সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড ( একাদশ পর্ব) 

আমরা যখন গুরুপদবাবার আশ্রমে গিয়ে উঠলাম, ততোক্ষণে ভোর পেরিয়ে সকাল হয়ে গেছে। ধাক্কা মেরে মেরে ধ্রুবদাকে যখন তুলতে পারলাম, ধ্রুবদার দু’চোখ তখন জবা ফুলের মতো লাল হয়ে রয়েছে। একে রাত জাগার ধকল, তার ওপরে শেষ কার্তিকের আলগা ঠান্ডায় মনে হয় এরকমটা হয়েছে। চোখেমুখে জল দিয়ে ফের একদফা চা খেয়ে আমরা রওনা হলাম। কানাইদা জানালেন, তিনি পেছনেই আসছেন।
কানাইদার মুখে কি বাদলের মেঘ দেখলাম? বাউলনির সাথে তো দেখা হলো না একবারও। হয়তো ভোরবেলা মাধুকরীতে বেরিয়েছে।
কাল ভোররাতে ধ্রুবদার ব্যবহারে নিশ্চয়ই ওরা ব্যথা পেয়েছেন। ভদ্রলোক যেমন স্নেহপ্রবণ, তেমনি গোঁয়ারগোবিন্দ। হয়তো কথাগুলো বলা উচিত হবে কি হবে না, সেসব না ভেবেই বলে ফেলেছেন। কিছুটা হয়তো দাদাগিরি দেখানোর জন্যও হতে পারে। কিন্তু সেসব কথায় কানাইদা বা কৃষ্ণভামা মনে দুঃখ পেতে পারেন, সেটা ওর মাথাতেই আসেনি।
–” তোমায় যে টাকা দিয়ে এলাম ট্রেনে টিকিট কেটে আসার জন্য, তুমি টিকিট কাটলে না কেন? ”
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পথে নেমেই, ধ্রুবদা আমাকে ফের ধমকানো শুরু করার আগেই আমি কায়দা করে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম।
–” তরে কেডা কইলো, আমি টিকিট কাটি নাই? ফাইজলামি মারো, না? ”
–” তুমি টিকিট কেটেছিলে? কানাইদা তাহলে ভুল বললেন, যে টিকিট কেটে না ওঠায় তোমাকে চেকার ধরেছিলো? ”
–” এই একডা লোক, চোক্ষের আড়ালে কিচ্ছুডি হওনের উপায় নাই। হেই ঘটনার পর থিক্যা সারাটাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে রইলো। পুরা চোখে চোখে রাইখ্যা নিয়া আইলো। ”
— ” আর সেই লোকটাকেই তুমি অপমান করলে?”
–” অপমান করলাম? আমি? কানাইদারে? ”
–” করলে না? এই যে এসেই আমাকে ধমকানো শুরু করলে আমি এখানে রাত কাটালাম বলে? ”
–” ধমকামু না? তুই কতটুকু জানোস ওগো সম্পর্কে? আমার থিক্যাও বেশী জানোস? অরা আর কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু বোঝে না। শুধু ভালোবাসতে জানে। পাঁকাল মাছের মতোন মনের ঘরে ঢুইক্যা প্রেমে পাগল কইর‍্যা দিতে জানে। এইতে অগো কোনো দোষ নাই, কিন্তু যারে একবার পেচাইবো তার আর নিস্কৃতি নাই। একদম নিশ্চিতভাবে প্রেমে পাগল হইয়া ঘরবাড়ি ছাইড়্যা অগো পিছন পিছন ঘুইরা বেড়াইবো। বুজছস? “
দাদুর ঠেকে যখন গিয়ে পৌঁছুলাম ততক্ষণে দাদুর স্নান শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যেই বেশকিছু মানুষও জুটে গেছে। বেশ কর্মব্যস্ততা। একজন একটা লোহার শলাকা নিয়ে মন দিয়ে একটা কল্কে সাফ করছেন। একজন একটা কাঠের টুকরোয় বাটালির মতো একটা কাটনি দিয়ে একদলা গাঁজাকে কুচি কুচি করে কাটছেন, একজন বেশকিছু সাফিকে ধুয়ে বাঁশের খুটির গায়ে লেপ্টে রাখছেন, একজন কিছুটা নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বলের মতো করে গোল্লা বানাচ্ছেন। ঠিক এই সময়েই একটা থালার ভেতর আট-দশ গ্লাস চা নিয়ে আশ্রমের সামনের চায়ের দোকানের ভদ্রলোক ( নামটা যেন কী ? ) এসে হাজির।
প্রায় সবাইকেই আমার পরিচিত মনে হলো। শুধু দু’জন মানুষ ছাড়া। একজন গৌরবর্ণ দীর্ঘদেহী, মুন্ডিত মস্তক। সারা মুখে উজ্জ্বল হয়ে আছে একজোড়া সাদা গোঁফ। থুতনি ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা গিয়ে পথ হারিয়েছে, আর একজন খর্বাকৃতি। মাথার ওপর দীর্ঘ জটা চূড়ো করে বাঁধা। প্রথম জন বেশ বৃদ্ধ। তুলনায় দ্বিতীয় জন কমবয়স্ক। দুজনেরই পরিধানে রক্তাম্বর। শ্মশ্রুতে গঞ্জিকা সেবনের চিহ্ন হিসেবে বিচিত্র বর্ণের সমাহার। সাদা, বাদামী, ঈষৎ পিঙ্গলাভ, সব রঙের মিশেলে বেশ চিত্তাকর্ষক।
ধ্রুবদা ওদের দেখামাত্রই ধপ করে প্রণাম করলেন। একমুখ বিগলিত হাসি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — ” কবে আইলেন মহারাজ? ”
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, ধ্রুবদা দু’জনকেই প্রণাম করলেও অপেক্ষাকৃত নবীন সাধুটিকেই যেন বেশী ভক্তি দেখালেন।
–” কি রে? খাড়াইয়া আছোস ক্যান? প্রণাম কর।”
ধ্রুবদা প্রণাম করতে বলায়, ইচ্ছা অনিচ্ছা মিশিয়ে অগত্যা প্রণাম করলাম।
— ” আমার ভাই। মানে আরকি ভাইয়ের মতোনই, আপন ভাইয়েরই মতোনই, খুব ভালো পোলা মহারাজ। ”
–” নাম কী তোমার, বাবা? ”
আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই গৌরবর্ণ মানুষটি পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন। গায়ের রঙ আর শারীরিক উচ্চতা দেখে আমি ওনাকে অবাঙালিই ঠাউরেছিলাম।
–” প্রদীপ। প্রদীপ গুপ্ত। ”
–” হরিৎবর্ণ ফসল। পাকলে স্বর্ণরঙা হবে। তা ধ্রুববাবু আপনাকে আমি বহুবার বলেছি, যে গুরুদেবের সামনে আপনি আমায় প্রণাম করবেন না। এটা নিশ্চয়ই আপনার অন্তস্থিত ভক্তির বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু এতে করে গুরুদেবকে অসম্মানিত করা হয়। ”
গুরুদেব? ওই খর্বকায় মানুষটি এনার গুরুদেব? তখনও কি জানি যে আমার অবাক হওয়ার এখনও অনেকটাই বাকী রয়ে গেছে?

 চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।