বইমাত্রিক রাহুল গাঙ্গুলি

যুক্তি // যুক্তিহীনতা’র ফাটল : অবশিষ্ট (সময়- স্থান)

বই : মেরুন সন্ধ্যালোকে
কবি : শামীম সৈকত
প্রকাশনা : ঘোড়াউত্রা প্রকাশন
প্রচ্ছদ : মাইদুল রুবেল
গ্রন্থসজ্জ্যা : সুমন দীপ
বেশ কিছুদিন শারদীয়া অবসরে কাটলো বন্ধুরা।গোটা টেকটাচটক্ সম্পাদকীয় টিমের উদ্যোগে, কিছু বিশেষ সংখ্যা’য় আমরা পড়ার সুযোগ পেলাম ~ বেশ কিছু নবীন // প্রবীণ মিলিয়ে ভালো কিছু লেখা।আর সাপ্তাহিক নিয়মিত কলম লিখিয়েরা এই অবসরে; সেসব লেখায় নিজেকেও জারিত করে নিতে পারলো ~ কিভাবে? সে অবশ্য এখনিই বলাটা অপ্রাসঙ্গিক।তবে এটা বলাই যায় : এটুকু অবসরের প্রয়োজনীয়তা ছিলোই; কারণ বোধের পর্যায়ক্রমিক অনুভূতিকাহনকে ব্যক্ত করার প্রচেষ্টা নিয়মিত চাকরির সাপেক্ষে রাখলে; তা তখোন প্রকাশ করার প্রতি দায়হীন ও একঘেয়েমি ভর্তি সময়ে রূপান্তরিত হতে বাধ্য।যাইহোক, আমরা আবার এই সপ্তাহ থেকে বইমাত্রিক্ বিভাগে ধারাবাহিক কলম দ্যাখার আশা করতেই পারি; যদি আশপাশটা সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।
বইমাত্রিক বিভাগটিতে অতীতে ঘোড়াউত্রা প্রকাশনী’র (ঢাকা) উদ্যোগে প্রকাশিত ২০২০ অমর একুশে মেলায় বইসিরিজের বেশকয়েকটি বই নিয়ে আলোচনা করেছি।আজ আরও একটি বই নিয়ে প্রতিক্রিয়া ~ যিনি লিখেছেন সেই শামীম সৈকত; সম্ভবত আমাদের এখানে খুব বেশী সুপরিচিত নন্; বিষয়টি ব্যক্তিগত পরিসর নিয়েও ~ যদিও এই কবির কবিতা আমার পূর্বপরিচিত।তবে, এখানে যেভাবে তিনি কাজটি করেছেন বা যে কাজটি কবিতা মাধ্যম নিয়ে করেছেন ~ সেটি কখনোই আমার পূর্বপরিচিত নয়।

যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি নিয়ে সবসময়, আমাদের ব্রহ্মান্ডের চরিত্র বিশ্লেষণ সকলে করে থাকি; তা আমাদের বিমূর্ততাকে ~ মূর্ততায় রূপান্তরকরণে সহায়তা করে।আবার, এই যুক্তি ও প্রতিযুক্তির মাঝেও আরেকটি তৃতীয় ধারা সমান্তরালভাবে সহাবস্থান করে; যার নাম “যুক্তি’র ফাটল” ~ যেখানে অনেকসময় যুক্তি // যুক্তিহীনতা // প্রতিযুক্তির (logic // logicless // anti-logic) ভেদাভেদ মিলেমিশে যেতেই পারে।অর্থাৎ সহজ ভাষায় ~ ব্রহ্মাণ্ডে থাকা অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব পেরিয়ে যাকিছু থাকে বা না থাকে; এর প্রত্যেকেরই যেকোনো কিছুতেই রূপান্তরকরণ সম্ভব।আরো সহজ করে প্রকাশ করার চেষ্টা করলে ~ যা আছে সেসবকিছুর পরিবর্তন এবং যা নেই তা অপরিবর্তিত নয় : এসবই হলো সম্পর্ক স্থাপনের ও যাপনের ক্ষেত্রে আন্তঃসম্পর্কিত নিয়মের ফাটল।যার মানে ~ কি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং যা খুশি তাই’ই ঘটতে পারে // হতে পারে।এখানে সবকিছুই আছে (যা অদৃশ্য ও অস্পষ্ট ~ সে সবেরই অবস্থানগত যোগ্যতা স্বাধীন ও কোনোরকম বন্ধনহীন।বিষয়টা অগোছালো ও অসম্পৃক্ত।অবশ্য এই বিষয়টি নিয়ে, শামীম যেভাবে ব্যবহারিক প্রয়োগগুলি করেছেন ~ আমরা আসবো সে কথায়
ঘোড়াউত্রা প্রকাশনী’র এই সিরিজটির অন্তর্গত বইগুলিতে বিশেষ আকর্ষণ অবশ্যই প্রচ্ছদ বা কভার।এই বইটিতেও তার ব্যতিক্রম নেই।অতএব, কিছুকথা এ সম্পর্কিত আলোচনা করতেই হয়।প্রচ্ছদটিকে আপাতভাবে দেখে যা মনে হয় ~ অজস্র প্রতিফলিত ছায়া’র কোলাজে একটি মুখাবয়ব : য্যানো মুখাবয়বটি থেকে অজস্র ক্ষয় রূপান্তরিত হয়ে চলেছে অসংখ্য বাতাসে; যা স্তরীভূত হচ্ছে অনির্দিষ্ট কিছু উদ্দ্যেশ্যে ও অনির্ণীত অভিমুখী।কুঁচকে যাচ্ছে // সংকুচিত হচ্ছে মুখাবয়ব আকার; স্পষ্ট হচ্ছে অন্তর্নিহিত শূন্যতা অথচো স্বাভাবিক অভ্যস্ততা’য় ধরা পড়ছে না ~ ঠিক যেরকম বাতাস অদৃশ্য এবং অন্তর্মুখী।গোটা বইতে মোট একুশটি কবিতা ~ কবিতাগুলি স্বল্পদৈর্ঘ্য // নাতিদীর্ঘ // উদগঘদীর্ঘ, দূরত্বরেখা সাপেক্ষে দেখলে; কিছুটা টেক্সট্ গঠনশৈলী প্রভাবিত।

