প্রবন্ধে প্রভাত মণ্ডল

বন্ধুত্বের সাতকাহন

√বন্ধ্ + উ = বন্ধু । পৃথিবীর অনন্ত শাশ্বত একটি শব্দ এই ” বন্ধু ” । শব্দটির উৎপত্তি বিচারে ” বন্ধন ” শব্দটির প্রাধান্যও যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয় । ” বন্ধু ” শব্দটির আভিধানিক অর্থ সখা , স্বজন , প্রিয়জন , সুহৃদ , মিত্র , প্রণয়ী অর্থাৎ কল‍্যাণকামী ব‍্যক্তি । আবার ” বন্ধুত্ব ” শব্দটির আভিধানিক অর্থ সৌহার্দ্য , সখ্য , মৈত্রী ও বন্ধুতা । বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে বিখ্যাত ব‍্যক্তিত্বগন তাদের নিজ নিজ মতামত প্রদান করে গেছেন । হেলেন কেলার
বলেছিলেন ” একাকী আলোয় হাঁটার চেয়ে একজন বন্ধুর সাথে অন্ধকারে হাঁটা উত্তম ।” এ কথার প্রত‍্যুত্তরে আবার গুরুদেবের লেখার কথাও বলা চলে ” যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে ।” অর্থাৎ সঠিক মনোপ্লুত মনের মানুষ না পেলে নিজের ছায়াকেই বন্ধু হিসাবে নির্বাচন করে জীবন পথে চলা যেতে পারে । তবে নিজের সাথেই নিজের এই বন্ধুত্বটা করে জীবন অতিবাহিত করা — মানসিক ক্ষমতা অতি উচ্চ পর্যায়ে না হলে অসম্ভব । তাই সমাজ জীবনে বাঁচতে গেলে কারো না কারো সাথে বন্ধুত্ব করাটা খুবই প্রয়োজনীয় । একা একা মানুষ কখনো সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারে না ।
আবার জনপ্রিয় গায়ক অঞ্জন দত্তের গাওয়া সেই গান – ” বন্ধুত্বের হয়না পদবী / বন্ধু তুমি কেঁদো না / বন্ধু সবুজ চিরদিন / বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে না । ” এ গানের যেন কোনো তুলনা হয় না ।
তবে সময় বদলেছে , বদলেছে মানুষের জীবন ধারণের পদ্ধতি , সাথে সাথে বদলেছে বন্ধুত্বের সংঞ্জা ও প্রকারভেদ । তবুও বন্ধুত্বের সংঞ্জা নির্ধারণে বলা যেতে পারে , বয়সের সীমারেখাকে তুচ্ছ করে প্রাণের সাথে প্রাণের এক অপ্রতিরোধ‍্য আকর্ষণ , যেখানে কখনো স্বার্থ , পদমর্যাদা , জাতি-সমাজ-ধর্ম , অর্থবান ও দারিদ্র্যের তুল‍্য মূল্য বিচারের মাপকাঠি মনে আসে না , একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা যেমন থাকে তেমনি থাকে খুনসুটি , মনের প্রতিটি আবেগ , যাবতীয় কষ্ট ও আবদার যার কাছে অনায়াসে বলে ফেলা যায় , তাকেই মোটামুটি ভাবে বন্ধুত্ব হিসাবে সংঞ্জায়িত করা চলে ।
বন্ধুত্ব এমনই , যা কখনো বলে হয় না , আবার আচার-আনুষ্ঠানিক কোনো ক্রিয়া কর্ম করেও গড়ে তোলা যায় না । সম্পর্কের অদৃশ্য বাঁধন , একে অপরের প্রতি আত্মার টান , মতের মিল থেকেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ।
জন্ম পরবর্তী সময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় শিশুর মায়ের কোল ও পরিবারই তার প্রকৃত বন্ধু । এখানেই সে তার যাবতীয় মনের অভিব‍্যাক্তি প্রকাশ করে । ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে দৈহিক, মানসিক , বৌদ্ধিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশ ঘটতে থাকে । পরিবারের গন্ডি পেরিয়ে তার খেলার সাথী বৃদ্ধি পায় । এই সময় কালে শিশুরা নিজেদের মন মানসিকতা অনুযায়ীএকে অপরের প্রতি একটা দুর্বোধ্য টান অনুভব করে থাকে ।
