গল্পবাজে পাভেল ঘোষ

ফুচকা “ভটাম” থান্ডার


কদিন ধরেই মনটা বড় বিমর্ষ লাগছে।একটার পর একটা তারা খসে পড়তে দেখছি চোখের সামনে।সব রংই আঁধারে কালো হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ।
“যদি সব পাখি ফিরে আসে নীড়ে,মূক হয় ঝড়।
তোমার কাছে যত পাওয়ার ছিল,যত চাওয়া ছিল
সব কেড়ে নেয় নগ্ন রাতের আকাশ….!”
মন খারাপ করাটা হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে গেলো চেনা কণ্ঠে।আহা..কি শব্দ চয়ন..!
“আরে…দেখে যাও, ভটামদাকে..টিভির পর্দায়..!”
গিন্নির কথায় পড়িমরি করে ডাইনিং রুমে ছুটলাম।
“বলো কি? ভটামদা আবৃত্তি করছে..?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
“আবৃত্তি নয়,স্বরচিত কবিতা পাঠ করছে..!”
গিন্নি বলতেই আকাশ থেকে পড়লাম।
ভটামদা আবার কবি কবে থেকে হলো? টিভির পর্দায় চোখ যেতেই স্থবির হয়ে গেলাম স্ট্যাচুর মতো।
“আমাদের স্টুডিওতে উপস্থিত হয়েছেন এবারের ‘গতর মিত্র স্মৃতি পুরস্কার’ বিজয়ী কবি ‘ফুচকা থান্ডার’…”
সঞ্চালকের কথা শেষ হতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ভটামদার মুখ।গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম,’এ আমি ঠিক দেখছি তো..?’
তলে তলে ভটামদা নিজেকে সযতনে এই জায়গায় নিয়ে গেছে? কিভাবে সম্ভব হলো এটা?
জানতে হলে তো একটা ফোন করতেই হয় ভটামদাকে…!
“হ্যালো… ভটামদা…মাস্টার বলছি…”
“কে বলছেন? আমি ওনার পি এ সুজাতা বলছি..! উনি এখন একটু ব্যস্ত আছেন। কিছু বলতে হবে..?” অপর প্রান্তে এক মহিলার কণ্ঠ..!
“বলুন, ভট… সরি ফুচকাবাবুর বন্ধু মাস্টার বলছি..”
“হোল্ড করুন,জিজ্ঞাসা করে উত্তর দিচ্ছি…”
শুনে মাথা ঘুরছে আমার।সোফায় বসে পড়লাম।ডান কানে ফোন ধরে নীরবতায় কাটলো মিনিট দুয়েক।
কিছুক্ষন পর মহিলা কণ্ঠে উত্তর এলো,
“স্যার, উনি এখন ফোন ধরতে পারবেন না।ওনার সঙ্গে কথা বলতে গেলে রাত ন’টার পর ফোন করুন…! উনি এখন লেখায় মগ্ন আছেন…”

রাত ন’টা নাগাদ ফোনটা ভটামদার কাছ থেকেই এলো।
“হ্যালো, মাস্টার…! তোমার ভটামদা বলছি..। সুজাতার মুখে শুনলাম তুমি ফোন করেছিলে..!কারণটা জানতে পারি কি?”
আহা কি মোলায়েম কণ্ঠস্বর..! মনে হলো গলায় কেউ মধু ঢেলে দিয়েছে।
“ব..লুন ভ…টামদা..”আমি তোতলাতে লাগলাম।
“কণ্ঠের মাধুর্যে অবাক হয়েছো.! বুঝেছি,মাস্টার।আসলে কবি হতে গেলে এটুকু করতেই হয়…”
“না ,না দাদা..” এবার ভটাম শব্দটা ভিতর থেকে কেউ যেন আটকে দিলো।
“এবার থেকে দাদা বলাটাই প্র্যাক্টিস করো মাস্টার..বুঝতেই পারছো..”
“বুঝেছি ভ..না..মানে দাদা..!”
“তবে জানো,মাস্টার,তোমাদের পুলিশ বৌদি খুউব জব্দ হয়েছে।এতদিন আমাকে বলতো সবাই ‘পুলিশের স্বামী’..এখন ওকেই সবাই বলছে ‘কবি পত্নী’..”
“না,দাদা বৌদিতো এতে খুশীই হয়েছে ..”
“কি যে বলো…! তুমি তো সব ঘটনার সাক্ষী। খালি বলে,’তুমি নর্দমা আর আমি হলাম ঝাড়ুদার।পরিষ্কার সারা জীবন করে যাবো।”
“এখনো বলে দাদা…?”
“কালই বলছিলো..তাহলে আর বলছি কি…!”
“ও এমনি ইয়ার্কি করছিল দাদা…”
“না,ভাই..আজ সকালেই বলছে কাকে যেন ফোন করে..!আমি চুপি চুপি শুনে ফেলেছি..”
“কি শুনলেন..?”
“ওর কবিত্ব যদি আমি না ঘুচিয়েছি..তাহলে আমার নাম করুণা নয়..! মাস্টার ,তুমি যেন বলো না।আসলে আমরা কবি তো..! অতশত কান দিতে নেই..রাখছি ভাই,এক কবি বন্ধু ফোন করছে..”
ফোনটা কেটে গেল।কানটা ভোঁ ভোঁ করছে। ভটামদা কবি..! মানতে কষ্ট হচ্ছে। হিংসায় নয়, অনুভবে।কি জানি..! আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। নিশ্চয়ই কোথাও একটা গোলমাল আছে।

