গল্পে ঋত্বিক সেনগুপ্ত

কলকাতায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঋত্বিক সেনগুপ্ত, ছোট ভাই মৈনাকের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন বাবার চাকরির সুবাদে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেক্ট ঋত্বিক এবং স্ত্রী পর্ণা বাঙালিয়ানাকে ভালোবেসে ছুঁয়ে থাকেন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কেও। শৈশব আর এখনকার কাজের খাতিরে খুঁজে পাওয়া দেশের বিভিন্ন স্বাদ গন্ধ মানুষের রীতিনীতির গল্প কল্পনার তুলিতে সাজিয়ে ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মত পরিবেশন করেন ঋত্বিক। কখনও বা কবিতায় ও ফুটে ওঠে নষ্টালজিক বাংলা, বর্তমান আর অতীতকে মিলিয়ে মিশিয়ে। নবনালন্দার ছাত্র ঋত্বিক তাঁর সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে তুলে দিয়ে যেতে চান পুত্রকন্যা তিথি ও দেবের হাতে। তিনি বলেন, পাঠকদের মতামত জানতে পারলে ভালো লাগবে।

অভিবাসী

শনিবারের বেলা পেকে বিকেল হয়েছে। কাল ২০ কিলো মুড়ি ফোটানোর আগাম পয়সা নিয়ে বাজার ফিরতি পুতুল একবার উঁকি মারল বেচু দরজির উঠোনে। খোঁজ নিতে, শহর থেকে, দেবুদা এসেছে কিনা। দেবু, বেচু দরজির মেজো ছেলে। ফুলিয়া সংলগ্ন এই গ্রামে তাঁতিই বেশী। দরজি বলতে বেচু বসাকেরা, দুই পুরূষ ধরে পরিচিত। প্রায় ৬০ – ৬৫ টা ঘর নিয়ে এই ফুলিতলি গ্রাম। তাঁতীদের আখড়া হিসেবে, ফুলিয়া, নদীয়া জেলার সুপরিচিত শহরতলি। আসলে, এখন ২০০০ সালে, বেশীরভাগ তাঁতী এই গ্রামেই থাকে। এখানকার মানুষ অন্তর্মুখি ও শান্তিপ্রিয়। শহর বলতে, এরা খানিক দূর-প্রান্ত বোঝে। সেই গ্রামে দেবু যখন ক্লাস টেন পাশ করে কলকাতা শহরে কোন এক খবর কাগজের ছাপাখানায় চাকরি পেলো, ফুলতলির বয়স্ক সকলে দেবুকে পাড়া-গাঁয়ের একপ্রকার আদর্শ মনে করলো – পুতুল ও তার সমবয়সি কিশোরীরা ও দেবুকে সজ্জন গণ্য করলো। বেচু দরজির ছেলে শহরে চাকরি পেয়েছে – এবিষয়ে নির্ভেজাল বিস্ময়, অনেক পড়শিই ব্যক্ত করলো।
পুতুল নিজের অনিচ্ছায়, স্কুলের পাট চুকিয়েছে ক্লাস সিক্স-এ। একটা কারণ ছিল স্কুলে মেয়েদের আলাদা শৌচালয় না থাকায়, কিশোরী মেয়েদের প্রয়োজনীয় আড়ালের অভাব। আসল কারণটা যদিও, পুতুলের বাবা, মদনের ধারণা, বেশী পড়াশুনো করলে, কাছাকাছি গ্রাম থেকে, সম্বন্ধ পাওয়া যাবেনা, মেয়ের জন্য। তার চেয়ে সে তার মাকে কার্পাস-ডলে তুলোর বান্ডিল বানাতে, ধান ভানতে আর মুড়ি ফোটানোয় সাহায্য করলে কাজ শেখার সাথে সাথে বাজারে-হাটে দুটো পয়সা আয় করবে। দায়ীত্ববোধ বাড়বে।
