বইমাত্রিক রাহুল গাঙ্গুলি

অবচেতনাময় স্বতোঃল্লাস

(১টি পরাবাস্তববাদী যাত্রাপথে ভিন্নতর প্রকাশ)

বই : ভুল চিকিৎসার মৃতদেহ
কবি : জয়দীপ মৈত্র
প্রকাশনা : আকাশ
প্রচ্ছদ : দেবনাথ দাস
১ম প্রকাশ : ২০১৭

পরাবাস্তববাদী কবিতা বা স্যুরিয়ালিস্ট ধারনায় কবিতা লেখার সূত্রপাত গত শতকের দ্বিতীয় ভাগে ইউরোপে।যখোন ডাডাবাদীরা চেয়েছিলেন ~ প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, তাকে অস্বীকার করে শিল্পচর্চা ও পর্যবেক্ষণকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল ভেদ করে পৌঁছাতে পারা যাবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্যের আধার বিস্তৃত এবং তা কেবলমাত্র মনোজগৎের অবচেতনেই বিরাজ করে।
পরাবাস্তববাদী মতবাদের মূলকথা অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে অপ্রচলিত অদ্ভুত ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা; আর পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল সেইসব কাল্পনিক রূপকল্পের আশ্রয়দায়ী কৌশলের মাধ্যমে সময় ও অবস্থান সম্পর্কিত বস্তুর সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনা।
বাংলাভাষায় গত শতকের তিরিশের দশকের শেষভাগে মূলতঃ কবি জীবনানন্দ দাশের হাত দিয়ে এই পরাবাস্তববাদী কবিতা’র প্রথম প্রচলন আমরা দেখেছি।পরবর্তী পর্যায়ে পরাবাস্তবতা’র কবিতা ইউরোপীয় রোমান্টিকধর্মীতার পাশাপাশি সমান্তরাল জায়গাই শুধু করে নি, বরং নানান্ ভিন্নতর বাঁক বদলের মধ্যে দিয়ে সূচিত হয়েছে।সহজ কথায়, যেখানে ধারনার বিস্তৃতি পরিণত লাভ করে মনোজগৎের অবচেতনাময় কল্পনায়; আর কল্পনার বিস্তৃতির মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ড ও জগৎ।এই কথাটির ধারনা আমরা প্রাচীন মহাভারতেও পেয়ে থাকি; যখন যুধিষ্ঠির বলে ওঠেন ব্রহ্মাণ্ডের সর্বাপেক্ষা দ্রুতগামী বিশেষটি হলো ‘মন’।ফ্রয়েডীয় ডিকশনের ফলস্বরূপ যতোই ইউরোপীয় স্যুরিয়ালিস্ট আন্দোলন বিভিন্ন খন্ডে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক, বা একসময় শেষ হয়ে যাক ~ পুঁতে দেওয়া বীজ থেকে যে একসময় মহীরুহ সৃষ্টি, একথা অস্বীকার্য নয়।বাংলা কবিতাতেও দুই বাংলা মিলিয়ে ~ কখনো, ‘সত্য’র খোঁজে, কখনো ‘স্বপ্ন’র খোঁজে, কখনো সমান্তরাল আধ্যাত্মবাদীতায় ~ বিভিন্ন মাত্রার রূপকল্পে পরাবাস্তববাদী কবিতা’র ভরকেন্দ্রটি বিভিন্ন বৃত্তীয় বলয়ে চর্চিত হয়েছে।এমনকি, গত শতকের আশির দশকের শেষভাগে যখোন বাংলা কবিতায় অধুনান্তিক চিন্তার প্রভাব লক্ষনগুলি শুরু হয়েছিলো ~ পরবর্তী এক পর্যায়ে দেখা গিয়েছিল পরাবাস্তববাদী ও অধুনান্তিকতা’র বহুরৈখিক মিশেল্।আর এই জায়গাতে দাঁড়িয়েই, কবি জয়দীপ মৈত্রের এই কবিতার বই ‘ভুল চিকিৎসার মৃতদেহ’ ~ পরাবাস্তববাদী চর্চায় ভিন্ন মাত্রার সাপেক্ষে, বাংলা কবিতায় নতুন সংযোজনা।

