“মানি” অনবরত চোখ মুছে যাচ্ছে আর বিড় বিড় করে বলছে, “হে ঈশ্বর, তুমি ক্ষমা করে দিও ওদের। কারোর কাছে কোনো অভিযোগ, অনুযোগ নেই আর আমার।” প্রতিদিন পুকুরপাড়ে বাসন ধুতে বসে “মানি” নিজের দুঃখ খানিকটা ধুয়েনেয় এইভাবেই।
শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবারপর লোকে ওকে “মোছলমানি” বলে ডাকত। মোছলমানি কি কোনও মানুষের পরিচয় হতে পারে নাকি? তাই নিজেই নিজের নাম রেখেছে “মানি”।
আজকাল মানি লোকের বাড়িতে বাড়িতে কাপড় কাচে, বাড়িঘর গোবরমাটি দিয়ে লেপে দেয়, কাঠেরজ্বালের উনান পেতে দেয়। পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কাজ করে। কোনও বাঁধাধরা কাজ ওকে কেউ দেয়না। মুসলমান ঘরের মহিলা তো, একটু ফারাক রেখে চলাই ভালো।
মানি অবশ্য আজকাল আর এরকম ব্যবহারে দুঃখ পায়না। যাকে ভরসা করে একদিন পরিবার, জাত, ধর্ম সব ত্যাগ করেছিল সেই ভালবাসার মানুষই যখন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পথের কাঁটার মত জীবন থেকে উপরে ফেলেদিল দূর করে তখন অন্যলোকের ব্যবহারে দুঃখ পাওয়ার কোনও মানেই হয় না।রোজ সকালে উঠে কাজ খুঁজতে হয় তাকে।
ঠিকা হিসাবে সারাদিন কাজকরে যা রোজগার হয় তাতে দিনের শেষে একসেদ্ধ ভাত জুটেই যায়। সেজন্য মানি ভগবানকে ধন্যবাদ জানায় আর রোজ একমুঠো ভাতের ভোগদেয় নিজে খাবার আগে।একা একা খেতে ভালো লাগে না। তবে ঈশ্বরের ভোগের থালা ওর খাবার সময়ে সামনে থাকে বলে অতটা খারাপ আর লাগেনা।
মনেপরে যায় ছোটবেলার কথা। ওরা পাঁচ ভাই বোন একসাথে খেতে বসত। ব্রাহ্মণবাড়ির মেয়ে। কত নিয়মনিষ্ঠা মেনে চলতে হত তখন।
জামিলা রোজ সকালে এসে ঘরদোরে গোবর দিত, মসলাকরা, মাছ-তরকারি কাটা, বাসন মাজা সবই ছিল তার কাজ।
কাঠ চেরাই করা, মাছ ধরা, আম জাম কাঁঠাল, ডাব, নারকেল পেরে দিত জলিল চাচা। তখন একই গ্রামে পাশাপাশি হিন্দু মুসলমানের বসবাস ছিল। একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকত নিজের মত করে। ধর্ম নিয়ে কোনো মাতামাতি ছিলনা।
রাণীর বাবা শ্রীধর মুখুজ্জে পেশায় পোষ্টমাস্টার ছিলেন। এলাকায় সবাই তাঁকে খুব সম্মান করত। লেখাপড়ার বিষয়ে তিনি উদার ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই পড়াশোনা করেছে।
এস. এফ পাশ করে রাণী আই. এ পড়তে শহরের কলেজে যায়। সেখানে দেখাহয় একবছরের সিনিয়র অরুণের সাথে। অরুণ চৌধুরী, ছাত্র নেতা, লীগের সক্রিয় সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে দেশের হয়ে লড়াই করার স্বপ্ন দেখে। এমন ডাকাবুকো ছেলেকে কলেজের সবাই ভালোবাসে।
রাণীও ভালোবেসে ছিল এই দামাল ছেলেটাকে।
“নবীন বরণে”র অনুষ্ঠানে অরুণের গান শুনে প্রথম ভালোলাগা। তারপর কলেজ থেকে তিনদিনের “শিক্ষামূলক ভ্রমণে” একসাথে সময় কাটানোর সুযোগ, কলেজের অনুষ্ঠানে একসাথে অংশগ্রহণ, ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দুজনার।
