|| আ মরি বাংলা ভাষা || সংখ্যায় ঋত্বিক গঙ্গোপাধ্যায়

একটি ইঁদুরের আত্মকথা

আমি নরহরি মাহাতোর ইঁদুর। বিগত দুই বছর ধরেই ওনার সাথে আছি। নরহরি মাহাতো মানবাজার টাউনের বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে চোঙা ফুঁকে ইঁদুর মারার বিষ বিক্রি করেন। এরকম মানুষ আপনারা পথচলতি দেখেছেন নিশ্চয়ই। এদের হাতে একটা প্ল্যাকার্ড ঝোলানো থাকে। তার নীচের দিকের ফ্রেমে সেঁকো বিষের প্যাকেটগুলো লটকানো হয়। প্ল্যাকার্ডে একটা প্রমাণ সাইজের মৃত ইঁদুরের ছবি। ছবিটা ঘষা ঘষা,যেন বিষ খেয়ে ইঁদুরের এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে। এত কঠিন শব্দবন্ধ বললাম বলে ভেবে ফেলবেননা আমি শাপভ্রষ্ট রাজপুত্র বা দেবতা গোছের কিছু। ওসব রুপকথায় হয়। টাউনের চৌহদ্দি পেরোলেই রুখাসুখা ক্ষেতখামার চোখে পড়ে,তারই কোন একটা আলের ভেতর আমার জন্ম। খুদকুঁড়োর জীবন আমাদের। কোন একটি বসন্তের ভোরবেলা নরহরি মাহাতো আমাকে ফাঁদ পেতে ধরে। ফাঁদের ভেতর পাঁউরুটির টুকরো রাখা ছিলো। আমি কোনদিন এমনটা খাইনি। লোভে লোভে ধরা পড়ে গেলাম। তারপর থেকেই মানবাজার বাসস্ট্যান্ডের পাশে আমার সারাদিন কাটে। আমাকে একটা খাঁচার মধ্যে রেখে নরহরি মাহাতো সেঁকো বিষ বিক্রি করে।প্ল্যাকার্ডের নীচে আমার খাঁচাও আটকানো থাকে। বিষের প্যাকেটগুলো হাওয়ায় দোলে,আমিও দুলি। কেন নরহরি মাহাতো আমাকে এভাবে প্রদর্শিত করে? মার্কেটিং ট্যাকটিক্স হতে পারে। আবার একটা কঠিন শব্দ বলে ফেললাম। ইঁদুর হয়ে এইরকম বিদ্যে জাহির করা ঠিক নয়। মাপ করবেন।
নরহরি মাহাতোকে একটা ব্যাপারে ধন্যবাদ দিতেই হয়। ওর দৌলতে নানারকম জায়গা দেখা হয়েছে আমার। যেমন বেলপাহাড়ি আর্মি ক্যাম্প। ভেতরে ঢুকতে পারিনি অবশ্য। দেশরক্ষকদের তাঁবুতেও হতভাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী ( আক্ষরিক অর্থেই) ইঁদুরের উৎপাত বন্ধ করার ফিকিরে সেবার নরহরি মাহাতো বেশ দুপয়সা কামিয়েছিলেন। ক্যাম্পের উঁচু পাঁচিল, কাটাঁতারের মুকুট তার ওপরে। খুব গম্ভীর মুখ করে মিলিটারি ভাইরা টঙে চড়ে বসে আছেন। দারুন গা ছমছমে ব্যাপার। এই কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও ইঁদুরের পাল ঢুকছে কি করে ভেবে কূলকিনারা পাইনি। যাইহোক ঢুকছে যখন, একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। কিভাবে যেন খবর পেয়ে নরহরি মাহাতো সেখানে হাজির হয়েছিলেন। সাথে আমি।