পরের দিন সকালে কবিপত্নীর আমন্ত্রণে যেতেই হলো। ছেলেবেলা থেকেই পুলিশকে ভয় লাগতো।বড় হয়েও সেটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
ভটামদা কোথায়? জিজ্ঞাসা করতেই পুলিশবৌদি বলে উঠলেন,”কবিবর নেই বলেই তোমায় ডেকেছি ভাই..। উনি কবি সম্মেলনে যোগ দিতে রানাঘাট গেছেন।আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে।”
“ও…! তা আমাকে ডাকার হেতু জানতে পারি?”
“আমি নয়,হেতু বলবে টলানন্দ। আমার আদরের টল।”
বৌদি বলতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা।
“টলানন্দ… মহিলার বেশে..!” বিস্ময়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কথাটা।
“আরে এই হলো কবির ‘পি.এ সুজাতা’। আইডিয়া টা আমার।অনেক কষ্টে ওনাকে রাজী করিয়েছি।বেশ ‘ঝুকুমুকু’ দেখতে বলে মেয়ের বেশে ভালোই মানিয়েছে। কি বলুন ভাই..?” পুলিশ বৌদি মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে।
“সত্যি দারুন মানিয়েছে..” আমিও হেসে উত্তর দিলাম।
“ক’মাস ধরে এই বেশেই আপনাদের কবিবরের কবিতা লেখার রহস্যটা ওই উদ্ঘাটন করেছে। এই দেখুন….”
বলেই বৌদি বের করলেন পুরানো, ফিকে হয়ে যাওয়া শতছিন্ন একটা বই। অস্পষ্ট কালিতে লেখা “কবিতামালা”। নীচে ছোট অক্ষরে কবির নামও নজর এড়ালো না। “দয়াময় দলুই”।
“এই বই আপনি কোথায় যোগাড় করলেন বৌদি?”
“এটা টলানন্দের সূক্ষ হাতের কাজ। বুঝলেন ভাই?”
“কিন্তু মহিলার বেশে টলানন্দের সঙ্গে পুরোনো বইয়ের কি সম্পর্ক…সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না আমার..!”
“শুনুন তাহলে..
আপনাদের ভটামদার কবি হওয়াটাও আমার মাথাতেও কিছুতেই ঢুকছিলো না জানেন ভাই..!বিয়ে হওয়া থেকে দেখছি, সকালে শুধু খবরের কাগজটা যত্ন করে পড়েন। কিন্তু ক’মাস ধরেই লক্ষ করছি,রাত জেগে দুনিয়ার বইপত্র সাজিয়ে উনি কিসব লেখালেখি করছেন..!”
“করতেই পারেন বৌদি..!এতে দোষটা কোথায় দেখলেন?”
“শুনুন ভাই..যে মানুষটা রাতে মদ মেরে প্রতিদিন হিন্দি গান শুনতো, সে হঠাৎ রাত জেগে লিখতে শুরু করলে বুঝতে হবে,এর পিছনে গূঢ় রহস্য আছে..!যতই হোক পুলিশের মন তো।”
“আর সেজন্যই টলানন্দকে ভটামদার পিছনে লাগিয়ে দিলেন..!” আমি মুচকি হেসে বললাম।
“একদম ঠিক ধরেছেন..। এবার টলের মুখে শুনুন ভটামবাবুর কীর্তি।”
আমি টলের দিকে তাকাতেই ওর বলা শুরু হলো..
“স্যার, আমি কলেজ স্ট্রিটে সুজাতার বেশে ভটাম বাবুর পাশে থেকে দেখেছি,উনি শুধু পুরোনো পত্র-পত্রিকা,বই কেনেন..! ম্যাডামের কথামতো উনি যে বইই কেনেন,আমি আর একটা কপি সংগ্রহ করি..।”
“তারপর…?” চোখের পলক পড়ছে না আমার।
“সুজাতা….সরি টল, এবার আমি বলি..থামো।”
বলেই পুলিশ বৌদি ‘দয়াময় দলুই’-এর প্রাচীন কবিতার বইটির পাশে ভটামদার সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটা বই রাখলেন।
“দেখুন ভাই…এবার বুঝবেন কেন টলানন্দ মহিলার বেশে..!”
বৌদির কথা শুনে বই দুটোর উপর আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম।মিনিট দশেক উল্টেপাল্টে বুঝলাম,কি সুন্দর সূক্ষ কেরামতিতে কপি করেছেন কবি ভটাম..! দয়াময়বাবুর বিভিন্ন কবিতার লাইন নিজের কবিতায় এমন সুন্দর জুড়েছেন,যে বোঝা সত্যিই দায়।আর ষাটের দশকের কবির কবিতা কে মিলিয়ে দেখবে? কার এত সময় আছে?
“কি বুঝছেন মাস্টারভাই? এমন অনেক প্রমান আমার কাছে আছে…।”
বৌদির কথা কানে যেতেই বই থেকে মুখটা তুললাম।
“কিন্তু এতো অন্যায়..! এর বিহিত হওয়া উচিত।”
বেশ রাগত স্বরেই বলে বসলাম পুলিশবৌদিকে।
“বিহিত তো হবেই…।আগে আগে দেখুন,হোতা হ্যায় কেয়া..?”
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়লাম। মাথা ঝিম ঝিম করছে ভটামদার কারবার দেখে..। কবি,ছবি…সবেতেই চুরি..!শালা,দেশটা রসাতলে গেল।

