ক্যাফে কলামে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ১৪

প্যাস্টেল কালার 

পোষ্য

 ছোটোবেলায় চিড়িয়াখানা বানিয়েছিলাম নিজস্ব। ইঁট দিয়ে উঠোনের এককোণে ছোট ছোট ঘর। কয়েকটা আপেল শামুক, কেঁচো, ছোট গর্তে জল ঢেলে খলসে মাছ -এইসব। শামুক আর কেঁচো নিজেদের পথ নিজেরাই দেখে নিয়েছিল দ্রুত। বেচারা খলসে মাছ জল শুকিয়ে মরে গেল খামোখা। সে বয়স ছিল দ্রুত এক খেলা থেকে অন্য খেলায় মেতে ওঠার, তাই সেভাবে দুঃখ হয়নি।

মামারবাড়ির বাগানে একবার খুঁজে পেলাম রঙচঙে আহত পাখি। লাল, সবুজ, নীলচে রঙের বাহার সারা শরীরে। দোতলার বারান্দায় চুপড়ি চাপা দিয়ে সেদিনকার মতো রাখা হল তাকে। অফার করা হল বহুবিধ খাবার। তবু সে বেচারা দাঁতে থুড়ি ঠোঁটে কাটল না কিছু। পরের দিন সকালে তার মরে কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর মনের দুঃখে পুঁতে দিয়ে এলাম বাগানের নরম ঘাস-মাটির নিচে।

তখন সেভেন বা এইটে পড়ি। খবর পেলাম এক বন্ধুর মামার বাড়িতে খরগোস বাচ্ছা দিয়েছে। বন্ধুটির সাথে রোজ হানা দিতে লাগলাম সেখানে। তার মামাকে অনেক মলম মাখিয়ে ফাইফরমাশ খেটে মাস খানেক পরে দুজনের দুটি খরগোস ছানা জুটল কপালে। তারপর তো দক্ষযজ্ঞ। প্যাকিং বাক্স যোগাড় করে সেখানে আশ্রয় পেল সাদা ধপধপে লাল চেরীর মতো চোখের সেই খরগোস ছানা। নতুন কাজ পেলাম অনেক। দুবেলা ঘাস কাটা, ছানার হাগুমুতু পরিষ্কার। সোনামুখ করে সেরে ফেলতাম সেসব দায়িত্ব। কিন্তু তিন চার মাস যেতে না যেতে ধীরে ধীরে মোহভঙ্গ হতে শুরু করল। তার সাথে ছিল মায়ের গঞ্জনা। সব মিলে বেশ চাপ। ফলত প্যাকিং বাক্স সমেত খরগোস দান করে দিলাম বন্ধুকে।
এরপর দীর্ঘদিন আমার কোনো পোষ্য ছিল না। চাকরি জীবনে এক ছাত্র লোভ দেখাল “স্যার, টিয়াপাখি নেবেন?” আবার চনমন করে উঠল মন। খোঁজখবর নিয়ে বুঝলাম ওদের ভুট্টা ক্ষেতে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া আসে। তাদেরকেই কোনোভাবে ধরে এবং বিক্রি করে। সাময়িক ভাবে ভুলে গেলাম এমন পাখি ধরা কতটা অন্যায়। দিনকয়েক বাদেই সেই ছাত্র প্লাস্টিকের ঝুড়িতে করে এনে দিল রঙিন টিয়াপাখি। মাথা টকটকে লাল। গায়ে সবুজ নীল হলদেটে পালক। সালিম আলির বইতে ছবি মিলিয়ে দেখলাম তার নাম ‘প্লাম হেডেড প্যারাকিট’। বিরাট খাঁচা কেনা হল। রঙের বাহার দেখে পাখির নাম দেওয়া হল ম্যাকাও। কিন্তু বিপদ হল বেশ। সেই পাখি কিছুই খায় না। সাধারণ টিয়ার খাদ্যাভ্যাসের সাথে কিছুতেই মেলাতে পারি না। পাকা পেয়ারা বা লাল লঙ্কা ছুঁয়েও দেখে না। অবশেষে ভুট্টা দিয়ে উপবাস বন্ধ হল। কিন্তু মাসখানেক পরে বাজারে ভুট্টাও অমিল। তাছাড়া নিজের ভিতরেও কচকচ করতে শুরু করেছে পাপবোধ। অবশেষে একদিন উড়িয়ে দিলাম পাখি।

আপাতত আমার কোনো পোষ্য নেই। এমনকি অক্ষরও উড়ে যায় খাতার পাতা থেকে দিগন্তের দিকে। কেবল স্মৃতি ছমছম করে বাজে, প্রতিটি স্বপ্নের ভিতরে মাথা গলিয়ে দেয়। আসলে কেউই পোষ মানতে চায় না এ পৃথিবীতে। আমিও না। তাই নিজেকেই পোষ মানাতে গিয়ে কেটে যায় দিনরাত।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।