Cafe কলামে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ৯

প্যাস্টেল কালার

▪️ রুদ্রপ্রয়াগের একটি সকাল

গতকাল শেষ বিকেলে ধর্মশালার কেয়ারটেকার যখন আমাদের পৌঁছানোর আশা ত্যাগ করে ফেলেছেন ঠিক তখনই নীল রঙের গাড়িটা সামনের উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর যা হয় আর কি! ঘর দেখা, বিছানা-বালিশ-কম্বল বুঝে নেওয়া –এইসব সারতে সারতে সন্ধের আবছায়ায় ঢেকে গেছে রুদ্রপ্রয়াগের পাহাড়-জঙ্গল-নদী। অক্টোবরের এই শেষ লগ্নে সর্বাঙ্গে শীতপোষাক জড়িয়েও রাতেরবেলা সংলগ্ন বারান্দায় দাঁড়িয়ে নদীর শোভা উপভোগ করা যায়নি তেমন ভাবে।
তাই একেবারে সকাল সকাল উঠে পড়েছি। বিছানায় শুয়ে সারারাত কুয়াশায় ঢুকে যাওয়ার আগে পর্যন্ত শুনেছি নদীর জলোচ্ছ্বাস। ভোরে ঘুম ভাঙতেই কানে এসেছে একটানা নূপুরের ধ্বনি। অথচ আজ বেলা দশটায় রুদ্রপ্রয়াগ ছেড়ে যাবে আমাদের গাড়ি। তাই হাতে সময় সীমিত। দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে তুলে দিলাম গাড়ির ছাদে। এবার খানিক ঝাড়া হাত পা। ঘন্টাখানেক সময় হাতে আছে।
ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে ধর্মশালার পাশ দিয়ে নদীগামী পথ ধরলাম। কুড়ি-পঁচিশ ফুট গিয়ে খাড়া নেমে গেছে। সিঁড়ির মতো পাথর ফেলা আছে। দু’দিকে ঘন ঝোপ, গাছপালা। কয়েকটা দাগওলা ছাতার পাখি ঝোপে ডাকাডাকি করছে। পাশ দিয়ে নামতে লাগলাম। ফুট তিরিশেক খাড়া পাথরের অগোছালো সিঁড়ি বেয়ে নামার পরে বুঝলাম জল ছুঁতে গেলে এখনো এর দ্বিগুণ পথ নামতে হবে।আর নামার উল্টো দিকেই ওঠা। অর্থাৎ এই খাড়া এবড়োখেবড়ো পথেই বুক ঘষে উঠতে হবে এতটা।

একটু যখন ইতস্তত করছি, চারপাশের ঝোপঝাড় যত আমাকে চেপে ধরছে দু’দিক থেকে মনে হল কেউ যেন নিচ থেকে উঠে আসছে। একজায়গায় ছড়ানো চত্বর দেখে সরে দাঁড়ালাম। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের একজন পুরুষ মানুষ। মুখে চেহারায় অনেক লড়াইয়ের চিহ্ন। মাথা থেকে চওড়া কাপড়ের পট্টি পিঠের দিকে নেমে গেছে। তার উপর ভর করে পিঠ ও কোমরের ওপর বয়ে আনচে একবস্তা বালি। নিচের নদীর বুক থেকে তোলা। তখনও ভিজে, ভারি।
ভাবলাম, আমি ভয় পাচ্ছিলাম শুধু নিজেকে টেনে তোলার কথা ভেবে। আর এই মানুষটি এত ভার নিয়ে উঠে আসছে। জোরে শ্বাস পড়ছে। যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে, তবু দৃঢ় পায়ে একটা একটা করে পাথরের খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে চলেছে। নিচের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আবারও থমকে দাঁড়ালাম। পিছনে বোধহয় তার স্ত্রী। তার মাথা থেকেও একই ভাবে ঝোলানো বালির বস্তা।
আমি নেমে চলেছি জলোচ্ছ্বাসের দিকে। ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে নদীকে দেখা যাচ্ছে না সবসময়। তবে অবিরাম জলের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নদী তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অবশেষে নেমে এলাম নদীর পাড়ে, পাথুরে জমিতে। জলে হাত ছোঁয়াতেই স্নিগ্ধ শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল শরীর জুড়ে। জলে ভেজা হাত ঠেকালাম গালে, কপালে, ঘাড়ে। অলকানন্দার নিবিড় স্নেহস্পর্শ যেন জাদু করল আমায়। একটা কালো-সাদা পাখি বসে আছে জলের ধারে, পাথরের ঢালে। লাফিয়ে লাফিয়ে কীটপতঙ্গ ধরছে। দূরে একটা ডালের ডগায় ছোট্ট পাখি ডেকে উঠছে বারবার। ক্যামেরায় জুম করে দেখলাম বাবুনাই বা চশমা পাখি। নদীর পাড় ধরে পাথর ডিঙিয়ে এগিয়ে চললাম। সামান্য দূরেই মন্দাকিনী এসে মিশেছে অলকানন্দার সাথে। ওপারে পাথরের উপর রুদ্রনাথের মন্দির।

পুরাণ মতে এখানেই নদীবক্ষের বিশালাকার পাথরের বুকে নারদের দীর্ঘ তপস্যায় শিব রুদ্ররূপে আবির্ভূত হন। তপস্যার ফলস্বরূপ নারদের মাধ্যমে মর্ত্যে নৃত্য-সঙ্গীতকলার প্রচলন হয়। পরবর্তীতে বিবেকানন্দের স্মৃতিও জড়িয়ে ধরে ওই প্রস্তরখন্ড। তবে ২০১৩ সালে মন্দাকিনীর ভয়াল জলোচ্ছ্বাসে সে নারদ শিলা ভেসে গেছে। কিন্তু নৃত্যরতা অলকানন্দা-মন্দাকিনী যেন সব অভাব অনায়াসে মুছে দিয়েছে। আজও এই স্নিগ্ধ সকালে চারপাশের এত পাখি, গাছপালা, রঙবেরঙের পাথর এসবকিছুকে অগ্রাহ্য করে লাস্যময়ী নদী কোমর দুলিয়ে ছুটে চলেছে মর মানুষদের কাছে। তাদের দিনযাপনের ক্লেদ আর গ্লানি মুছে দিয়ে নৃত্য-সংগীত রসসুধা পৌঁছে দিতে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।