আজ সকাল থেকেই পাকস্থলী বিদ্রোহ করছে।
শালার বিয়ে দিয়ে দিন চারেক পরে বাড়ি ফিরেছি কাল রাতে।তাই ভটামদার কেসটা মাথা থেকে আউট হয়ে গিয়েছিল।
এক কাপ চা হাতে খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি,তৃতীয় পৃষ্ঠায় জেলার পাতায় চোখটা গেলো স্থির হয়ে।
“বিশিষ্ট কবি ফুচকা থান্ডার অপহৃত”। বিস্কুটের গুঁড়ো গলায় আটকে গেলো।
“কি হলো..? কে আবার মনে করছে দেখো.!”
ভাইয়ের বিয়েতে দিন চারেক ধরে সাঁটিয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে আছে বুঝতে পারলাম।সামান্য কারনে এমনভাবে ছুটে আসা,আগে কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।
“খবরটা পড়ো তো.…” আমি তৃতীয় পৃষ্টাটা এগিয়ে দিলাম।
গিন্নি পড়তে শুরু করলো এক নিঃশ্বাসে…”গত বৃহস্পতিবার রাত ন’টা নাগাদ বিশিষ্ট কবি ফুচকা থান্ডার নিজ বাসভবনে ফেরার পথে অপহৃত হয়েছেন।অপহরকারীরা কবিবরকে চারদিন সময় দিয়েছেন।ওদের অদ্ভুত দাবী,’এই সময়কালের মধ্যে ফুচকাবাবুকে একটি কবিতা লিখে পাঠ করতে হবে’। ওনার এই স্বরচিত কবিতা পাঠের ভিডিওটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। তারপরেই কবির মুক্তি। বাংলা সাহিত্যকে বাঁচানোর জন্যই নাকি তাদের এই অপহরণ কান্ড..! সিংহভাগ বুদ্ধিজীবী এই কাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছেন।তাঁরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন,’অবিলম্বে ফুচকাবাবুকে উদ্ধার করা না হলে তারা আজীবন বিরিয়ানি খেয়ে কাটাবেন’।সাহিত্য অনুরাগীরা অবশ্য আশাবাদী,’কবি হাসিমুখে এই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসবেন।’ বর্ধমান থানার ওসি মাননীয়..”
“থামো….জমেছে…! আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া..?”
“ভটামদার জীবন সংশয়…আর তুমি ফুর্তি করছো..?”
“আরে,কিডন্যাপাররা তো ভটামদার জীবন নেওয়ার কথা বলে নি। কবিতা লিখলেই ওরা ভটামদাকে ছেড়ে দেবে বলেছে…!আর কবিতা লেখা ভটামদার কাছে জলভাত। তাই না?”
“তা..ঠিক ! তাহলে,আজ রাত ন’টায় তোমার ভটামদার সময়সীমা শেষ হচ্ছে…..”
“একদম…একটু চা করো তো।পেটটা আবার গুরগুর করছে…”
একগাল হেসে আমি বলতেই গিন্নি ছুটলো রান্নাঘরে।

