শনিবারের গল্পে সুরপ্রিয়া

অবিন্যস্ত

“মরেও মরিস না রে….. মর মর ! আরে মর রে মুখপুড়ি! আমার জ্বালা জুড়োয়! কি কি বললি? যাবিনা? তবে রে
….”
ঐ দুলে যাচ্ছে লক্ষী বুড়ি! ঐ তো! শ্ম’শানে এলে ওকে দেখা যাবেই! অনবরত বট গাছটার নিচে দুলে যাবে আর শাপ শাপান্ত করে যাবে! কাদের উদ্দেশ্য করে যে এই শাপশাপান্ত করে তা ঈশ্বর’ ই জানেন।দেখে মনে হয় ভুতে পেয়েছে। গ্রামে এক প্রান্তে শ্ম’শান। সমস্ত শুভ – অশুভকে আগলে বসে থাকে এই বৃদ্ধা! মানুষ আসে-যায়, ওর কোন বিকার ঘটেনা। সারা বছর ওকে কেউ মনেও রাখেনা। শুধু এই কালী পুজো এলেই….!
“খুড়িমা খুড়িমা….. জমিদার মশাই ডাকে… ! ” ভোলা এসে ভয়ে ভয়ে দাঁড়ালো!এত অন্ধ’কারে কি কোন সাধারণ মানুষ বসে থাকতে পারে? লক্ষী বুড়ি পারে! গ্রামের সবাই জানে বুড়ি প্র’কৃতিস্থ নয়! কত বয়েস কেউ জানেনা। কেউ প্রশ্নও করেনা। সবাই বলেমা কালীর বর আছে লক্ষী বুড়ির ওপর ! তাই সে এমন!
“কেন রে তোর জমিদারের মরার সময় হল নাকি? চিতাকাঠ জোগাড় করে দেব? ” ঘন জটার মধ্যে হাত ডুবিয়ে চুলকোতে থাকে।
ভোলা কি বলবে ভেবে পেল না! এই মহিলাকে তার বড্ড ভয় করে! আর সন্ধের পর শ্ম’শানে আসতে বলে জমিদারবাবু তাকে আরো বিপাকে ফেলেছে!
সে ফিরে যাচ্ছিল হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাত তার ঘাড়ে যেতেই, ফিরে তাকালো ” শোন রে বেটা শোন। জমিদারকে বলিস লক্ষী বুড়ি ডাকলেই আসেনা। তাকে আনতে সাধনা লাগে! ”
বলে গগনবিদারী হাসি হেসে উঠল বুড়ি!
*************************

-“শোনা যাচ্ছে আশেপাশের গাঁয়ে নাকি মড়ক লাগিছে..”