পুতুলের, সুপ্ত পড়াশুনোর ইচ্ছা। আর তাই যখন দেবুদা কলকাতা থেকে প্রতি শনিবার বাড়ি ফেরে, পুতুলের বই পড়ার ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে, তার জন্য কোন না কোন সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা নিয়ে আসে। যার পর নাই গোপনীয়তার সাথে, পুতুল সেই পত্রিকা ঘরে নিয়ে এসে পড়ে আর স্কুল যাবার সাধ মেটায়। পড়ার সাধ মেটার সাথে সাথে, শহুরে সমাজের চট-জলদি সাহিত্যের প্রসঙ্গের সাথে,।অকাল পরিচয় হয় পুতুলের। প্রথম-প্রথম, যদিও পত্রিকার পেছোনের পাতার শব্দছক বা ক্রস্ ওয়ার্ড নেশার মত টানত, আজকাল বরং ছোটগল্পের ঢঙ্ ও জটিলতা অনেক বেশী মনে ধরছে! মাঝে মধ্যে যে শব্দগুলো অচেনা লাগে, একফাঁকে সেই দেবুদার কাছেই মানে জেনে নেয়, পুতুল। স্কুলের চৌহদ্দির বাইরেই, বাস্তব শিক্ষালাভের এই সুযোগ, বড় আদরের, পুতুলের কাছে।
এই গাঁয়ে, তার ছেলে আর ভাইপো ছাড়া, সকলেই তাকে বেচুদা বলেই জানে ও ডাকে। দেবু শহরে চাকরি করে বলে, হয়তো গাঁয়ের মানুষ তাকে আজকাল ২ পয়সার বেশী খাতির করে – কিন্তু বেচুদা, তার দরজির পরিচয় ও ইজ্জতেই ভরসা রাখে। পুতুলের বাবা মদনের ক্ষেত্রেও তাই। তবে তার গোয়ালে তিনটা গরু ও সতেরো বিঘা জমির ধান থাকায়, তার পরিচিতির কিছু রকমফের আছে – মদনের দুধ বা মদনের মুড়ি খুব ভালো, এমন আশপাশের গাঁয়ের লোকও জানে। মিল বলতে আরো কিছু আছে, বেচু আর মদন, দুইজনই, মিষ্ট স্বভাবের মানুষ, এবং বিধাতা তাদের গনে-জনে-আয়োজনে যেটুকু দিয়েছেন সেই নিয়ে তারা দুজনেই তৃপ্ত ও সংসার-সুখী। বাপ ঠাকুরদার ভিটে ও কারবার আগলে তারা খুশী আছে।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে, তিন বছর হল চাকরি করছে দেবু। শহরে যাতায়াত করতে করতে বচন-বাচন-ধ্যান-ধারণাও পাল্টেছে তার। গেঁয়ো বিধি-নিষেধ অবজ্ঞা করার অনেক যুক্তি জমা হয়েছে দেবুর মনে। পাল্টেছে দৃষ্টিকোন ও পুতুলের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপন। পুতুল ও বুঝতে পারে। অনেকদিন ধরেই। আর দেবুদার দোষ কোথায় ? হাটে যাবার সময় খালপারে যে ছেলেগুলো ডাংগুটি খেলত, কোনদিকে হুঁশ থাকতো না, তারাও তো এখন সচেতনদৃষ্টিতে তাকায়। বাড়িতে মায়ের অকারণ উপদেশ, পুকুরঘাটে কাপড় কাচতে মানা – সব মিলিয়ে বোধে-অনুভবে পুতুল জানে তার ধরণ-গড়ন-চলনে নজর লাগার কারণ ঘটেছে। তবে এইসব কথা সে দেবুদা ছাড়া, আর কারো কাছে নালিশ করেনি।
দেবুদা ইদানিং কাছের মানুষ হয়েছে। পত্রিকায় ছাপা গল্পের মত, পুতুলের আশা ও ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার চিন্তা সঙ্গী। স্বপ্ন দেখার উৎসাহ পায় পুতুল। দেবুর সবকথা হালকা বাতাসের মতন তার শরীরে আলোড়ন তোলে। কেবল দেবুর শহরে গিয়ে থাকবার প্রস্তাবে, ভরসা পায়না।
জিগেস করে, “আচ্ছা, তুমি যে বলো সেখানে অনেক বেশী মানুষ থাকে, বিবাদ করেনা? একে অপরকে ভালোবাসে?”
