গল্পের বড়দিনে রীতা চক্রবর্তী

বলিভিয়া

ওই দুরে মুসৌরীর সবুজঢাকা পাহাড়ের মাথার উপর যে গীর্জাটা দেখা যায় ওটা সাহেব গীর্জা বলেই জানে সবাই। মুসৌরীর মালরোড ধরে এগিয়ে গেলে ড্যানিয়েলের বাড়িটা আগে দেখাযায়। পাহাড়ের খাঁজে যেন ঝুলন্ত ফুলবাগান। ওদের কাঠের বাড়িটা হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন কোনো প্রাচীন কালের গীর্জা। বল্লী প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়েই ছাগল চরাতে যায়। ছাগলের-মাংস আর দুধ বিক্রি করে ওরা।
রাস্তা দিয়ে সাবধানে নিয়ে যেতে হয় এই পশুগুলোকে। সারবেঁধে ছাগলগুলো চলতে থাকে;সাথে অনেক ভেড়াও আছে।ওই ভেড়ার পশম কেটে নিয়ে তার থেকে সুতো তৈরী করে ওর দাদী। সেই সুতোকে পাক দিয়ে উল বানায় ওর মা। বল্লীর তাই অনেক দায়িত্ব। সারাদিন এক একটা ভেড়া ছাগলের নাম ধরে ডেকে ডেকে দেখে নেয় সবগুলো ঠিক আছে কিনা। ছাগল নিয়ে পাহাড়ের গায়ে ঘুরতে ঘুরতে কখনো কখনো চার্চের সামনে এসে দাঁড়ায় বল্লী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে গীর্জার ওই চূড়ার দিকে। মারিয়মের কোলে ধরেথাকা হাসি মুখের শিশুটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে আলোক শিশু যীশুর কথা।
যীশুর ক্রুশবিদ্ধ চেহারা মনে পরলেই চোখ জলে ভরে যায় বল্লীর। ভাবতে থাকে যারা তাঁকে ক্রুশে গেঁথে দিয়েছে তারা কি ভয়ানক নিষ্ঠুর ছিল। যীশু কিন্তু ওই সব অত্যাচারী মানুষেরি পাপ মকুব করার জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এমন মানুষও এই পৃথিবীতে জন্মেছিলেন!
বল্লী শুনেছে কাশ্মীরের কোনো এক জায়গায় ‘ঈশা’ নামে একটা পাহাড় আছে যেখানে এই মহামানব আত্মগোপন করেছিলেন দীর্ঘকাল। এখানে এসে তিনি “যোগ” সাধনায় মগ্ন ছিলেন। এইসব ভাবতে ভাবতে কতদিন বল্লীর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েগেছে।
তবে পাহাড়ের কোলে ঘুরে বেড়াতে ওর খুব ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভাললাগে যেদিন ড্যানিয়েলের সাথে ওর দেখা হয়। ড্যানিয়েল ওকে অনেকদিন গীর্জার ভেতরে নিয়ে গেছে। ঘুরে ঘুরে পুরো চার্চটা দেখিয়েছে। ফাদারের কাছেও নিয়েগেছে ওকে। ফাদার ওকে বলেছেন, “যখন ইচ্ছে করবে চলে আসবে।” ফাদারকে দেখে বল্লীর মনে হয়েছে যেন স্বর্গের কোনো দেবতা এই গীর্জায় এসেছেন। চার্চের সামনে ড্যানিয়েলের বাবার একটা দোকান আছে। ড্যানিয়েল ওখানে বাবার সাথে কাজ করে। বল্লীর সাথে ড্যানিয়েলের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েগেছে।
কয়েকদিন ধরে বল্লীর মন ভালো নেই। প্রতিদিন গীর্জার সামনে অনেকক্ষণ বসে থাকে । কিন্তু ড্যানিয়েলের সাথে দেখা হয়না। একদিন সাহসকরে একা গীর্জার ভেতরে ঢুকেপরে। যীশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর দুচোখবেয়ে নেমেআসে বেদনার অশ্রুধারা। মনে মনে বলে, “হে বিশ্বপিতা, তুমি তো সবার মনের কথা জানো। কতদিন হয়ে গেল ড্যানিয়েলের কোনো খবর নেই। ওকে দেখতে না পেয়ে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি ড্যানিয়েলের একটা খবর জোগাড় করে দাও।”
দুরে গীর্জার বাগানের মালি গাছের পরিচর্যা করছিল। হঠাৎ সে দেখতেপায় একটা মেয়ে একা যীশুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে বল্লীকে দেখে বলে,” আজ তোমার বন্ধু আসেনি, তাইনা! তোমার আজ খুব কষ্ট হচ্ছে বন্ধুর জন্য! ওর তো খুব অসুখ। কাল ফাদার ওকে দেখে এসেছেন। ওষুধও দিয়ে এসেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই ও ভালো হয়ে যাবে। মনে দুঃখ রেখনা। তবে তোমার বন্ধু কষ্ট পাবে। তুমি তোমার সব কাজ ঈশ্বরের সেবা ভেবে করে যাও। দেখবে তোমার বন্ধু খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠবে।”এই বলে বল্লীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বল্লী ধীরে ধীরে গীর্জার বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে।
