বাংলার অপরূপ প্রকৃতির পরশ মাখা হৃদয় গুলো আপন মনের সাযুজ্য মিশিয়ে নানান ঘটনাকে ব্যক্ত করে যে চিত্রের মাধ্যমে তাই হল লোক চিত্র।
ক.পট: প্রাচীন বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য লোকচিত্র পট। পটুয়ারা কাপড়ের উপর গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে তা শুকিয়ে তারপর নানান কাহিনী অঙ্কন করেন। পটে সাধারণত আলতা, কাঠ-কয়লা, ইটের গুঁড়ো, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি ইত্যাদির রং ব্যবহৃত হয়। তাছাড়াও সেগুনের পাতা ও খয়ের চুনের মিশ্রনে লাল, বাঁশ পুড়িয়ে কালো, অপরাজিতা ফুল থেকে নীল, বরবটি থেকে সবুজ ইত্যাদি থেকে রং প্রস্তুত করা হয়। পট ইতিহাসের ঘটনাবলী তথা বিশ্বযুদ্ধ,বোমাবর্ষণ ইত্যাদি ও পৌরাণিক কাহিনী তথা সীতাহরণ, মনসামঙ্গল, রাবণ বধ ইত্যাদি নানা বিষয় হতে পারে।
যারা পট লেখে অর্থাৎ পটুয়ারা বাংলায় আকার অনুসারে দুই ধরনের পটের উদ্ভব করেন- চৌকো পট ও বহ পট। চৌকো পট নিদর্শন পাওয়া যায় কালীঘাটের একক পটের মাধ্যমে এবং বহ পটে কোন গান বা কথকথার মাধ্যমে ধারাবাহিক কাহিনীকে প্রকাশ করা হয়।
বিষয় অনুসারে কে বা চার ভাগে বিভক্ত করা যায়-১.জাদু পট(উপজাতিদের জন্ম বৃত্তান্ত) ২. যম পট(যমরাজের বিচার বিষয়ক) ৩. গাজী পট(গাজীদের বীরত্বব্যঞ্জক) ৪. লীলা বিষয়ক (পৌরাণিক কাহিনী)।
পশ্চিম মেদিনীপুর, বিহার, ঝাড়খন্ড ইত্যাদি অঞ্চলে পটের উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে লোক চিত্রশিল্পীদের মাধ্যমে এই শিল্প জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অকৃত্রিমতার স্পর্শ।
খ. চালচিত্র:
পটের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা চালচিত্র, যা দেব দেবীর কাহিনী কে অবলম্বন করে প্রতিমার চালির উপরে বাঁশ, মোটা কাপড় ও কাদা রং এর সমন্বয় আচ্ছাদন রূপে ইহা প্রস্তুত করা হয়। দুর্গাপূজা নবদ্বীপের রাস ইত্যাদিতে প্রতিমার চালির উপরিভাগে অর্ধ গোলাকৃতি বাঁশের খাঁচায় কাদা শুকিয়ে খড়ির আস্তরণ দিয়ে কাহিনী অঙ্কন করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক রং ব্যবহৃত হয়।যেমন- সাদার জন্য খড়িমাটি,কালোর জন্য ভুসোকালি, নীল এর জন্য চাষের নীল, লাল এর জন্য মেটে সিঁদুর ইত্যাদি রং ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে চালচিত্র কিছুটা অবলুপ্তির পথে গেলেও নদিয়া, উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারে এই শিল্পের ছোঁয়া চির শাশ্বত হয়ে রয়েছে।
||লোক ধর্ম||
সমস্ত সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে সহজিয়াদের আদর্শে ও বৈষ্ণবদের প্রেমবাদ এর সমন্বয় প্রতিফলিত হয় লোক ধর্মে। এই লোক ধর্মের কয়েকটি আঙ্গিক পর্যবেক্ষণ করা যায়- ক. কর্তাভজা ও ভগবানিয়া: চৈতন্যদেব প্রচারিত ভক্তিবাদ ও পরবর্তীতে আউলচাঁদ ফকিরের সংস্পর্শে কর্তাভজা এবং আউলচাঁদ এর ২২ জন শিষ্যের মধ্যে একজন শিষ্য শিশুরাম প্রবর্তিত ধর্মমত ভগবানিয়া।
খ. ভগবানিয়া ও বৈষ্ণব: এই দুই ধর্মমত প্রেম ধর্মের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে।
তাছাড়াও ভগবানিয়া ইসলাম ও ভগবানিয়া বাউল লোক ধর্মকে ব্যক্ত করে। প্রকৃতপক্ষে লোকধর্ম সর্বধর্ম সমন্বয়ে প্রতিটি মানুষের ভাবাবেগকে প্রকাশ করে।
||লোক শিল্প||
লোকসংস্কৃতির সমস্ত ধরনের উপযোগিতা জীবন ব্যবস্থা ও জীবনের যেখানে প্রকাশিত হয় তাই হল লোক শিল্প। ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের হাংরি আন্দোলন, নিম সাহিত্য আন্দোলন ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের নব দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধ দোহারের চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে উল্লেখিত। শুধু সাহিত্য নয়; লোক গান, লোকনৃত্য, লোক চিত্র, লোকউৎসব,লোকসংস্কার লোকধর্ম,লোক নাট্য ইত্যাদির পাশাপাশি আলপনা, বাদ্যযন্ত্র, উল্কি, টেরাকোটা, শোলা শিল্প, হোগলা শিল্প, কাঁথা শিল্প, গয়না বাড়ি, ডোকরা, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প, নকশী কাঁথা, ডাকের কাজ লক্ষ্মীসরা ইত্যাদি লোকশিল্প বাংলার ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে।
– “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা” – সত্যিই এই দেশের রঙ্গ তথা ভালো থাকার রসদ গুলো আছে বলেই স্বতন্ত্র প্রহরীদের পরেও শব্দ থাকে আবেগ ও বাস্তবের দোটানায়, হয়তো সেটাই শেষ বা নতুন কোনো শুরু, অথচ শব্দ ভেসে চলে আবহমানে আর সেই শব্দের পটভূমিতে ছিল লাল মাটির গন্ধ, একতারা-দোতারার মূর্চ্ছনা, বাউলের সুর, পটের চিত্র, টেরাকোটার রূপ, পৌষের পিঠের সুবাস বা নবান্নের চালের গন্ধ, ভাটিয়ালি- ভাওয়াইয়ার আকুতি,ধামসা মাদলের অকৃত্রিম ধ্বনি, সাধারণ অথচ অনন্য, সরল অথচ অকৃত্রিম কিছু কোলাজ যেখানে নাগরিক কোলাহলের বাইরে, সোঁদা মাটির গন্ধে কোনো এক পড়ন্ত বিকেল মিশে যায় গোধূলিতে আর পরিশ্রান্ত পাখির দল দিগন্তজুড়ে কিচিরমিচির করতে করতে বিলীন হয়ে যায় শিকড়ের খোঁজে, নতুন শব্দে আবার কোনো এক মেঠো পথের সন্ধানে….।