রাত্রে খেয়েদেয়ে গুছিয়ে টিভির সামনে বসেছি, হঠাৎ মুঠোফোনের স্ক্রিনে পুলিশ বৌদির নম্বরটা ভেসে উঠলো…। ধরতেই অপর প্রান্তে বৌদির মোলায়েম কণ্ঠ শুনতে পেলাম..
“হ্যালো, মাস্টারভাই,স্থানীয় টিভি চ্যানেলটা খুলুন আর বিশিষ্ট কবি ফুচকা থান্ডারের কবিতা শুনুন….! যাক,ও মুক্তি পেয়েছে; এতেই আমি খুশী..!”
বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি।
বৌদির কথামতো টিভিতে স্থানীয় চ্যানেল খুলতেই চমকে উঠলাম।
গোটা স্ক্রিন জুড়ে ভটামদার বিমর্ষ মুখ।নেপথ্যে সংবাদ পাঠকের কণ্ঠ….
“আজ মুক্তি পেলেন বিশিষ্ট কবি ফুচকা থান্ডার। ওনার স্বরচিত কবিতা পাঠের ভিডিও প্রকাশ হতেই অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।শুনুন কবি কণ্ঠে স্বরচিত কবিতাটি…।”
ভটামদার ভিডিও চালু হতেই আমি হাঁ করে গিলতে লাগলাম…
কবিতা- “বুকের কোনে”
এই শহরে যদি,
থাকেন কোন কবি।
আসতে পারেন সরল মনে,
জায়গা দেবো বুকের কোনে।
ভুলে ভরা কবিতা আমার,
ভুলেই পড়ে রয়।
সংশোধনের জায়গা পেলে,
খুব উপকার হয়।
কবিতা লেখার ইচ্ছা ছিল,
অনেক দিনের আগের।
হঠাৎ করেই কারুকার্য
ফুটে উঠল মনের।
নমস্কার।
কবিতা শেষ হতেই লাভা উদগীরণের মতো বেরিয়ে এলো আমার এতক্ষণের চাপা হাসি। পেট ব্যথা হয়ে গেল হাসতে হাসতে। ওঃ… আচ্ছা জব্দ হয়েছে ফুচকা কবি। কিন্তু কিডন্যাপ কারা করলো..? জানতেই হচ্ছে।

পরের দিন কুয়াশা মাখা সকাল উপেক্ষা করে বাজার গেছি। পিছন থেকে একটা চেনা কণ্ঠের আওয়াজ কানে এলো। পিছন ফিরে দেখি পুলিশবৌদি।
“ও মাস্টারভাই, কবিতা শুনলেন ?”
আমি মাথা নাড়তেই উনি মুচকি হেসে বলে চললেন.…
“আচ্ছা বাওয়াল হয়েছে ভাই..! আপনাদের ভটাম দার তো সব জারিজুরি ফাঁস। গতরবাবুর ছেলে কালই পুরস্কার উইথড্র করেছেন। চারিদিকে তো নিন্দার বন্যা বইছে….”
“সেতো হবেই বৌদি….” আমি আমতা আমতা করে বলতেই উনি মজা করেবলে চললেন,
“থান্ডার ফুচকা/দূর যা,দূর যা/রোদের হানা/আমি যাই থানা….!’ কি মিল পাচ্ছেন কারো সঙ্গে..?”
বুঝতে পারলাম,ওনার ঘাড়ে কোনো “কবি পেত্নী” ভর করেছে…!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।