তবে মানব জীবনে বন্ধুত্বের পর্যায় নির্ধারণে আমরা দুটি বিশেষ ভাগ লক্ষ‍্য করতে পারি —
এক , স্কুল জীবনে গড়ে ওঠা বন্ধু , এবং
দুই , স্কুল জীবনের পরবর্তী পর্যায়ের গড়ে ওঠা বন্ধু ।
স্কুল জীবনে যাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের মধ‍্যে একতা বিশেষ ভাবে লক্ষ‍্য করা যায় । যার প্রভাব শিশুর পরবর্তী জীবন গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে । কখনো বন্ধুদের পায়ে পা রেখে ভালো পথে চালিত হয়ে শিশু আগামীতে আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে ওঠে , আবার কখনো কখনো খারাপ সঙ্গ গ্ৰহণ করার ফলে এই বন্ধুত্বই সমাজের পক্ষে হয়ে ওঠে ক্ষতিকারক । তাই স্কুল জীবনের বন্ধুত্ব যে কোনো শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ । এই পর্যায়ের বন্ধুত্বে স্বার্থান্বেষী মনোভাব তেমন একটা চোখে পড়ে না । একে অপরের প্রতি প্রয়োজনে নয় , মনের অদৃশ্য টান থেকেই এই বন্ধুত্বের সৃষ্টি । সময়ে অসময়ে , কারণে অকারণে নিজেদের মধ‍্যে মনোমালিন্য , ঝগড়া এসব হলেও তার প্রভাব খুব বেশি সময় থাকে না । এই বন্ধুত্ব জীবনের শেষ দিন অবধি বজায় থাকে । বয়স বাড়লে জীবিকার তাগিদে সকলেই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকলেও দূরত্ব এই বন্ধুত্বে কখনো ব‍্যবধান আনে না বরং মনের টান আরো গভীর থেকে গভীরতর হয় । তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কুল জীবনের বন্ধুত্বে একবার ফাটল ধরলে তা চিরতরে বন্ধুত্ব নামক স্থান পরিত‍্যাগ করে থাকে ।
স্কুলের সীমারেখা পার করে পরবর্তী পর্যায়ে আর এক প্রকার বন্ধুত্ব চোখে পড়ে । সেটা কলেজ জীবন কিংবা কর্মক্ষেত্রে । এই পর্যায়ে মনের টান যতটা থাকে তদোপেক্ষা আধিক থাকে প্রয়োজন । স্বার্থপরতা এখানে একটা বড়ো অংশে পরিলক্ষিত হয় । আবার এই সময়ের বন্ধুত্বে অনেক ক্ষেত্রে মনের এমন আকর্ষণ জন্মায় যা শৈশব কালের বন্ধু অপেক্ষা অধিকতর ।
একটি আদর্শ বন্ধুত্বের বেশ কতগুলি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বার মতো —
প্রথমত , বন্ধু হবার জন‍্য কোনো বয়স কিংবা যোগ‍্যতা নয় বরং মনের সাথে মনের মিল ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভাবের আদান প্রদানই যথেষ্ট । অর্থাৎ প্রকৃত বন্ধুরা নিজেদের মধ‍্যে ভালো-মন্দ সকল বিষয়ই প্রণোচ্ছল ভাবে বিনিময় করে থাকেন ।
দ্বিতীয়ত , প্রকৃত বন্ধুত্বে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস থাকাটা খুবই জরুরী । বিশ্বাস থেকে আসে ভালোবাসা বোধ , তাই বন্ধুত্বে বিশ্বাসভঙ্গতা কখনোই কাম‍্য নয় ।
তৃতীয়ত , প্রকৃত বন্ধুত্বে হাসি-মজার পাশাপাশি উভয়ের প্রতি উভয়ের সম্মান বা শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন । কারণ প্রকৃত বন্ধু কখনোই অপর কোনো ব‍্যক্তির সামনে বন্ধুর অপমান চাইবে না ।
