• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে পথিক সেনগুপ্ত (পর্ব – ২)

অচেনা বসন্ত – ২

থমকে যাওয়া মুহূর্তের আবরণের আশ্লেষের মধ্যে খেলা করতে থাকলো চেনা অচেনার অনুভূতি। নিজের আনমনে অনুভব করতে পারলাম ওর আমাকে করা প্রথম স্পর্শ কে। স্পর্শ কেন! কারণ দৃষ্টি বিনিময়টা আমাদের স্পর্শের পরমুহূর্তে হয়। এমন একটা স্পর্শ যা এখনও অবধি জীবনের সবচেয়ে স্পর্শ কাতর মুহূর্তের স্পর্শতা এঁকেছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল স্কুলের করিডরে। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আমি তখন সদ্য বিকশিত পাখনা মেলে বয়স দোষের মিথ্যা নায়কীও স্বভাবের প্রলেপ মেখে উচ্চমাধ্যমিকের পথের যাত্রা শুরুর দোরগোড়ায়। আসন্ন অংকের আতঙ্ক সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনঅভিজ্ঞ কারণ দিনটা ছিল ক্লাস ইলেভেনের প্রথম দিন। নতুন বইয়ের গন্ধে মম করছে গোটা ক্লাসরুম। বায়োলজির কিছু বিশেষ অধ্যায়ের উৎসাহিত আলোচনার ফিসফিস ভেসে বেড়াচ্ছে একান থেকে সেকান। কিছু অতি স্টুডিওস ছেলেমেয়েদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে ফিজিক্স এর ফোবিয়া। আর দোতালার ক্লাস রুমের বাইরে করিডরে ঠেসান দিয়ে আমি গিলে চলেছি জীবনের মঞ্চে মঞ্চস্থ হতে থাকা শ্রেষ্ঠ নাটকের প্রথম দৃশ্য কে। আর তখনি আমার কাধে স্পর্শ হল সেই রোমাঞ্চিত রসায়ন। পিছন ফিরে তাকানোর মুহূর্তের মধ্যেই আলোর গতিবেগ এর থেকেও তীব্র গতিতে ছুটতে আরম্ভ করল আমার স্পন্দন। একটা শিরশিরে অনুভূতি নেমে এলো শিড়দাড়া বেয়ে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম রক্তকে রাসায়নিক করে তুলছে বায়োলজির বিশেষ অধ্যায়গুলো। দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম আমার চোখের তারায় ফুটে উঠছিল বুঝতে না পারা থিওরেমের মুগ্ধতা। কতটা শুভ্র কতটা স্নিগ্ধ হলে কাউকে এতটা সুন্দর দেখায়। ঠিক কতটা! না কারো সাথে তুলনা করব না। বরং একটা বর্ণনা দি। কপালের ঠিক মাঝে ভুরুর সাহায্যে দুটো চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছিল। ভাসানো চোখের খয়রি তারায় ছিল জিজ্ঞাস্য। যার একপাশ কে আড়াল করার চেষ্টায় ছিল। হেয়ার ব্যান্ড এর ব্যারিকেড থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসা কয়েক গাছা চুল। লালিত্য কেও লোভনীয় করে তুলছিল তার গালগুলো। আর ঠোঁটে যেন ওর অগাধ আদরের অন্তবাস। এখন যা নড়ছে। হয়তো কিছু বলছে কিন্তু ততক্ষণে আমার দর্শেন্দ্রিয় ছাড়া বাকি সব ইন্দ্রিয়দের সাময়িক ইন্দ্রপ্রাপ্তি হয়েছে। ওর আল্লাদি আদরের মুগ্ধতায় মগ্ন আমি শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম ওর ঠোঁটের উপরের কালচে তিলটা কে। যা ক্রমশ তীব্রতা বাড়িয়ে চলেছে ওর জেহাদী জেল্লার। চোখের তুলি ওর চিকন চিবুক পেরিয়ে যেন আকন্ঠ পান করল ওর গলার গ্ৰীষ্মকে। আর তার নিচে ক্রমশ বিকশিত যৌবন যেন বারবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল টাইগার হিল থেকে সূর্যের প্রথম রশ্মিতে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার ঢেউ খেলানো চুরাকে। যা এখন জামার বরফে ঢাকা। আর তখনই সূর্যের আলোকে যেন এক নিমেষে ঢেকে দিল ঘন কালো মেঘ। ও চলে গেলো আমাকে পেরিয়ে। অন্ধকার মেঘের মতো চুল দুলিয়ে যেন বজ্রপাত করল চৈতন্য। এইরকম কোন মুহূর্তেই হয়ত জীবনানন্দ লিখেছিলেন ” চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা”।
