গল্পেরা জোনাকি -তে ঋতশ্রী মান্না

ম্যাজিক গল্প

প্রতিটি ছোটবেলার নিজস্ব একটা রাস্তা থাকে,সকালের রোদ,গাছের ছায়া,মাঝপথে হঠাৎ এসে পড়া বিড়ালছানাটা—এসব পেরিয়ে হেঁটে যায় রাস্তা–সাইকেলের ক্রিং ক্রিং–গলি ছেড়ে বড়রাস্তা–তারপর,ব্যস্ত বড়রাস্তা যেখানে আরও ব্যস্ত একটা তেমাথা রাস্তায় মিশব মিশব করছে,সেখানেই ডানদিক ঘেঁষে,সাইকেলের ব্রেক কষতেন বাবা।
অল্প আলোর একচিলতে একটা দোকানঘর তার অন্তর্নিহিত ম্যাজিক নিয়ে আমার অপেক্ষায় থাকত এখানেই।দেওয়ালজোড়া কাঠের র‍্যাক,সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র বই অথবা এক পৃথিবী বিস্ময়।চোখে মোটা কালোফ্রেমের চশমা,মুখে খোঁচাদাড়ি –প্রবীণ মালিকটি মৃদু হাসতেন,যেন জানাই ছিল আমি আসব।
হাল্কা হাসি,কুশল বিনিময়,তারপর বাবা বাজারের ব্যাগ নিয়ে পথচলতি ভিড়ে মিশে যেতেন।আমি সেই পুরোনো দোকানঘরে,ততোধিক পুরোনো নড়বড়ে হয়ে আসা টুলে উঠে,হাতের নাগালে চলে আসা পৃথিবীর একাংশকে ছুঁয়ে নিচ্ছি তখন।পাশের শিবমন্দিরে ঘন্টার আওয়াজ,কেনাবেচারত মানুষের কলস্বর।বাইরে খদ্দেরের ভিড় সামলাতে ব্যস্ত প্রবীণ মালিক।
পৃথিবীর বেশকিছু ম্যাজিক আমার হাতের মুঠোয় তখন,—“সোনার চাবি কিম্বা বুরাতিনোর কান্ডকারখানা”,”নীল পেয়ালা”,”নাম ছিল তার ইভান”–এরকম আরও কত ম্যাজিক যাদের নাম আর মনেই পড়ছেনা এখন,অথচ চোখ বুজলেই দিব্বি ঢুকে পড়ছি সেসব ম্যাজিকে…
এমনই একটা রাশিয়ান ম্যাজিক আমার মুঠোবন্দী হয়ে বাড়ি এসেছিল এক ঝলমলে সকালে,যার মূল চরিত্রে ছিল তিনটি ভালুক আর জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া একটি বাচ্চা মেয়ে…
বহুযুগ পর সেদিন হঠাৎই খুঁজে পেলাম বইটা।
খোওয়া গেছে তার মলাট,শেষের পাতা সবই…বইয়ের নাম,লেখক আর অনুবাদকের নাম সবই তার সাথে সাথে…আর গল্পের শেষটাও…তবে ম্যাজিকটা রয়ে গেছে মাঝের হলুদ হয়ে আসা পাতাগুলোয়…
কোনো এক জাদুসন্ধেতে আমি সেই ম্যাজিক হাতে নিই,ছেলেকে শোনাই সেই শেষ না হওয়া ভালুকের গল্প–সেই যে রাস্তা ভুল করে ভালুকের বাড়িতে ঢুকে পড়ল মেয়েটি–তারপর বাচ্চা ভালুকের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল–শেষে তাড়া খেয়ে আবার ছুটতে শুরু করল জঙ্গলে…
…এরপর খোওয়া যায় পাতা।তারই সাথে খোওয়া যায় রাস্তা—-আমরা নিজেদের মত হারিয়ে যাই পাইনের বনে—-কোনোদিন বাচ্চা মেয়েটির সাথে দেখা হয় আমাদের—-আমরা তিনজনে লাল লাল চেরিফল তুলে ঝুড়ি ভর্তি করি—-কোনোদিন ক্লান্ত হলে জিরিয়ে নিই উইলোগাছের ছায়ায়—-একটি বহমান অন্তহীন ম্যাজিক আমাদের নিয়ে হেঁটে চলে অনন্ত অরণ্যের পথে পথে…
এভাবেই চলছিল। ইউটিউবে হঠাৎই একদিন দেখা হয়ে যায় সেই পরিচিত ভালুকের গল্পটির সাথে।সোৎসাহে দেখা শুরু করি,গল্পটার শেষে সত্যিই কী ঘটেছিল?—-
দেখলাম জঙ্গলের পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে মেয়েটি কখন বাড়ির রাস্তায় এসে পড়ল, আর বাড়িও পৌঁছে গেল।ব্যস্।যেন ঝুপ করে শেষ হয়ে গেল সেই ম্যাজিকটা,যেটা এতবছর ধরে কক্ষণো শেষ হয়নি।আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় ডিলিট করলাম গল্পটা।
ভাবলাম,ভাগ্যিস শেষের পাতাকটা খোওয়া গিয়েছিল!
সব গল্পকে নিয়মমাফিক ফুরিয়ে যেতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি?একটা ম্যাজিক গল্প থাকুক না এমন,শেষ না হওয়া—চলতে থাকুক,চলতেই থাকুক
—-ক্ষতি কী?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।