সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড ( দশম পর্ব )

একটা ঝড় এসে যেন উড়িয়ে নিলো গায়ে ঢেকে রাখা কাঁথাটাকে। সাথে মেঘগর্জন।
–” কিরে? এইখানে কি চাই তোর? এইখানে আইয়া উঠসস ক্যান? তরে না কইয়া দিসিলাম পইপই কইর‍্যা যে রাত্তিরের বেলায় গুরুপদবাবার ঠেকে থাকবি। কতবার কইরা –”
ঘটনার আকস্মিকতায় আমায় যেন বোবায় ধরলো। একেই শীত, তার ওপর কাঁথার ওমে শরীরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছিল। এখন কাঁথা হীন অবস্থায় হঠাৎ হুহু করে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো। তার ওপর এমন অতর্কিতভাবে ধ্রুবদা এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যে আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোচ্ছে না, শুধু একটা অস্ফুট গোঙানির বেরিয়ে এলো।
–” কি রে? কথা কস না ক্যান? ”
— ” কি হয়েছে? এভাবে কেউ ঘুম ভাঙায়? ”
–” তাইলে ক্যামন কইর‍্যা ভাঙামু? কোলের উপরে মাথা নিয়া, চুলের ভিতরে বিলি কাইট্যা? তরে না বারবার কইর‍্যা কইয়া দিসিলাম? “
এতোক্ষণে ঠান্ডান্ডা যেন একটু ধাতস্থ হয়েছে। এতোক্ষণ ধরে তিলতিল করে কাঁথার ওমে গরম হয়ে ওঠা শরীর থেকে কেউ যদি, এক ঝটকায় কাঁথার ওমটাকে সরিয়ে দেয় তাহলে সত্যিই অবস্থা খুব গুরুচরণ হয়ে ওঠে। একই সাথে এটাও মাথায় এলো যে, ধ্রুবদার এই অতর্কিতে আক্রমনের উত্তরও বেশ কড়া করেই দিতে হবে। নইলে, আমি ওকে যতটুকু চিনি, এক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক না হয়ে যদি নিজেকে গুটিয়ে রাখি, তাহলে ধ্রুবদার এই মেজাজ আরও সপ্তমে চড়ে যাবে।
–” এটা কি একটা মানুষের কাজ হলো ধ্রুবদা? এভাবে কেউ কাউকে ঘুম থেকে তোলে? তুমি জানো, এভাবে ঘুম ভাঙানোর ফলে একটা মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারতো। স্ট্রোক, হার্ট এট্যাক –”
— ” ওই তুই থামবি? আগে আমারে ক, এইখানে রাইত কাটনের ব্যাপারে আমি তরে মানা করসিলাম কিনা? ”
–” আরে এ তো ভারী আশ্চর্য ব্যাপার! এখানে এসেছি তো কি হয়েছে? তুমি এসে থাকো না এখানে? সে বেলা কে তোমাকে বারণ করে শুনি? না কি তুমি সবকিছুর উর্ধ্বে? এভাবে চিৎকার করে নাকি কেউ? ওরা কি ভাবছেন বলো দেখি? নাকি ওদের কিছু ভাবতে নেই?”
এবারে ধ্রুবদা যেন সামান্য পিছিয়ে গেলেন। গলার স্বর সামান্য লঘু হলো। গলার ভেতর একটা ঘরঘরানির শব্দ উঠলো।
” তর কিছু একটা হইলে তর বাপমা কারে আইস্যা ধরবো শুনি? তারা কি কেউ এনাগো চেনেন? ”
–” অ, তারা বুঝি গুরুপদবাবারেও চেনেন? মাথাটাকে একটু পরিষ্কার করো। তোমার কি মনে হয় এনারা গরীব বলে এনাদের কোনওরকম মান সম্মান থাকতে নেই? ”
–” তুই কতোটুকু জানস? এগোরে তুই কতটুকু চেনস ক দেহি? এনারা অনেককিছু জানেন, করতে পারেন, বশীকরণ –”
ধ্রুবদার গলার থেকে এবার একটা হিসহিসানির আওয়াজ বেরোচ্ছে। আমি জানি ওর আসল ভয়টা কিসের, ওর সীমিত জ্ঞান এদের যাপনের মর্মার্থ বোঝে না। এদের প্রেমের গভীরতা বোঝে না। এদের প্রেমের অর্ঘ যে কোন গভীরে গিয়ে পুজার ফুল হয়ে ওঠে সে সম্পর্কে ধ্রুবদার কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। ‘
–” বাইরে আয়, কথা আসে –”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। কটা বাজে কে জানে? কে ওকে দরজা খুলে দিলো? না কি দরজা বন্ধ করার কোনও রীতি এখানে এই প্রেমের রাজ্যে চালু নেই?
— ” ভীষণ ঘুম পেয়েছে। একটু ঘুমুতে দাও তো প্লিজ, নাও আমার পাশে ওমুখ ফিরে শুয়ে পড়ো। ভোর হতে দাও। ”
–” কখন আবার ভোর হইবো? অহনে কয়টা বাজে জানস? ”
–” না, আর জানার কোনও ইচ্ছাও নেই। তুমি কি শোবে, নাহলে আমায় এখন আর বিরক্ত কোরো না প্লিজ। ”
বলে গায়ের ওপর কাঁথাটা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোর রাতে একবার ঘুম ভেঙে গেলে সে ঘুম আর আসতে চায় না। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার কাঁথায় টান পড়লো। ধ্রুবদা এসে আমার কাঁথায় ভাগ বসালেন। একটু পরেই ধ্রুবদার নাকের থেকে জাহাজের ভোঁ দেওয়া শুরু হয়ে গেলো।
ছুটকির ডাকে ঘুম ভাঙলো। হাতে একটা কলাই করা থালায় একটা এনামেলের গ্লাসের থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আর প্লেটের ভেতর দুটো লিট্টির সাইজের বিস্কুট।
ধ্রুবদা তখনও নাক ডেকে চলেছেন।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।