” সব করে, বিবাদ করে, ভালোবাসে”
” কিন্তু আমি তো গাঁয়ের মেয়ে – আমাকে দূরে করে রাখবেনা? তুমি যখন কাজে থাকবে, কার সাথে কথা কইব? কোথায় যাবো? আমি তো কিছু চিনিনা! টিভিতে দেখায় কত খুন-খারাবি হয়!”
দেবু আশ্বাস দেয় “তুই যদি আমার কথা শুনে চলিস, দেখবি কত মানুষ তোকে ভালোবাসবে, খোঁজ খবর করবে।”
বেশ কিছুদিন পুতুলের প্রশ্নে দেবুর আশ্বাস চলল।
যেদিন ভয় কাটলো, সেদিন ওরা দুজনে বাড়িতে চিঠি রেখে শান্তিপুর লোকাল ধরে শিয়ালদহ নর্থে পৌঁছে, প্রথমে অটো, পরে ট্রাম ও তারপরে বাস ধরে কালীঘাট মন্দিরে উপস্থিত হল। বিয়ের পুজো শেষ করে, সোজা বেঙ্গল পটারিজের রেললাইন সংলগ্ন বস্তিতে। অল্প সময়ে শহরের এই ব্যাপ্ত আত্মপ্রকাশ, খানিক হতভম্ব করে দিয়েছে পুতুলকে।
কয়েকদিন ধরেপ্রশ্নের শেষ নেই, এত ভিড় কেন, এত জোড়ে হর্ন বাজায় কেন, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিনা তুমি কি করে শুনছ, এত ছোট পুকুর, জল কালচে কেন, রাস্তার আলো সারারাত জ্বলবে, সব কিছু কিনে খেতে হয়, আমি রোজ ঘরে একা থাকবো? তুমি যে বলেছিলে অনেক ভালো মানুষের সাথে আলাপ করিয়ে দেবে?
দেবু বললো, “তুমি যদি কথা শোনো, সব হবে। তুমিও আমার মত রোজগার করবে , ঘরে টাকা পাঠাবে, তারপর দেখবে তোমার বাপ-মা ও কত তোয়াজ করবে। রাজি? ”
“রাজি…” পুতুল খানিক ভয় মেশানো স্বরে বলে “আমি কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করি, তাই।তোমার কথা শুনে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।”
দেবু খুশী হয়ে বললো “তাহলে তোমাকে গাড়ি করে নিয়ে যাবো”।
নার্সিং হোম থেকে ফেরার পথে, কোনো কথা বললো না পুতুল। ভাবনায় হারিয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে বললো “বিয়ে করলাম তোমাকে, আর অন্য পুরুষ-মানুষের সন্তান পোয়াবো, এতে পাপ নেই?!”
দেবু বললে, “ওরা তোমার সাথে কত ভালো ব্যবহার করলো, তোমার খাওয়া-দাওয়ার দায়ীত্ব নিলে, মাসে একবার করে তাদের ঘরে নেমন্তন্ন করলে, পাপ করলে এমন হয়? ওরা তোমাকে খুব ভালোবাসবে”। “যাও ওই ক্যালেন্ডারে ঠাকুর রামকৃষ্ঞ আর সারদা মায়ের ছবি আছে, একবার পেন্নাম করে আশীর্বাদ চাও”।
পুতুল ক্যালেন্ডারের কাছে গিয়ে প্রণাম করে আবার ছবির দিকে তাকালো – ঠাকুরের বাণী লেখা , “তোদের চৈতন্য হোক”।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।