|| নারীতে শুরু নারীতে শেষ || বিশেষ সংখ্যায় ঋতশ্রী মান্না

আকন্দের মালা

স্টেশন লাগোয়া বাজার–ট্রেন আসার,ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা শুনে শুনে ক্লান্ত একফালি রোদ চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে রাস্তাতেই– পাশেই মাটিতে বিছিয়ে রাখা একটা সাদা পলিথিন– গোটাকতক লেবু,কাঁচালংকা,রোদের তেজে ঝিমিয়ে পড়েছে তারা–পলিথিনটা বহু ব্যবহারে জীর্ণ,ধুলোমলিন; তদপেক্ষাও বেশি জীর্ণ তার মালকিনের মুখ,বেশবাস।
–“লেবু লাগবা না দিদি? কাঁচালংকা?”
বাজার করা প্রায় শেষ, তবু কেন জানিনা দাঁড়িয়ে পড়ি।
দেখি,দারিদ্র্য আর বয়সের অজস্র কাটাকুটিতে দীর্ণ মুখখানি ক্ষণিক হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে,বিক্রির সম্ভাবনায়।
এসব হাসির সামনে দাঁড়ালে,ভুলে যেতে ভালো লাগে যে আমি একটুও ঝাল খেতে পারিনা! বেমালুম ভুলে যেতে ইচ্ছে করে,ফ্রিজে থাকা গতকালই কেনা লেবুগুলোর কথা!
–“আচ্ছা,চারটে লেবু দাও,আর কাঁচালংকা একশ।”
কাঁপাহাতে চারটে লেবু তোলে সে,আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। পাশেই বসে থাকা বউটিকে ডাকে সে,”অ বউ কাঁচালংকাটা ওজন কর।”
পাশের বউটির ঝুড়িতে লাউশাক,সজনের নরম ডাঁটা।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে না পারাটি আমার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। ফলে,আলাপচারিতা জমে ওঠে অচিরেই।
-“বাড়ি কোথায় তোমাদের?”
কাঁচালংকা দাঁড়িপাল্লায় তুলতে তুলতে ঝর্ণার মত কলকল করে বউটি,লালগড়ের বসন্তপুর। সেই কোন সকালে বাসে করে এসেছে তারা।বুড়িটি তার শাশুড়ি।
কত গাছ তাদের বসন্তপুরে! এই লাউশাক,সজনেডাঁটা,লেবু,লংকা,সবই তো তাদের গাছের।
কত ফুলের গাছ,আকন্দ,ধুতুরা!
মনে হয়,কত কথা জমে ছিল তার এতকাল ধরে! প্রাথমিক জড়তার পাথরটি সরে যেতে দুর্বার গতিতে নেমে আসছে অবাধ ঝর্ণাধারা!
সে জানতে চায়,”শিবরাত্রি করো,দিদি?”
তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে চলে,”আমিও করতাম।তারপর বর যখন অন্য মেয়েকে নিয়ে গেরাম ছেড়ে পালিয়ে গেল,খুব রাগ হল শিবঠাকুরের ওপর,আর করিনি।সেও বছর পাঁচেক হয়ে গেল।
সব জমানো টাকাপয়সা নিয়ে চলে গেছল জানো!কত কষ্ট-ই না গেছে! তারপর শাশুড়ি বৌ মিলে এই ব্যবসা শুরু করলাম।”
সামান্য দূরেই স্টেশনচত্বরের অশোক গাছটায় ফুল এসেছে– লালে লাল গাছটা সদর্পে জানান দিচ্ছে,বসন্ত এসে গেছে।
মেয়েটির লাল টিপ,ঘামে গলে যাওয়া সিঁদুরে লাল হয়ে থাকা কপাল– আমার দৃষ্টি অনুসরণ করতে পেরে সামান্য হাসে মেয়েটি,”ভালোবেসেছিলাম তো একদিন,তাই পরি এখনও…”
আমি কখনও বসন্তপুর যাইনি,যাবওনা হয়ত কখনও।সেখানে কি বসন্ত আসে আদৌ? যদি আসে,তবে কেমন সে বসন্ত? এমন অর্থহীন সিঁদুরের মতই সেও কি নিরর্থক,উদ্দেশ্যহীন?
মেয়েটি হাসে,”শিবরাত্রির দিন সকাল করে চলে এসো দিদি,আমি তোমায় গেঁথে এনে দেব আকন্দফুলের মালা,ধুতুরার ফুল।”
এক অভিমানী নারী তার এযাবৎকালের সঞ্চিত সব অভিমান গেঁথে তুলতে চায় আকন্দের মালায়, তার ভাঙা সংসারের ধার ঘেঁষে ফুটে ওঠা ধুতুরায় সাজিয়ে দিতে চায় বসন্ত-অর্ঘ্য!
হয়ত এ অভিমান তার প্রিয় আরাধ্য দেবতার ওপর,হয়ত বা চারপাশের এই রক্তিম বসন্ত-আয়োজনের ওপর! বহুকালের নীরব অভিমানই কি উদ্বেলিত হয়ে উঠতে চায় পূজায়,প্রেমে ?
সে আবারও প্রশ্ন করে,”আসবে তো?”
আমি হাসি।
তারপর পেছনে ফেলে আসি দুটি অসমবয়সী নারী,তাদের জীবনযুদ্ধ,শহুরে পটভূমি জুড়ে বেড়ে ওঠা একটি পুষ্পিত অশোক,কোন্ এক অচিন বসন্তপুরে ফোটা ধুতুরার ফুল, আকন্দের মালা–এক অচেনা বসন্তকাল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।