সবার সাথে আরম্ভ হল ক্লাস আর সবার আড়ালে আমার এক নতুন অধ্যায়। কি সামঞ্জস্য পাচ্ছেন নাকি আমার সাথে আপনারও!!! যাক সে না হয় অন্য একদিন শুনবো আজ আমারটা বলি। সেই দিনের ইন্ত্রডাক্টরি ক্লাস্টার নাম দিলাম অক্ষর। যাকে ছাড়া শব্দ সম্ভব নয়। এরপর একের পর এক দিন পেরোতে লাগলো আর আমার অনুভূতি অক্ষরের আকার নিতে লাগলো। দিগন্ত দিশেহারা দ্বীপের মতো যার চারিপাশ ঘিরে রেখেছে পূর্বাশার নীল। কিন্তু কথা বলার সাহস ছিল না। প্রতিদিন ওকে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আনমনা কল্পনা রূপকথা সাজাতো নিত্যনতুন। কিন্তু সচেতনে সাহস শৈবাল। কেবল হরকায়। একদিন বাংলা ক্লাসে এরকমই মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। টিচার কৃষ্ণকলি কবিতার সারমর্ম বোঝাচ্ছেন। এমনই সময় হঠাত ওর চোখ ঘুরল। ঘুরতি তারা থামল।
টিচার বলার পরের লাইনটার একটা চৌম্বকীয় আকর্ষণ খেলে গেল পরিবেশে। “আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে আমিই জানি আর জানে সেই মেয়ে”। সেই চাউনি তে যেন কত কি প্রশ্ন জিজ্ঞাস্য। বিস্ময় যেন গোলকধাঁধার জটিলতায় আবদ্ধ করছে আমায়। চাউনির তীব্রতা বিঁধতে লাগলো আমার প্রতিটা গ্লানির শিরায়। সরিয়ে ফেললাম চোখ। বিঁধতে লাগলো আত্মগ্লানি সাথে ভয়। ও কি কিছু বুঝতে পারল !? আমি কি ধরা পড়ে গেলাম ওর কাছে ? বেজে উঠল শুক্রবারের ছুটির ঘন্টা।
তখন হাতে সদ্য মোবাইল পেয়েছি। সাদাকালো কিপ্যাড সেট। Nokia 1110i. মনে পড়ে! আর তাতেই চলত বন্ধুদের মধ্যে মিসকল দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার প্রতিযোগিতা। শনিবার বিকেল বেলা ফোনটা বাড়িতে রেখেই পাড়াতুতো ক্রিকেট খেলতে গেছিলাম। বাড়ি ফিরে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি কিছু বন্ধু তাদের চিরাচরিত অস্তিত্ব জানান দিয়েছে আর সাথে একটা এসএমএস আর সেটা খুলতেই ভূমিকম্প।
আচ্ছা আপনার পায়ের তলার মাটি সরেছে কখনো ? কোন আচমকা অপ্রত্যাশিত আগমন বার্তায়? Unsaved number এর এসএমএস টায় এসেছিল – কাল বিকেল পাঁচটায় সরোবর লেক এর তিন নম্বর গেটে চলে আসিস। অপেক্ষায় থাকবো।
পূর্বাশা
শারীরিক কিংবা মানসিক কোন অনুভূতি বাদ রইল না। পেটের গুড়গুড়, বুকের ঢিপঢাপ, মাথা ভোঁ ভোঁ সবাই একই সাথে সপ্তমে মৃদঙ্গ বাজাতে লাগলো। সাথে সাথে একটা ফোন করলাম নম্বরটা তে। কেউ ফোন ধরল না। একবার দুবার পাঁচবার। মনে বাসা বাঁধতে থাকলো ভয়। কেউ মজা করছে না তো ! সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হলো না। পরের দিন প্রায় 1 ঘন্টা অন্তর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি 5 মিনিট ও পেরোয়নি। আজ যেন সময়টাও সময়জ্ঞান হারিয়েছে। এত ল্যাথার্জি কিসের ?