চতুর্থত , শুধুমাত্র সুখের সময়ে নয় , বিপদের সময় পাশে থাকাই একজন আদর্শ বন্ধুর বৈশিষ্ট্য । নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য , উন্নতির পাশাপাশি প্রকৃত বন্ধু তার বন্ধুর উন্নতির জন‍্যও এগিয়ে আসেন । কখনো বন্ধুর উন্নতিকে হিংসার চোখে দেখেন না ।
পঞ্চমত , ভালো বক্তার পাশাপাশি একজন ভালো শ্রোতা হওয়াও প্রয়োজন । প্রকৃত বন্ধু শুধুমাত্র নিজের কথাই বলে থাকেন না , বন্ধুর বলা কথাও মন দিয়ে শুনে থাকেন , গুরুত্ব দিয়ে থাকেন । বন্ধুর বলা কথাকে উপহাস নয় বরং সমস‍্যা গুলো মন দিয়ে শুনে তার সমাধানের চেষ্টা করে থাকেন ।
ষষ্টত , প্রকৃত বন্ধু তার বন্ধুর কোনো ভুল কাজকে অবশ‍্যই বুঝিয়ে বলবেন , খারাপ পথে যাওয়া থেকে বিরত করবেন ।
সপ্তমত , বন্ধুত্ব মানে শুধু হাসি মজাই নয় , বরং সমাজ পরিবেশের দূরাবস্থা নিয়ে আলোচনা করা , সমাজের মঙ্গল হতে পারে এমন কাজে অগ্ৰসর হওয়া ও অন‍্যকে উদবুদ্ধ করাও প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয় বহন করে । কারণ এসব কাজে অর্থ উপার্জন না হতে পারে , কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতিসাধন ঘটে থাকে । মানুষের মধ‍্যে মানবিকতা বোধের সঞ্চার হয় ।
অনেক ক্ষেত্রে সমবয়সের পাশাপাশি বয়োঃজ‍্যেষ্ঠ দের সাথেও বন্ধুত্ব ঘটে থাকে । এক্ষেত্রে কম বয়সী ব‍্যক্তির মানসিক , সামাজিক উন্নতি অনেকটাই বৃদ্ধি পায় । শিক্ষা হোক কিংবা সমাজ উভয় দিক সম্পর্কে ঞ্জানের বৃদ্ধি ঘটে । আবার পেশাগত দিক দিয়ে ভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব‍্যাক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে সেই বিষয়ে আলোচনার মাধ‍্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের ঞ্জান লাভ হয় । যা জীবন ধারণের প্রয়োজনে যে কোনো সময় কাজে লেগে যায় ।
বন্ধুত্ব সময় অনুসারী তবে তা শৈশব কালের বন্ধুত্বে নয় । জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব‍্যাক্তির সাথে বন্ধুত্ব হলেও তা নদীর গতিধারার মতো পরিবর্তনশীল , জীবনের গতিপথে মিলিয়ে যায় অনেক বন্ধুত্ব । কেউ স্বার্থ ফুরালে পলায়ন করে আবার কেউ বন্ধুর কাছ থেকে উপকৃত হয়ে থাকলে সেই উপকারের প্রতিদান ফেরত দেবার জন‍্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট রাখে বন্ধন । তবে শৈশবের বন্ধুত্ব অমলিন । দূরত্বের ব‍্যবধান কখনো এই বন্ধুত্বকে মিটিয়ে দিতে পারে না । কোনো স্বার্থপরতা কাজ করে না ।
সৎ বন্ধু যেমন সর্বদা বন্ধুর পাশে থেকে মঙ্গল কামনা করে তার উন্নতি চায় তেমনি শঠ ও ধূর্ত বন্ধু নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে বন্ধুর ক্ষতি সাধন করে থাকে । বর্তমান সমাজ পরিস্থিতির দিকে তাকালেই লক্ষ করা যায় , এক শ্রেণির মানুষ বন্ধুত্বের আশ্রয় নিয়ে বন্ধুর পারিবারের যাবতীয় বিষয় জেনে ক্ষতিসাধন করে থাকেন । এই ক্ষতি কখনো আর্থিক আবার কখনোবা সম্মান গত দিকের হয়ে থাকে । তাই অচেনা মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করাটা আজ ভাবনার পর্যায়ে রাখাটাই শ্রেয় ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।