গদ্য বোলো না -তে (রূপং দেহি, জয়ং দেহি) পদ্মাবতী রায় চৌধুরী

আশ্বিনের শারদপ্রাতে জীবন…জীবনে ফিরে এসো…

মহালয়া…জীবনের বড়ো বেশি কাছের একটা দিন। এই দিন আমাদের ছোট্ট লিটল ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হত। এই উৎসব আর উত্তেজনা ঘিরে তার আগের দুটো মাসের নির্ঘুম দিনরাতের কথা খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে সেদিন পূর্ণিমারাতে ছাদে পায়চারি করতে করতে ভাইরা যখন বলে উঠল…
-আবার একটা মহালয়া এসে গেল দিদি!সময়ের কথা মনে পড়ে তোমার?
হ্যাঁ মনে পড়ে…আসলে ভীষণ করে যা কিছু মনে পড়ে,আমি তাকে মনেই চাপা দিয়ে রাখি দীর্ঘ দীর্ঘ বছর…মনে পড়ে সেইসব ছাপাখানায় কাটানো রাত,অপারেটরকে আর নিজেদেরকে চা খাইয়ে খাইয়ে রাতভর জাগিয়ে রাখার রেকর্ড…রুচিশীলভাবে একটি পৃষ্ঠায় ইঞ্চি খানেক জায়গা বার করার জন্য সবাই মিলে মোটামুটি আঁতিপাতি খুঁজতে থাকা, যাতে শেষ কবিতাটুকু সাজিয়ে দেওয়া যায়। তবুও বাদ পড়ত কিছু ভালো লেখা, আমাদের সীমিত ক্ষমতার কারণে। যার লেখা বাদ যাচ্ছে শেষ মুহূর্তে সে হয়ত মারাত্মক দুঃখ পেয়ে গেল,অথবা কাঁধে হাত রেখে হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে বলল,
-কেটে দে আমার লেখাটা…পরের বার হবে…
আমি অবাক তাকিয়ে রইলাম। আমি জানি এই লেখাটা লিখতে ঠিক কতটা চোখের জল ঝরেছে কোনও রাতে। হয়ত কখনও বিড়বিড় করেছি,
-কটা লাইন কমিয়ে রাখলে…
-কটা লাইন কমালে ইমোশন উপচে যাবে রে…দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ অল এবাউট ইমোশন…জাগতিক যা কিছু দেখছিস… সব মিথ্যে…এই চোখের জলটুকুতেই ঈশ্বর আছে…
শেষরাতে যখন বাড়ির পথে,তখন আকাশের চাঁদ ঝাপসা হয়ে আসছে… ভোর নীল হয়ে ফুটছে…আমরা ভোরের শেষ চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে প্রাইভেট কোম্পানির মতো গুণে নিচ্ছি টার্গেট দিন।
-মহালয়া আর কত দেরি রে?
অফসেট ঘোরে…বাইন্ডিং ভুল হলে আমি পাঁচশো বই পুনরায় ফেরত পাঠাই। সেদিন রাতে আচমকা যেন প্রেসকাকুর গলার আওয়াজ পেলাম…
-মহালয়ার আগে দু রাত যাতে না ঘুমোতে পারে কেউ তুমি মা সেই ব্যবস্থা করেছ যে দেখি…আমাদেরও তো সংসার আছে…
আমি ফোনে হালকা হেসে বলেছি হয়ত, -এটা কাজ। সবকটা খুলে বাঁধুন কাকু… খারাপ কাজ ‘সময়’ করে না…নেয়ও না।আপনার ভালো বাঁধাইকরকে ডাকুন। মহালয়ায় আমাদের অনুষ্ঠান। সারাদিন ধরে বাড়ি ঝমঝমিয়ে চলছে তার নিরন্তর রিহার্সাল। এমনকি যাকে কেউ বলেনি, সেও রাতভর বারান্দায় বসে বসে শ্রুতি নাটকের উচ্চারণ ঠিক করে পরের সন্ধ্যায় পড়া দেওয়ার মতো ডেডিকেশনে স্টেজকে চমকে দিচ্ছে।
সত্যি সত্যি সেই অনুষ্ঠানে কত মানুষ কত দূর থেকে আসতেন… কত কবিতা, গান, গল্প, সম্মাননা, ভালোবাসা…কলকাতা থেকে বাটানগর,কাঁথি,বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, সুন্দরবন…ছোট্ট একটা পত্রিকা… “সময়… 23:59…”
‘একটা সূর্য অনেক ভোর…’
ওই একটা দিনে মিলেমিশে যেত। মহালয়া মানে আমার কাছে স্মৃতি… আলোর স্মৃতি।
