সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সোনালি (পর্ব – ১৫)

রেকারিং ডেসিমাল

১৫
নতুন বউ থেকে মায়ের পোস্টে মা প্রোমোশন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে , বাড়ির ছোটদের ও পদোন্নতি হল।
মায়ের কাছে ইভল্যান্ড নার্সিং হোমেই দেখা করতে চলে এল কত লোক।
দিদা, যাঁকে হুইলচেয়ারে করে লিফটে নিয়ে আসা হল নার্সিং হোমের তিন তলায়। সঙ্গে গায়ত্রীদি যে কিনা দাদু দিদার মেয়ের থেকে কম কিছু নয়।
মায়ের গম্ভীর সদ্যোজাত কন্যার ঠাকুরদা ঠাকুমা বাবা দাদু দিদা ত ছিলেনই।
পিসিরা, পিসি হবার আল্লাদে কল কল করতে করতে।
সবাই সাদা ধবধবে গোল এবং গ্যাঁট হয়ে মায়ের কোলে বসে থাকা নতুন মানুষকে দেখে হেসে অস্থির।
দিদা বললেন, কুমারের সুন্দরী মাইয়া হইসে।
মেজ পিসি বলল, গোল্লাবুড়ি।
ছোট বলল, এত গাবলু।
তার দিদি বাংলায় ভাল। শুদ্ধ করে বলল, ভাল বাংলায় বল।
গাবলেশ্বরী।
যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা তিনি মায়ের ভেতরের আরাম আর গরম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন না।
বহু কান্ডের পর মাঝরাতে মা এবং বাচ্চার প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়েছিল পৌষের সংক্রান্তিতিথির ভোরে।
অসম্ভব ঠান্ডা একটা রাতের মধ্যে ভয়ানক আতঙ্কের এমারজেন্সি অপারেশন সেরে অবশেষে বাইরে এসেছেন সম্পূর্ণা দেবী। মকরসংক্রান্তির ব্রাহ্মমুহূর্ত, যখন সবাই গঙ্গা সাগরে ডুব দিয়ে পুণ্য অর্জন করেছে , মাকে জীবন মশাই বললেন, কোল পাতো, তোমায় মা হবার বর দিলাম।
মা অসহ্য যন্ত্রণাকে নিঃশব্দে গিলে অজ্ঞান হবার আগের মুহূর্তে বললেন, আমার সোনাকে ভালো রাখো।
জ্ঞান ফিরতে একা বেডে স্টিচের ব্যাথা ছাপিয়ে ভয়ে বুক ধুকপুক করে উঠলো। চেঁচিয়ে উঠতেই বুলুমাসি, আয়া, বলল, কি হল ডাক্তার দিদি ? কি হয়েছে ?
মা টানটান পেটের ওপরে হাত রেখে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গিয়ে বললেন, আমার বেবি ?
ন মাস, মায়ের বুকের তলায় প্রবল ভাবে সে জানিয়েছে, আমি আছি।
ছোট্ট সাইজের মা, বড়সড় ছানাকে নিয়ে টলমল হয়ে যেতেন। তার লাথালাথি দেখে বাবা, পিসিরা আহ্লাদিত হয়ে যেত। ডাক্তার রথীন ঘোষ কিনা মাকেও পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, আদর করে ডাকেন, মেমসাহেব। তাঁর কাছে এ ছানা নাতি নাতনি গোত্রীয়। তিনি আট মাস হতেই ডপলার যন্ত্র একখানা বাড়িতে দিয়ে পাঠালেন। মা আপত্তি করেছিলেন একটু ভয়ে ভয়ে।
এত দামী জিনিস। যদি খারাপ টারাপ হয়ে যায় ।
ডাক্তার দাদু, আপত্তিকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন মেম সাহেব, সে আমি বুঝব।
ব্যস।
বাড়িতে মনে হত মোচ্ছব হচ্ছে।