এবারে, বইটি থেকে সামান্য কবিতাংশ্ ~ বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনে; তারপর “যুক্তির ফাটল’ বিষয়টির পরবর্তী পর্যায়ের পুনরালোচনা।প্রথম কবিতা, শিরোনাম “শৈশব গ্রাম” ~ “একদিন ইঁদুরের গর্ত থেকে সমস্ত দাঁতেরা বেরিয়ে এসে শোনাবে // শৈশবের গল্প। // গ্রন্থিত লোকপাঠ হতে দূরে আরো দূরে শৈশব গ্রাম। // অমুদ্রীয় প্রেমের গহীনে যেখানে শব্দের হাহাকার।” এখানে ~ ‘ইঁদুরের গর্ত’ থেকে ‘দা্ঁত’; তারপর ‘শৈশটবের গল্প’ থেকে ‘অমুদীয় প্রেমের গহীনে’ বা ‘শব্দের হাহাকার’।এই প্রতিটা শব্দার্থ-ব্যবহার আন্তঃসম্পর্কিত নয়।সুতরাং অসংলগ্নতা বা অসীমতা বা অসম্পৃক্ততা এখানে এক যুক্তির ফাটল ধরে আস্তেআস্তে আত্ম-নির্মিত।আমরা জানি, সাধারন যুক্তি দিয়ে এই শব্দার্থগুলির কোনোটিরই শব্দার্থতা’কে ব্যাখ্যা করা একপ্রকার অসম্ভব।আর এই অসম্ভব বিন্যাসটিকে গাঁথা হয়েছে যুক্তিহীনতা’র স্থানাঙ্ক অনুসরণ করেই।এরকমই আরেকটি কবিতা থেকে খানিক কবিতাংশ আরেকবার; শিরোনাম ‘কারণ’ / যেখানে ওপরে বর্ণিত পূর্ববর্তী কবিতাটি নিয়ে আলোচনার অংশটি আরো সুন্দরভাবে পাঠকের কাছে ধরা দ্যায় ~ “সবকিছুর সবকিছুই কারণ হতে পারে ভেবে তুমি হারালে সন্ধ্যালোকে। // কোনোকিছুর কোনোকিছুই না জেনে একা একা। // তবু যাপনেই নাকি জীবন।তবে জীবনের প্রকাশ হচ্ছে শব্দের কারসাজি!” : এখানে আমরা যুক্তি এবং যুক্তিহীনতা’র এক অদ্ভুত মিশেলে পেয়ে যাচ্ছি ‘জীবন প্রকাশের একটি ভিন্ন মাধ্যম শব্দের কারসাজি’।
আন্তর্জাতিক কবিতায়, পরাবাস্তববাদী ও প্রকাশবাদী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় হলো যৌক্তিক ফাটল বা লজিক্যাল্ ক্র্যাক্; যা আরো ভবিষ্যৎে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে জন্ম দিয়েছিলো ‘প্রতি-কবিতা’ বা ‘অ্যান্টি-পোয়েট্রি’।যদিও, বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী ঘরানায় এই ‘লজিক্যাল্ ক্র্যাক্’ বিষয়টি নিয়ে কাজ হলেও, এটি যথেষ্ট পরিমাণে পাঠকের কাছে আলোড়িত হয় ভবিষ্যৎে ঘটা অধুনান্তিক পর্যায়ের কবিতায়।চিরাচরিত প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যদিও এসব নিয়ে অবিশ্যি চর্চা কখনো হয় নি বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনায় জারিত পাঠকবর্গ কখনো চর্চার সুযোগ গড়ে নিতে পারেন নি (সেইসব পাঠক, যাঁরা প্রতিনিয়ত যেকোনো কিছুরই সহজ ও নিটোল মানে বোঝার চেষ্টা করেন, না বুঝলে দুর্বোধ্যতা’র বিভাগে কবিতাকে পর্যবসিত করেন)।