় মন্তর পড়েন সেটা জানেন ওনারা? ”
ওর সাথে এত কথা বলতে গেলে পাড়ার সবাই আমাকেও পাগল ঠাউরে না বসেন। আমি আমার পুরুতের দিকে তাকাতেই দেখি বিলকুল ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছেন, বুঝলুম মুকুন্দর ছোঁয়া এড়াতেই সবাই অন্যদিকে ভিড় জমিয়েছেন। মনে মনে আমি মুকুন্দকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমার পুরোহিতের দিকে। পুরোহিতের জিম্মায় হাতের থলিটিকে জমা রেখে জলে ডুব দিতে গেছি দেখি মুকুন্দও সটান জামা প্যান্ট পড়েই জলে নেমে গেলো। তিনডুব দিয়েই এসে সোজা আমার পুরোহিতের কাছে এসে হাত পেতে দাঁড়ালো ” একটু তিল যব আর ফুল দাও দেখি বামুনঠাকুর “।
পুরুত আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি ঘাড় নেড়ে দিতে বললাম। মুকুন্দ ওগুলো নিয়ে সোজা কোমরজলে গিয়ে পুবমুখো হয়ে দাঁড়ালো। হাত টাকে মুঠো করে সূর্যর দিকে তাকিয়ে বললো ” পেন্নাম নাওগো সূজ্জিঠাকুর, পেন্নাম মা বসুমতী, ” তারপর হাতদুটোকে জলে ডুবিয়ে অঞ্জলির মতো করে মেলে ধরলো ” বাবা তুমি আর আমার মা আর তোমাদের পূর্বপুরুষেরা একটু কাচে আসো গো। কিচুই তো আর কত্তে পারিনে এই একটু তিলজল দিলাম গোহন করো গো। আর আমায় এট্টু আশীব্বাদ করো আমি যেন এট্টু মানুষ হই বাবা। সবাইকে যেন এট্টু ভালোবাসতে পারি। ” বলে অনেক্ষন ধরে প্রনাম সেরে উঠে এলো, ওর দুচোখের কোনগুলো চিকচিক করছে। ও আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো ” আচ্ছা দাদাবাবু আমার বাবা মা কি আমার দেওয়া জল গোহন করলেন? ”
আমি কি উত্তর দেব? সারাটা ঘাটের মানুষ চুপ করে মুকুন্দর চলে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম।