সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ৭)

রেকারিং ডেসিমাল

বিকেল গড়ালে বাড়িতে অন্য রকম ব্যস্ততা আসে।
অফিস থেকে মানুষগুলো ফিরে আসবে সারা দিন পর।
সবাই পুরুষ মানুষ। এবাড়িতে মেয়েরা বাইরে কম বেরোয়। বেরোলেও পুরুষদের ছত্রছায়ায়। আরামের বেষ্টনীতে। গাড়ি নিয়ে। বা খুব জোর রিকশা ভাড়া করে পাশের বাজারে। তাও ছোটোরা নয়। তারা দাদা বা ভাইয়ের সাথে বেরোয়। নয়তো কাকারা যার যার গাড়ি করে ছেড়ে আসে বন্ধুদের বাড়ি টাড়িতে।
বাড়ির এক তলায় গ্যারেজ ছিলো। এক বিহারি দম্পতি দাদুর হাতে পায়ে ধরে অনেক কাল আগে ভাড়া নিয়েছিল সে গ্যারেজ। সেইখানে একটা কয়লার দোকান ও খুলেছিল সামনে।
পুরুষটির নাম কৃষ্ণমোহন।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন প্রথম ছেলে হল এদের। এই দোকানের মধ্যেই।
আঁতুড় কাটিয়ে পুজোর প্রসাদ নিয়ে ওপরে এল বউটি।
দিদাকে প্রণাম করে প্রসাদ দিয়ে বলল দিদি ছেলে হল তোমাদের আশীর্বাদে একটা ভালো নাম বলো না।
দিদা বললেন, এমন ভালো দিনে হয়েছে, নাম রাখো অক্ষয়। ছেলের সব শুভ হোক।
মেটে কমলা চওড়া সিঁদুরে সিঁথি রাঙানো, বাঁদিকে আঁচল ফেরতা দেওয়া বউ বলল, হাঁ সো আচছা হ্যয়, পর দিদি, এত শক্ত নাম, ইয়ে ইস্কুলে লিখতে কষ্ট হয়ে যাবে যে বাচ্চার।
একটু সোজা কিছু বলো না।
দিদা একটু ভেবে বললেন, আচ্ছা তবে নাম দিলাম অজয়। যুক্ত অক্ষর নেই। দেখ বানানের কোন ঝামেলা হবে না।
বউ মেজেয় মাথা ঠেকিয়ে খুশি হয়ে চলে গেছিল।
কৃষ্ণমোহন সে কালের পড়াশোনা করা বুদ্ধিমান মানুষ। পুরুষকার ছিল যথেষ্ট। ব্যবসায় উন্নতি করে উল্টো দিকে নিজস্ব কয়লার দোকান খুলে ভাড়াবাড়ীতে নিয়ে গেল নিজের পরিবারকে।
গ্যারেজ দিয়ে গেল ভাই লক্ষ্মণকে।
সেও কলকাতায় চলে এসেছে ততদিনে ভালো থাকার আশায়।
গ্যারেজের সামনের দিকে মুদির দোকান। পিছনে রান্না আর শোবার ব্যবস্থা। এই রকম করেই লক্ষ্মণের দোকান চলতে থাকে। পাড়ার বউদের বিশেষ ভরসার জায়গা এ দোকান।
রান্না বসিয়ে তেজপাতা নেই, এক দৌড়ে লক্ষ্মণ।
চা বসিয়ে চিনি নেই, বাড়ির ছোটটাকে ধাক্কা, শিগগির নিয়ে আয়।
তক্ষুনি পয়সা না থাকলেও চলে।
— দাঁড়াও দিয়ে যাচ্ছি, বললেই পাওয়া যায় জিনিস।
সবার নামধাম লেখা আছে দোকানের খাতায়। ধার বেশি হয়ে গেল দেখলেই লক্ষ্মণের ছেলেরা খাতা নিয়ে সেই বাড়ির বেটাছেলেদের কাছে পৌঁছে যায়।
— কাকু, দাদা, টাকা মেটান গো।
পাড়ার মধ্যে সম্মানের ব্যাপার।
সবাই মিটিয়ে দেয় হিসেব।
দু চার জনের একটু লম্বা বাকি পড়ে কখনও সখনো।
এসে ফাঁকায় ফাঁকায় বলে যায় দোকানে, এই মাসে একটু দেরি হবে, হ্যাঁ? দুটো দিন। তারপরেই দিচ্ছি।
দোকানী ছেড়েই দেয়।
চেনা মানুষ সব। ছাপোষা গেরস্ত।
তা এই বাড়ির মেয়েরা নিচে লক্ষ্মণের দোকানেও বেশি দাঁড়ায় না । একটু সময় গেলেই ওপর থেকে হুংকার আসে।
কি হল, দোকানে এতক্ষণ কেন।
মোদ্দা কথা এই বাড়ির শাসন ব্যবস্থা জোরদার। এবং মেয়েরা সামলে রাখার সম্পত্তি।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।