বাড়ি থেকে যখন বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু হল তখন রাণী জানিয়ে দেয় অরুণকে ছাড়া আর কাউকে ও বিয়ে করতে পারবে না। রাণীর বাবা মেয়ের এই বেয়ারা বেপরোয়া মনোভাব দেখে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে ওই মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করলে এই বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবেনা।
বাড়ির মান মর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে রাণী কলেজ থেকে পালিয়ে গিয়ে অরুণকে বিয়েকরে । বিয়ের আগে অবশ্য অরুণের বাবার আদেশে তাকে “কলমা” পড়তে হয়েছে। আদর করে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে “সলমা বেগম” বলে ডাকত। বিয়ের একবছরের মধ্যেই ছেলে হয়েছিল বলে শ্বশুরবাড়িতে তার খাতির বেড়ে গিয়েছিল।মুক্তিযুদ্ধের অস্থির সময় পেরিয়ে তিনছেলে দুইমেয়ের মা সলমা বর্তমানে একেবারে পর্দানশীন। বোরখা হিজাব ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরহওয়া নিষিদ্ধ হয়েগেছে। বিয়ের দীর্ঘ পনেরো বছর পর বাড়ির আর পাঁচটা আসবাবের মত সলমাবেগম পরে রয়েছে চৌধুরী বাড়ির কোনো এককোনে।
অরুণ চৌধুরী এখন মুক্তিযুদ্ধের ফসল তুলতে ব্যস্ত। বাড়িতে মৌলবি সাহেবের সাথে নেতা মন্ত্রীরাও আসা যাওয়া করছেন। সকলের ইচ্ছায় অরুণকে এবার নিজের এলাকা থেকে জনপ্রতিনিধি করা হবে।
এ নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে জোরকদমে। তবে কেমন একটা থমথমে ভাব বাড়িতে। আজকাল কেউ ওর সাথে কথা বলেনা। বাচ্চাদেরও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ওর কাছথেকে। সংসারের কোনো কাজ আজকাল আর করতে দেওয়া হয়না। একেবারে একা কাটে সারাটা দিন। অরুণ কখন বাড়িতে আসে যায় কিছুই বুঝতে পারে না।
স্বনামধন্য স্বামীর জীবনে নিজের প্রয়োজনীয়তাটুকু আর কোথাও খুঁজে পায়না রাণী।
হঠাৎই একদিন দুপুরে অরুণ রাণীর ঘরে আসে। কোনোরকম ভূমিকা নাকরে বলে যে ওকে ভোটের টিকিট পেতেই হবে। আর তার জন্য মৌলবি সাহেবের যুক্তি মেনে “বিধর্মী” বৌকে আগে “তালাক” দিতে হবে। তাই আর দেরি না করে আজ এক্ষুণি সে বৌকে তালাক দিচ্ছে। রাণী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনবার “তালাক” উচ্চারণ করে অরুণ নিজের কর্তব্য সম্পূর্ণ করে ফেলে।
রাণী চিৎকার করে ওঠে,”আমি কোথায় যাবো? কেন যাবো আমি? আমার ছেলেমেয়েদের ছেড়ে আমি থাকবো কি করে?”
রাণীর কোনো কথার উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন মনে করে না অরুণ। শুধু রাণীর হাত ধরে টেনে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়াটাই ছিল তখন খুব জরুরী।”
রাণী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, ” আমি যদি বিধর্মী হই তবে সলমাবেগম হলাম কিভাবে? আমার ছেলেমেয়েরাও তো তাহলে বিধর্মী হয়ে যাবে! ওদের যে লোকে বেজন্মা বলে গালি দেবে! ওরা কোন ধর্মের পরিচয় দেবে?”