এরপর বল্লী যেন নিজেকে কাজের মধ্যে সঁপে দেয়। সকাল বেলা মায়ের সাথে পাহাড় থেকে খুঁজে খুঁজে সব্জি আনে। সেগুলো ধুয়ে সুতোয় বেঁধে রোদে শুকাতে দিতে হয়। শীতকালে ওই সব্জিইতো খেতেহবে। সন্ধ্যাবেলা দাদীর সাথে সুতো তোলার কাজকরে। সারাদিন ভেড়া ছাগলের খুব দেখভাল করে। একদম শান্ত একমেয়ে।
পাহাড়ে শীত পরেছে। বরফ পরে বলে বাইরে বের হবার উপায় নেই।তুষের আগুন জ্বেলে দিনরাত ঘর গরম রাখা হয়। বল্লী হঠাৎই একদিন দেখে একজন হ্যাটকোট পরা লোক ওদের বাড়ির দিকে আসছে। বল্লী একটু আড়ালে চলে যায়। দেখে ড্যানিয়েল এসেছে ওদের বাড়িতে। দাদীর সাথে কথা বলছে। ভাবল নিশ্চয়ই ওকে খুঁজবে – ডাকবে! তাই লুকিয়ে থাকে। কথাবলা শেষ হলে ড্যানিয়েলও এদিক ওদিক কিছু খুঁজতে থাকে, তারপর চলে যায়।বল্লী কারো কাছে কিছু জানতে চায় না।
এরপর আর পাঁচটা দিনের মত দিন পার হতে থাকে। তবে আজকাল মা আর দাদী খুব ব্যস্ত থাকে। ও ছাগলনিয়ে বাড়ি ফিরে প্রায়ই দেখে দাদী আর মা অনেক অনেক কিছু তৈরী করছে। মনে মনে ভাবে, বড়দিনতো এসেই গেল; সবাই মিলে সাহেব গীর্জাতে যাবে। তাই হয়তো এত ব্যস্ততা!
অবশেষে এল সেই কাঙ্খিত বড়দিন। আজ রাত বারোটায় গীর্জায় আলোরবাতি প্রজ্জ্বলিত হবে। যীশুর আবির্ভাবের মুহূর্তে গীর্জার ভেতরে বেজে উঠবে বড় ঘন্টা। মঙ্গলগীত গাইবে সবাই মিলে। সারা রাত ধরে গীর্জায় চলবে আনন্দ উৎসব।
ওদের বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে গীর্জার পথে বেরিয়ে পরে। দাদী ভেতরে গিয়ে ফাদারের সাথে দেখা করে এসেছে। ড্যানিয়েলের বাড়িরও অনেক লোকজন দেখা যাচ্ছে। ওরা বল্লীর মায়ের সাথে কথা বলছে। ড্যানিয়েল তাকিয়ে আছে বল্লীর দিকে। “কি অদ্ভুত মায়াভরা চোখ ড্যানিয়েলের, “বল্লী মনে মনে ভাবে। ড্যানিয়েলও মনে মনে বলে,”শোনো বলিভিয়া, আজ রাতে পবিত্র দীপশিখার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে চিরদিনের মতো আপন করে নেব। তুমি যে এখনো পর্যন্ত কিছু জানোনা সে তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। ফাদারের ইচ্ছেতে আমি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তোমার বাড়ির লোকজনকে ফাদারের ইচ্ছা এবং আদেশের কথা বলে এসেছি। আর কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা মাত্র।”
হঠাৎ বল্লীর মা এসে বলে,” ফাদার ডাকছেন, চল তাড়াতাড়ি।”বল্লী মায়ের সাথে চলে যায় ফাদারের কাছে।
ফাদার পরম স্নেহে বল্লীর মাথায় হাত রেখে বলেন,” শোন বলিভিয়া, আমার ইচ্ছে যে তুমি ড্যানিয়েলকে তোমার জীবনসাথী রূপে বরণ করেনাও। এতে শুধু তোমাদের দুটি পরিবারেরই নয়, জগতেরও কল্যাণ হবে। পরমপিতা করুনাময় যীশু তোমাদের কল্যাণ করবেন।”
বল্লী ফাদারের আদেশ মাথা পেতে নেয়। তাঁকে যেন স্বয়ং মহামানব বলেই মনে হল বল্লীর। তার মনের চাওয়া পাওয়ার কথা কিভাবে তিনি সব জানতে পেরেছেন ভেবেই অবাক হয়ে যায় বল্লী। অপেক্ষার প্রহর শেষে ঠিক রাত বারোটায় ড্যানিয়েলের সাথে বলিভিয়ার আংটি বদল হয়।এই আনন্দ মুখরিত রাতে বিগলিত আলোকের এই ঝর্ণাধারার মাঝে তারা একে অপরের হয়ে যায় চিরতরে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।