-“হ্যা গো ! কি কান্ডী বল দেখি!ও দিকে কালীপুজো হবে কি না তা নিয়ে বেশ সন্দেহ হতেছে আমার! “
গ্রামের ঘাটে জনৈকা দুই মহিলা বসে আলাপে ব্যস্ত। সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। আবছা আলো আধারী চারিদিক! তারি মধ্যে হেমন্তের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।কালী পুজোর আর এক সপ্তাহ বাকি। তবু জমিদার বাড়িতে মূর্তি বানানো শুরু হয়নি! কারণ একটা আছে ঠিকই। সেটা এদের কথোপকথনে কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে।
“লক্ষী খুড়ি নাকি এখনো মায়ের আদেশ পায়নি গো!”ফিসফিস করে বলল এক মহিলা, যেন কত গোপন কথা।আর এক মহিলাও সে কথার সম্ম’তি জানাল!
” বল হরি হরি বল! ” শবদেহ নিয়ে এক দল যুবক হেঁটে যাচ্ছে শ্ম’শানের দিকে! তার পিছনে ও কে? রূক্ষ জটা কোন রকমে শরীরে জড়ানো লাল থান! যাচ্ছে বটে কিন্তু তাকিয়ে ঐ কথোপকথনরত দুই মহিলার দিকে। যেন ভস্ম করে দেবে জ্বলন্ত ঐ চোখ দিয়ে!
খুব কাছে কেউ যেন ততধিক আস্তে ফিসফিস করে বলে উঠল “মায়ের আসা যাওয়া তোরা ঠিক করে দিবি আবাগীর বেটি গুলান? ” চমকে দুই মহিলা আশপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই শুধু দুরে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি পুড়িয়ে দিল তাদের শরীর!
তড়িঘড়ি তারা ঘরের দিকে যাত্রা করল!
*************************
রাত গভীর । শ্ম’শানের এক কোণায় মরা পুড়ছে দাউ দাউ করে! ভোলাও আছে সেখানে। হঠাৎ তার মনে হল আগুনের লেলিহান শিখায় ও দিকে কেউ দাঁড়িয়ে। মুখে আগুনের আলো পড়ে কেমন যোগিনী মনে হচ্ছে, ঐ রহস্যময়ী নারীকে। ভোলার দিকে কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । যেন কিছু বলতে চায়। ভোলা দেখেও দেখল না!
মরা পুড়িয়ে সকলে ফিরে যাচ্ছে ভোলাও পা চালালো। আবার সেই ঠান্ডা হাত পিঠে! যেন আঁকড়ে ধরেছে! কিছুতেই ভোলা ছাড়াতে পারছে না!
“তোকে যে ডাকলাম! ”
ভোলা মাথা চুলকে অসহায়ের মত বলল ” আজ্ঞে কই খুড়িমা….! ”
” অঅঅঅঅ তা শুনেও শুনিসনি ঘাটের মরা! বস আমার সামনে! ” যোগিনীর মত বসে আছে লক্ষী বুড়ি!
ভোলা ইতস্ততঃ করে বসল! ” বলেন খুড়িমা! ”
” তোর জমিদার এল না আমার কাছে! আমিও যাবো না! ” বলেই কাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল ” আঃ জ্বালাস নে মুখপুড়ি! মড়ক লাগাবি আর হাসবি, হতি দেবনা আমি! ”
কি বলে যাচ্ছে এসব এই বুড়ি, ভোলা দেখল শবদেহ পোড়ানোর আগুনটা এখনো ধিকিধিকি জ্বলছে! আর কোন আলো নেই! শুধু কোথা থেকে একঝাক আলো এসে পড়েছে লক্ষী বুড়ির মুখে! আবার তার দিকে তাকালো লক্ষী বুড়ি!
“তোদের জমিদার কে গিয়ে বল যা মা কালী এই বটতলায় বানানো হবে । আমি বানাবো! ”
“কি? ” ভোলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল?
“হ্যা রে আলালের দুলাল। মা আমার হাতে তৈরী হবে বলেছে! পুরোহীত নিয়ে আসিস! ”
“আচ্ছা … ” বলে উঠতে যাচ্ছিল ভোলা!
” শোন শোন ….. মড়ক লাগলে ঠেকাতে পারবে তো তোদের ঐ মদখোড় মাতাল জমিদার? ”
“মানে…. ” ভোলা কিছু বলতে যাচ্ছিল! বুড়ি উচ্চ হাস্য করে বলল ” যা পালা পালা!এখনি পালা ঘাটের মরা! ”
***********************
আজ রাতেই অমাবস্যা! এর মধ্যে যারাই শ্ম’শানে এসেছে তারা সকলেই দেখেছে বুড়ি মূর্তি গড়তে ব্যস্ত। কালী পুজোয় এই বুড়ির কথাই এই গ্রামে সব! তার ওপরে কেউ কোনদিন কোন কথা বলেনি। জমিদার’ও না, পুরোহীত ও না। এ রেওয়াজ চিরাচরিত, কত যুগ ধরে চলে আসছে তা কেউ জানেনা। বুড়ির বয়স এক শতাব্দী। চেহারা হাড়গিলে, কোটরে যাওয়া চোখ জ্বলছে ধিকি ধিকি!
জমিদার এলেন রাত বারোটায়।গ্রামের আর সকলে হাজির।এসে দেখলেন এক বিশাল দেহী কালী মূর্তি বিরাট হা-মুখ তার আর চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে। গিলে খাবে সমস্ত পৃথিবী। এত হিংস্র মুখ! যেন এই গ্রামকে এক নিমেষে নিঃশেষ করে দেবে সে! সকলেই প্র’মাদ গুনলেন! তবে কি পাশের গ্রামের মড়ক এ গ্রামেও ছড়াবে?
“এ মূর্তি বুড়ি বানিয়েছে? ” সকলেই বিস্মিত , তবু মুখ ফুটে বলার সাহস নেই!!
ভয়ে ভয়ে পুজোয় বসলেন পুরোহীত। বটগাছের এক কোণায় বসে বুড়ি! দুলে যাচ্ছে আর মূর্তির দিকে চেয়ে এক নাগাড়ে বিড়বিড় করে চলেছে!
“বাচিয়ে রাখ। ওদের তুই বাঁচা! ” এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছে লক্ষী বুড়ি। কারো পুজোয় মন নেই, সকলে দেখছে বুড়ি ক্রমশ মূর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরোহীতের পুজায় বারবার ভুল হচ্ছে। মশালের আলো জ্বলছে দাউ দাউ করে। সকলে ” জয় মা জয় মা” করছে।
হঠাৎ লাফিয়ে উঠল বুড়ি ” মুখপুড়ি আমায় খা ! খা খা! এ গাঁ আমার সন্তান! মরতে দেব না কিছুতেই কাউকে”আমায় খা। আমায় !বলেই চিৎকার করে উঠল!
এমন মুহুর্তের আশা কেউ করেনি! এ কি দেখছে তারা?
” জয় মহাকাল…… জয় মহাকাল…. “বলে চিৎকার করছে লক্ষী বুড়ি আর মূর্তির শরীর বেয়ে উঠে যাচ্ছে মায়ের মুখের কাছে!
” জয় মহাকাল!” বলে নিজেকে মায়ের মুখের মধ্যে পুড়ে দিল বুড়ি!
চকিতে সমস্ত শ্ম’শান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বৃদ্ধার মাংস পিন্ড! মা কালীর ঠোঁট আর দাঁত বেয়ে নেমে আসছে রক্ত! মহা যোগিনীর রক্ত!
সে বছর মড়ক ছোয়নি লক্ষী বুড়ির গ্রামকে।
**************
অষ্টাদশ শতকের গ্রামের শ্ম’শানের সেই মহাকালীর মূর্তি এখনো বিরাজমান। মহাভৈরবীর রক্ত এখনো তার ঠোঁটে -দাঁতে! কোন বৃষ্টির জল মুছে দিতে পারেনি লক্ষীবুড়ির অস্তিত্ব! এই একবিংশ শতকে এখনো সেই গল্প মুখে মুখে ফেরে.!
(এ গল্পের স্থান -কাল -পাত্র সবটাই কাল্প’নিক)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।