প্রথমেই বইটির প্রচ্ছদ বিষয়ে বলা যায় ~ শিরোনামের সাথে সঙ্গতকারী স্পষ্ট, একটি পর্বান্তরের মধ্যে দিয়ে একটি মৃতদেহের পুনরায় চেতনাসঞ্চার হওয়া।আর পর্বান্তরটি একটি কেন্দ্রবিন্দু’র ক্রমশঃ স্ফীত ও বিস্তৃত হয়ে ওঠা ~ মৃতদেহটিকে খুলে দিয়েছে প্রবেশদ্বার।যার সাপেক্ষে মৃতদেহের কোমর বরাবর ঘটে গেছে দৃশ্যান্তরের বৃত্তীয় কার্ভ (circular curve), যার ওপরে সাদা বা রূপকল্প স্বচ্ছ এবং নীচে কালো বা রূপকল্প অস্বচ্ছ।মৃতদেহটির অভিমুখ সেই অস্বচ্ছতা’র দিকে; যা থেকে বলতেই পারি তার অদৃশ্য চরিত্রায়ন পাঠকের দৃশ্যমানতা’র সাপেক্ষে।একথা আরো পরিষ্কার হয়, যখোন দেখি বইটির উৎসর্গ করা হয়েছে “অন্যমনস্ক এক ডুবুরিকে” এবং যার যাত্রাপথের শুরুটাই ~ “ভুলও একটা পথ / সারারাত্রি শুধু জুতোর জন্য চিৎকার করেছিলো”।
মোট দু-ফর্মার বই, কবিতাসংখ্যা ছাব্বিশ; যার একটিমাত্র তিন-কবিতার সিরিজ এবং অবশিষ্ট সবকটিই স্বল্পদৈর্ঘ্যের সোলো কবিতা।যদিও দৈর্ঘ্য কম, তথা শব্দার্থ সংখ্যায় কম; তা সত্ত্বেও প্রতিটি কবিতাই অপার মনোরূপকল্পনা’র বহুরৈখিকতায় বিস্তৃত এবং বিমূর্ত ও অসীম অভিমুখীন তাদের প্রতিফলিত রেশ।য্যামোন, প্রথম কবিতা ‘শুকিয়ে যাওয়া বিষয়ে’ ~ “ছুঁচ দিয়েও ফুল তৈরি হয় / রুমাল এমন বাগান / সুতোর ভেতর দিয়ে / সেসব ফুলের কাছে / নিঃশব্দে ঠিক পৌঁছে যায় জল” ~ খেয়াল করলেই দ্যাখা যাবে বহুস্তরীয় রেশ, যেখানে ছুঁচ/ফুল/রুমাল/বাগান/সুতো : সবই ভিন্নভিন্ন আবহ-স্তর, জড়িয়ে আছে পরস্পর সম্পৃক্ত জল স্তরটির দ্বারা, যার চরিত্র নিঃশব্দ, যা চরিত্রগতভাবে বিমূর্ত অভিমুখিন।এরকমই আরো একটি কবিতা যদি পড়া যায়, শিরোনাম ‘সেলাইমেশিন’ ~ “তুলোচাষ থেকে কতদূরে থাকে ক্ষত / কখনওই দোষ দেওয়া যায় না // কোনোকিছু অর্ধেকটা পোড়ার অনুভূতিই দরজা // অথবা জল / যে পাথর আঘাত করতে ভুলে যায় / ভাঙা কাচে তাকেই তো খুঁজি” ~ বহুস্তরীয় শুধু নয়, বহুরৈখিক রূপকল্পনা।আর শুধুমাত্র সেটাই নয়, প্রতিটি ক্রিয়াদির চরিত্র একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এটাই স্পষ্ট হবে ~ তারা সকলেই বিমূর্ততা অভিমুখী।এভাবেই সবকটি কবিতাতেই সহজ শাব্দিকতায় বহুদূরগামী বিস্তৃতি’র আবেশ।আরেকটি কবিতা, শিরোনাম ‘প্রেসক্রিপশন’ ~ “উলটো করে জীবনের দিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে // রক্ত আর কান্না ধীরে ধীরে মাথায় গড়িয়ে আসে // হয়তো এটাই আরোগ্য / ওষুধের শিশি আচমকা ফুরিয়ে গেলে / নিজেকে যেমন দেখি ফাঁকা চামচের ভেতর”

পরিশেষে কিছু মতান্তর জানিয়ে, আজকের পর্বটি শেষ করবো ~ যার মধ্যে প্রধানতঃ – (১) গঠনশৈলীতা নিয়ে বৈচিত্র্যের অভাব; অর্থাৎ গঠনগত যে জায়গাটি নিয়ে প্রচলিত নন্দনতত্ত্বকে নস্যাৎ করে একটি নতুন আবহ আনাই যেতো এবং (২) শব্দার্থে অভ্যন্তরীণ গতিশক্তিটিকে মুক্ত করার বিষয়ে উদাসীনতা; অর্থাৎ শব্দার্থ ভেঙে নতুন কোনো আবহ তৈরি করার প্রবণতা না থাকা ~ যা হয়তো নতুন কিছু স্বতন্ত্র মাত্রা সৃজন ও বুনন করতেই পারতো।তবুও আশা করি, ভবিষ্যৎে কবি নিশ্চিতভাবে এসব নিয়ে ভাববেন বা আরো স্পষ্ট কথায় নিরীক্ষা-প্রবণতা ও আরো স্বতন্ত্র কিছু প্রয়োগে আগ্রহী হবেন।যা কবিতাগুলিকে পরাবাস্তববাদীতা বা অধুনান্তিকতা ~ এমন প্রচল আবহকে সরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন স্বরশৈলি গড়ে তুলতে বিশেষ নিয়ন্ত্রক হবে।আমরা আশা করতেই পারি, বাংলা কবিতার সময়োচিত সঠিক প্রয়োগপদ্ধতি’র প্রতি যত্নবান হয়ে, এমন কবিতা-ক্যাওস উল্লসিত হবে অচিরেই

আলোচনা : রাহুল গাঙ্গুলী

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।