সেদিনের বিকেলটা যেন বিদ্রোহী ছিল। চারটের সময় আকাশে অন্ধকার নামিয়ে এনে দিল ঘন কালো মেঘ সাথে হাওয়ারা সোঁ সোঁ স্লোগান দিতে দিতে ছুটছিল দিশেহারা হয়ে। পরিবেশ যেন এক উথালপাতল খেলায় মেতে উঠেছিল সেদিন। কিন্তু আমিও সেদিন হয়ে উঠেছিলাম অপরাজয়ি। কোন কিছুর বাঁধাই আজ মানবো না। কিন্তু বেজে উঠলো আমার এসএমএস টোন। “Sorry রে আজ, বেরোতে পারবোনা, মনে হচ্ছে আজ ঝড় বৃষ্টি হবে”। নিমেষের মধ্যে ভেঙে গেল আমার সব ঔদ্ধত্ত।
রাগে অভিমানে ফোনটা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালাম ছাদে। নিষ্ঠুর হাওয়ারা যেন আমাকে নিয়ে মজা করছে। শুকনো পাতাদের মত ঝড়িয়ে দিচ্ছে আমায়। ফিরলাম ঘরে। দেখলাম ফোনে সেই নাম্বার থেকে আসা দশটা মিসকল। কৌতুহল বাড়লো। ফোন করলাম। রিং হচ্ছে। ফোনটা ধরল। ঈষৎ উদ্বিগ্ন গলায় পূর্বাশা বলল ” কোথায় তুই? আমি দাঁড়িয়ে আছি!”
“কিন্তু তুই তো”
“হা হা মজা করছিলাম ! যদি খুব অসুবিধা থাকে তাহলে….…”
আমি যেন ততক্ষনে পাগল হয়ে উঠেছি। উন্মাদনার পারদ ঠেকেছে থার্মোমিটারের ডগায়। শুধু বললাম আমি আসছি ‌।‌‍‍‌ আর ততক্ষণে বৃষ্টির অভিযান আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তারই মধ্যে আমি নেমে পড়লাম রাস্তায়। কখনো দৌড়ে কখনো হেঁটে যখন পৌছালাম তখন ঝোড়ো বর্ষা সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়েছে আমায়। ফুসফুসে নিশ্বাস নেওয়ার শক্তিকে একাত্ম করছি। উত্তেজনায় আর ঠান্ডায় কেপে চলেছে ঠোঁট। বেশ খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। আর সেই ঝাপসা দৃষ্টিতেই দেখলাম লাল রঙের একটা চুরিদার পড়ে মাথায় ছাতা হাতে এগিয়ে আসছে পূর্বাশা। যখন থামল ওর ছাতার অর্ধেক আমার মাথায়। চোখের এক অদ্ভুত মায়া আমার নিশ্বাসের গতি আরো বাড়িয়ে তুলল। কিন্তু তারপর মুহূর্তেই ঘটে গেলো এক চরম দুরবস্থা। আমি কিছু বোঝার আগেই পূর্বাশার ঠোঁট চেপে ধরলো আমার ঠোঁট কে। আমার শরীরে প্রত্যেকটা তরঙ্গ খেলে উঠলো। নিমেষের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত পৃথিবী। আরো একটু চাপ অনুভব করল দুজনেরই ঠোঁট। ধীরে ধীরে আমার জিভের আদর মাখল ওর জিভের উষ্ণতা। দুজনের লালা রসে একাকার হয়ে মিলে মিশে যাচ্ছে উদ্দীপনায়। গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে চুম্বন। গোরস্থ হয়ে চলেছি আমরা। কখন যে ছাতাটা উড়ে গেছে কেউ জানিনা। দুজনের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ একে অপরকে স্পর্শ করে চলেছে। ঠোঁট, ঠোঁট থেকে গাল, গাল থেকে গলা আর তারপর স্তন। একটা সুতোও গলার জায়গা নেই দুজনের ভেতর থেকে। একে অপরের প্রতিটা নিঃশ্বাস মাখছি দুজনে। আর আমাদের এই Adam-eve খেলায় মাতছি ঝোড়ো বর্ষার বৃষ্টির জল। না আর ভালো লাগছে না শরীরে একফোটাও কাপড়। ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে সবকিছু। ততক্ষণে লজ্জার মাথা খুইয়েছি দুজনেই। অজানা অবলীলায় আমার হাত স্পর্শ করল ওর স্তন। শিউরে উঠল ও। না আর মনে করা সম্ভব নয়। ট্রাম রাসবিহারী এভিনিউ পেরিয়েছে। বহু বছর পর আবার অনুভব করছি সেই পুরনো নিঃশ্বাস কে। ইষদ দোনোমনার মধ্যে দিয়ে একবার ঘাড় ঘোরালাম ওর দিকে। একী! ও তাকিয়ে আমার দিকে। কপালে সেই একই ভাঁজ। চোখের খয়রী তারায় আজ আবার কৌতুহলী জিজ্ঞাস্য।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।