এ জমানা ফেসবুকের জমানা…হাতে ছাপার কালি লেগে কালো হয়ে যাওয়া জেদি লিটিল ম্যাগাজিন জমানা এ যুগ নয়…সারা বছর ছাত্র পড়িয়ে খুদকুঁড়ো জমিয়ে জমিয়ে দশ লাইন লেখা ছাপার কালিতে দেখার জমানা নয়। বই হাতে পেয়ে মাঝের পাতায় প্রাণভরে,নাক ডুবিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার,কভারের উপরে বারবার হাত বুলিয়ে রাত কাটানোর জমানা নয়,আমরাও বদলে চলেছি…প্রিন্ট মিডিয়া ছেড়ে নেট মিডিয়ার দিকে…যেকোনো ভালো কিছু পেতে যে অপেক্ষা, তা আমরা আর পারি না… অজস্র লাইক পেয়ে ভাবছি, অসম্ভব লিখতে পারি হয়ত… নাহ এসব আদতে মিথ্যা। আসল কথা হলো,আমি সেই পুরোনো রয়ে গেছি…গভীর রাতে চোখ থেকে ঝরে পড়া দু ফোঁটা জল ছাড়া আজও লিখতে পারি না… ভালোবাসলে কষ্ট তোমাকে পেতে হবেই… এই কষ্ট সৃষ্টির… এই কষ্ট সুখের…সে মানুষ এসে একদিন চোখের সব জল শুষে নেবে… সৃষ্টি ততটুকু বন্যার আশায়…
এবারের মহালয়া সবার থেকে আলাদা।মহামারী আর লকডাউনে আর্ত মানুষ এখন বাতাসকেও বিশ্বাস করে না। তবুও আশা করে জীবনে ফিরে আসার। গৃহবন্দি ছয়মাস,এগিয়ে চলেছি আশ্বিনের শারদপ্রাতের দিকে…বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ঘুম ভাঙাতে আসবেন ব্রাহ্ম মুহূর্তে। ওই কণ্ঠের ডাকে মহাশক্তি নেমে আসেন প্রতিটি ঘুমঘুম বিছানার কাছে। যেন কানেকানে বলে যাবে,’এই তো আমি এসে গেছি সকল যন্ত্রনার নিরাময় নিয়ে…বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ভোরবেলায় গঙ্গা স্নান সেরে এসে গমগমে গলায় মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করেন… জলে ভরে আসে চোখ… কেন যে… কেউ জানে না। ভালোবাসায় মন থেকে ডাকলে তো ঈশ্বরও কাছে এসে বসে হাত ধরে… মানুষ কি ফেরে না ঘরে? নাহ মানুষেও ঘরে ফেরে…দুয়ারে তার অপেক্ষায় আজও কেউ, এত মাস পরেও হয়ত অপেক্ষায় বসে আছে। শুধু আলোর আড়াল থেকে প্রতিটি পুজোয় মেয়েটি ভেবেছে,এইবারের পুজোয় সেই চলে যাওয়া মানুষটি ফিরে আসবে…তারা রাতের কলকাতায় হাতে হাত রেখে দেবীদর্শন করবে…’দেবীদর্শন’ মেয়েটির জীবনে আসেনি বহুবছর…অভিমানে জল জমেছে অপেক্ষায়…ইচ্ছে জমতে জমতে আগলে মরচে ধরে গেছে, এঘরের আগল খোলেনি বহুমাস কেউ। অভিমান মানে অভিযোগ নয়…অভিমান মানে দিনে দিনে চুপ করে যাওয়া। অভিমান মানে একমাত্র একটি মানুষের দুহাতের মাঝে চোখের জলে ভেঙে পড়া…দেবীদর্শনে চোখ নামিয়ে নেওয়া। বন্ধ ঘরে বহুদিন পরে বাড়ির পাশের রাস্তায় আগের মতো ঠাকুর বসেছে সারি দিয়ে… পুরোনো বিক্রিবাট্টা হাসিঠাট্টা…মানুষ ঘরে ফিরছে…জীবন ঘরে ফিরছে… প্রতিটি অপেক্ষার বুকে কেউ এসে ভালোবাসার আলো জ্বালিয়ে দিক আর একবার… জীবন,জীবনে ফিরে এসো…এঘর শুধু তোমার। নিরাময় আলোয় ফিরে এসো। ভয় থেকে নিজেকে ভুলে জয়ের হাত ধরে দেখো…নির্ভয়ে ভালোবাসার হাত ধরো…ঈশ্বর তোমার হাতে হাত রাখবেন… জীবন,জীবনে ফিরে এসো…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।