আমাকে স্বাভাবিকভাবেই ভেতরে ঢোকানো হলোনা। প্ল্যাকার্ডের সাথে বাইরেই পড়ে থাকলাম। নরহরিকে আচ্ছাসে সার্চ করে ভেতরে ঢোকানো হলো। নিজের পশরা প্রায় খালি করে তার কি আনন্দ সেদিন! মানবাজার সব্জী মার্কেটের পেছনদিকে একটা চোলাইয়ের ঠেকে সেদিন সন্ধেটা কাটলো আমাদের। ঠেকের ঘোলাটে আলোয় আমি চুপচাপ নরহরির উচ্ছিষ্ট ছোলাভাজা খেলাম পেটপুরে। এরপর ঠেকের সামনে গড়াগড়ি দেওয়ার অপরাধে উনি এবং আমি একসঙ্গে গলাধাক্কা খেলাম। সেটা খুব একটা অপমানজনক ব্যাপার নয়,বিশেষ করে একজন ইঁদুরের জন্য তো নয়ই। কিন্ত এই ঘটনায় নরহরি মাহাতোর চরিত্রের একটা দিক দেখতে পেলাম যেটা আগে আমার কাছে অজানা ছিলো। অপমানবোধ। জ্ঞান হওয়ার পরে সেই যে নিজের ঝুপড়িতে গিয়ে তিনি ঢুকলেন, প্রায় সাতদিন স্রেফ জল আর বাসি বিস্কুট খেয়ে ছিলেন। আমার তো ত্রাহি ত্রাহি হাল। নেহাৎ খুব কড়া জান,,,আর জলের বাটিতে জল ছিলো বলে সেবার প্রাণ যায়নি।
– বিয়েশাদি হলো নাই। পুরান বাড়িটা ভাইরা খায়্যা নিলো। দমে কষ্ট, কিন্ত হামারে কুনোদিন কাঁইন্দতে দেখেছিস?
নরহরি মাহাতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আমার দিকে। আমি চুপ থাকি।
– এই তো পত্থে পত্থে কেটে গেলো এতটা বছর। কোন অভিযোগ জানাইনছি কাউকে?
আমি ভাবলাম এই ফাঁকে ” ক্ষিদে পেয়েছে ” অভিযোগটা জানানো ঠিক হবে কিনা। তারপর ভাবলাম – থাক। মনের কষ্ট উগড়ে দিক লোকটা। আমি ছাড়া ওর কেই বা আছে।
– তবে আজ কেন এমন অপমান! “
হাহাকারে গলা চিরে যায় তার। টলতে টলতে উঠে গিয়ে জল খায়। তারপর নোংরা ক্যাম্পখাটে উপুড় হয় পড়ে ভেউভেউ করে কাঁদে। আলোআঁধারি ঝুপড়ির হাওয়া ভারী হয় আসে। আমার ঘুম পায়। ক্ষিদেপেটেই ঘুমিয়ে পড়ি।
কথায় বলে, চিরদিন কারো সমান নাহি যায়। ইঁদুর হলেও এটা আমার জানা। সেবার ধানের মরসুমে হঠাৎ হুগলী গিয়ে হাজির হলেন নরহরি মাহাতো। আমাদের রুখাসুখা একফসলি জমিতে ইঁদুরের উপদ্রবও একফসলি। হুগলি জেলাতে তেমনটা নয়। যেমন ফলন, তেমন নাকি ইঁদুরের উৎপাত। কাকের মুখে খবর পাওয়া গেলো সেঁকো বিষের নাকি হেবি ডিমান্ড ওখানে। অতএব আমার অন্নদাতা আর আমি দুজনে হাজির হলাম। পরে জানা গেলো পুরো কেসটাই ঝুল। মানবাজারের ক্ষেতখামারের সরল ইঁদুর আর হুগলির তিলেখচ্চরের মধ্যে অনেক তফাৎ। নতুন জায়গা দেখার আনন্দটাই শুধু ফাউ। প্ল্যাকার্ডের সাথে ঝুলতে ঝুলতে আমিও দেখলাম নাবাল জমির ওপর বর্ষার নীল মেঘ ঝুলে আছে। সিঙ্গুর বলে একটা জায়গা পেরোনোর সময় রাস্তার ওপর প্রচুর হট্টগোল দেখে আমরা সেদিকে উঁকিঝুঁকি মারি। নরহরি সেখানেও কয়েকটা প্যাকেট বেচেছিলেন। সেগুলো পরে কি কাজে লেগেছিলো আমি জানিনা তবে একজন নেতাগোছের লোক হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে হিড়হিড় করে স্টেজে তুলে এনেছিলো। সাথে আমাকেও, কারন নরহরির ঘাড়ে প্ল্যাকার্ড আর প্ল্যাকার্ডের আঙটায় আমি।
– ভাইসব। এনাকে দেখুন। একজন অসহায় সেঁকো বিষ বিক্রেতা। চাষীভাইদের প্রকৃত বন্ধু। কারখানা হলে ইনি কোথায় যাবেন? মানে একজন কৃষকই নয়,তার সাথে মারা পড়বেন ইনিও। তাই বলছিলাম ভাইসব..