তা সত্ত্বেও এটা বলাই যায় ~ ব্যাকরণনুযায়ী বাক্যের তিনটি প্রধান শর্ত ‘যোগ্যতা, আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি সম্পন্ন পদসমষ্টি’কে চ্যালেঞ্জ জানায় এইসব নিরীক্ষাধারা।আসুন পাঠক, আমরা আরো একটি কবিতায় এই ব্যাপারটি দেখা যাক : শিরোনাম “টিস্যু’ ~ “দু’হাত রেখে, তুমি ডানা নিয়ে উড়তে চাইলে। // উত্তরপত্রে আমি অগোছালো।চাকরির পরীক্ষায় অকৃতকার্য।চোখে সিঁদুর মেখে, লাল পালকে মুড়ে তুমি শেষমেশ উড়েই গেলে।আমি আজও হাঁটছি।পা দুটো এখনো চাকা হতে পারে নি। // এ্যাই সব আবেগঘন নিঃশ্বাস।কোকের বোতলের বুদবুদে যেদিন তোমার কপালের ঘাম ঝরিয়েছিলো, ঘামমোছা টিস্যু পেপারটা এখনো আমার কাছে।বিকেলবেলা অনেক পাখি দেখি, উড়ছে।টিস্যু দিয়ে উড়োজাহাজ বানিয়ে রাখি।পাখিরা উড়ে যায়, উড়োজাহাজ উড়ে না।” ~ এখানেও সেই দ্বান্দ্বিক সমাপাতন পার করে লজিক্যাল্ ক্র্যাক্।
এবার কিছুকথা বলা যাক, যা প্রত্যাশিত ছিলো কিন্তু দ্যাখা গ্যালো না।যেমন ~ ‘আমি/তুমি’ যাতীয় অতিরিক্ত শব্দার্থ প্রবণতা কিছুটা সহজবোধ্যতা আনতে গিয়ে সম্ভবত; এবং তা অহেতুক কারণ সহজলভ্যতায় বিশ্বাসী পাঠকের চেয়ে কবিতার প্রতি দায় রাখাটা বোধহয় অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়।দ্বিতীয়ত, শব্দের বা বাক্যকাঠামোর অতি সরলীকৃত প্রয়োগ ~ একথা বুঝতে হবে, এই ধরনের বহুরৈখিক ও বহুচিত্র উপাদান বহনকারী কবিতায় বিষয় নয়, প্রকাশের ভাঙচুর’টিই সতত প্রকৃত বিশেষ।তৃতীয়ত, যতিচিহ্ন প্রসঙ্গটি নিয়ে বারংবারই নিরীক্ষাপর্বের কবিতা লিখিয়েদের নতুন করে ভাবতে বলি।
তবুও এতোকিছু সত্ত্বেও বলবো ~ পাঠকবর্গ, এই নতুন চিন্তাপর্বের নিরীক্ষাগামী ভাবী প্রজন্মকে একবার পড়ে নিন, চেখে দেখুন লজিক্যাল্ ক্র্যাক্ বিষয়টি।আর আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি ~ শামীম ভবিষ্যৎে এসব ছোটোখাটো বিপত্তি কাটিয়ে আরো ভালো করবে; আরো নিরীক্ষায় নিজের চর্চাপথকে আরো তীব্রতম করবে।আসুন আমরা নজর রাখি তাঁর লেখার ওপর।আজ আপাতত এটুকুই।পরের সপ্তাহ আবার

আলোচনা : রাহুল গাঙ্গুলী

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।