সকাল বিকাল, খাওয়া দাওয়া সেরে মায়ের ঘরের বাইরের বারান্দায় দাদু দিদা চওড়া কাঠের চৌকিতে, পিসিরা পায়চারি, হবু ছানার ঠাকুমা, কাকি ঠাকুমা, ঠাকুরদারা, বাবা, মোড়ায় চেয়ারে বসেই হাউমাউ করে ফরমায়েশ, কই দাও দাও। মেশিন চালিয়ে দাও। দেখি কি করছে সে।
মা জেল লাগিয়ে পেটে ডপলার মেশিন সেট করে অন করে, সাউণ্ড বাড়িয়ে দিতেন।
ডুব ডুব ডুব….
ছোট্ট মানুষের হৃদপিণ্ডের ধুকপুক খুব জোরের সঙ্গে বেজে উঠে বারান্দায় থাকা মানুষদের মাতিয়ে দিত।
এত হই হই করে উঠত সবাই রোজ যেন টিভিতে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে।
রাতে লম্বা এল প্যাটার্নের বারান্দা পেরিয়ে অন্য প্রান্তে বাথরুমে যেতে হলে মা বারান্দার গ্রিল ধরে খুব সাবধানে যেতেন।
দিদার ঘুম কম।
সাড়া পেলে ডাক দিতেন ঘর থেকে।
সোনা বউ নাকি?
নতুন মা, হ্যাঁ, বললে সাহস দিতেন এক পুরোনো মা।
ভয় নাই। আমি জাগাই আছি। আস্তেধীরে যাও। দেখো না আমারে। তোমার ত এই প্রথম। আমরা হাজারে বেজার নই, শতে নাহি ভয়।
আসো, ঘুইরা আসো। অহন একটু তাড়াতাড়ি বাথরুম যাওন লাগে।
দিদার নয়টি সন্তান। সবাই পাথরের মত স্বাস্থ্য।
সেই যে গরম মত, হইচই করতে থাকা মানুষটা ভিতরের, তার ত সাড়া নেই।ভিতর ত ফাঁকা। অথচ কোন বাচ্চার কান্নাও শোনা যাচ্ছে না।
মা নিজে হাতে বহু শিশুকে বের করেছেন মায়েদের ভেতর থেকে বিয়ের ঢের আগে থেকেই। সরকারি হাসপাতালের একটা আস্ত গাইনি ডিপার্টমেন্টের রুগি দেখে সামলেই বড় হওয়া। বাইরের নার্সিং হোমে ও কাজ করে এসেছেন বিয়ের আগেই।
নবজাতকের কান্নার শব্দ এত পছন্দ বলেই তাঁর জীবনের লক্ষ্য, গাইনোকোলজিস্ট হয়ে ওঠা।
আজ নিঃশব্দ নার্সিং হোমের কেবিনে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
” আমার বেবি????! ”
” ওই ত, ঘুমুচ্ছে কটে। ”
পাশের দিকে তাকায় আয়া মাসি।
তার দৃষ্টির রাস্তা ধরে মায়ের চোখ চলে।
মাথার কাছে বেবি কট।
তাতে ছোট্টো এ বি সি ডি লেখা টেডিবিয়ার ছাপ্পা দেয়া কম্বল গায়ে দিয়ে এক গম্ভীর ভদ্রমহিলা শুয়ে আছে। পরনে পা অবধি লম্বা ধবধবে সাদা ফ্ল্যানেলের ফ্রক। মাথায় একটু সোনালি সোনালি রোঁয়া। ছোট্ট গোলাপি ঠোঁট, ইংরেজিতে যাকে বলে রোজ বাড মাউথ। সাদা মার্বেলের মত রঙের লম্বা লম্বা আঙুল ব্ল্যাঙ্কেটের ধারটা ধরে আছে।
ক্রিসমাস কার্ডে আঁকা এঞ্জেল একজন ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। পা দুটো একটু বেরিয়েই আছে কটের থেকে।
মা বুঝলেন, ইনি লম্বা মানুষ।
আর অমনি স্টিচের ব্যাথা , হাতে চলতে থাকা স্যালাইন, তাড়াতাড়ি অজ্ঞান করতে গিয়ে টিউবের চাপে ফেটে যাওয়া ঠোঁটের পাশ, সব কষ্ট কোথায় উধাও হয়ে গেল।
মায়ের এত শীতকাতুরে ঠাণ্ডা লাগা, সেও চলে গেল বুঝি।
আলোয় আর ভালো লাগার উত্তাপে বুকের মধ্যেটা ভর্তি হয়ে উঠল পূর্ণ ঘটের মত।
একটাই কথা মনে হল।
আমি মা।

চলবে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।