মোদ্দাকথা হলো এই যে স্টেজে ওঠার পর নরহরি মাহাতোর মধ্যে চাষী হবার উদগ্র বাসনা জেগে উঠলো। আপাতত অন্যের জমি গরু লাঙল ভাড়া করে চাষ – তারপর টাকা জমলে নিজের জন্য কিছু। জমি আন্দোলন ওনার মনেও চাষী হবার স্বপ্ন বপন করেছিলো। মুশকিল হলো আমাকে নিয়ে।
– আমাকে নিয়ে কি করবেন নরহরি বাবু?
চিন্তান্বিত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম ওনাকে।
– আমাকে দিয়ে তো হালচাষ করানো সম্ভব নয়। আমি ফসলের শত্রু।
নরহরি নিরুত্তর।
– হ্যাঁ, একটা রফা করা যেতে পারে। আপনি আমাকে মুক্তি দিন,আমি আপনার ক্ষেত পাহারা দেবো। অন্তত ইঁদুরদের হাত থেকে বা বলা ভালো দাঁত থেকে আপনাকে কোন চিন্তায় পড়তে হবেনা।
এবারেও তিনি কিছু বললেন না।
আসলে আমার” চিক চিক চ্যাক চ্যাক” ওনার বোধগম্য হয়নি। বুঝতে পারলেও অবশ্য উনি সেটাই করতেন যে আইডিয়াটা ওনার মাথায় সুড়সুড় করছিলো কারন ইঁদুরে আর মানুষে কোন রফা হয়না।
উনি আমাকে বিষ দিলেন। আটার গুঁড়ো পাকিয়ে পাকিয়ে পরম মমতায় হাফ প্যাকেট সেঁকো বিষ গুঁজে দিলেন গোটা তিনেক লাড্ডুর মধ্যে। আমি মানুষ হলে বিপদটা বুঝতে পারতাম। নরহরি মাহাতোর ওপর রাগ হওয়াও খুব অন্যায্য হতোনা। কিন্ত ইঁদুরের মতো নিম্নস্তরের জীবদের এসব অনুভূতি থাকতে নেই। তাই আমি লাড্ডুগুলো খেলাম। তারপর আমার ভীষণ তেষ্টা পেলো। ভয়ঙ্কর মাথা ঘুরছে।ততক্ষনে নরহরি আমাকে খাঁচা খুলে ছেড়ে দিয়েছেন। ওর বাড়ি থেকে মাইলটাক দূর অব্দি গিয়ে আর টানতে পারলামনা। চোখের সামনে পৃথিবী বিলুপ্ত হয়ে গেলো।
জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম একটা ক্ষেতের পাশে শুয়ে আছি। গতকাল রাত্রে দৌড়তে দৌড়তে কখন যে টাউনের সীমানা পেরিয়ে এসেছি জানতেও পারিনি। খুবই আশ্চর্য লাগলো নিজেকে বেঁচে থাকতে দেখে। মাথাটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হওয়ার পর মনে পড়লো নরহরি মাহাতোর বাড়িতে কয়েকটি নেংটির কথা। সেঁকো বিষবিক্রেতার বাড়িতে ইঁদুর থাকবেনা,সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্ত থাকতো। কয়েকটা অকুতোভয় নেংটি ঠিক টিঁকে ছিলো সেখানে। আক্ষরিক অর্থেই বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা কেস। ওদের আলোচনা থেকেই শুনেছিলাম যে এই বিষ ইঁদুরদের পেড়ে ফেলতে পারলেও শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকলে কেউ কেউ বেঁচেও যায়। ওরা সেরকমই বেঁচে গেছিলো। আমি উচ্চবর্ণীয় ধেড়ে বলে নীচুজাতের আলোচনায় অংশগ্রহণ করিনি, নয়তো ভালো করে জেনে নিতে পারতাম ওরা কিভাবে নিজেদের আবার সুস্থ করে তুলেছিলো। ” বিচ্ছিন্নতাবাদকে আর প্রশ্রয় দেবোনা ” প্রতিজ্ঞা করলাম মনে মনে। ভাগ্য ভালো একটা খেজুরগাছের নীচে গজিয়ে ওঠা কাঁটাঝোপের মধ্যে গিয়ে সেঁধিয়েছিলাম বলে প্যাঁচাদের চোখে পড়িনি। জ্ঞান ফিরে আসার পর একটা শিয়াল আমাকে শোঁকাশুঁকি করে চলে গেলো দেখলাম,ছুঁলোনা। বোধহয় বুঝেছে – পেটে বিষ আছে। নীলকন্ঠ না হলেও নীলপেট হয়েছি। ইয়ার্কি নয়।
মোটামুটি হপ্তাদুয়েকের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমার বিষ খেয়ে হজম করার জন্যই হোক অথবা মনুষ্য সংসর্গের কারনেই হোক – স্থানীয় ইঁদুর সমাজে বেশ কেউকেটা হয়ে উঠেছি তদ্দিনে। তারপর বছর দেড়েক কেটে গিয়েছে। ইঁদুরজীবনের হিসেবে পৌঢ় হয়েছি।সংসার পেতেছি। সুখেই আছি৷
নরহরি মাহাতোর সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিলো। বলা ভালো ওর লাশের সাথে। সেটা একটা বড়োসড়ো পলাশ গাছের ডাল থেকে ঝুলছিলো। ফুলে ঢেকে যাওয়া গাছে নারকেল দড়ি দিয়ে নিজের গলাকে ভালো করে বেঁধে তিনি ঝুলে পড়েছিলেন। আমি কি একটা কাজে নিজের গর্ত থেকে কিছুটা দূরে গেছিলাম। বাসরাস্তা টপকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেছি – হঠাৎ দেখি এই দৃশ্য! বসন্তবাতাসে বডিটা আস্তে আস্তে দুলছিলো। তখন খুব ভোর, তাই কারুর নজরে পড়েনি। কৃষক আত্মহত্যা আগে শুনেছি, এবার দেখলাম। অবশ্য একটা সিজনেই ভোগা খেয়ে লটকে পড়া সেঁকোবিষ বিক্রেতাকে আমি কৃষক সার্টিফিকেট দিতে পারবোনা। আমার ধারনা তীব্র অপমানবোধই শেষ ডেকে এনেছিলো নরহরি মাহাতোর।
যে কোন আর্ট ফিল্ম নির্মাতার কাছে এই দৃশ্য হতো লুফে নেওয়ার মতো। ভোরের তেরছা আলো, পলাশের আগুন, ঝুলন্ত দেহ আর একটা ইঁদুর সেদিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে কি ভেসে উঠছিলো তখন? তৃপ্তি? দুঃখ? বিস্ময়?
নাঃ কিছুই নয়।খানিকক্ষন চোখ তুলে চেয়ে গোঁফটা তুড়ুক তুড়ুকু নাচিয়ে আমি আবার এগিয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের কোন অনুভূতি থাকতে নেই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।