একটা মরা ঈগলের ছায়া জমে আছে পাতার পর পাতা। এখানে মনের তলদেশ জুরে জমে উঠেছে হিমশীতল চোরা অন্ধকার। সেই ঠান্ডা ছায়ার জন্মের আকার বৃহৎ কলকাতার এমন এক অংশে যেখানে এসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে পুরনো সময়। এখান থেকেই শুরু হবে চিঠির ভাষা।
– এই মেয়েটিকে চেনো তুমি? হঠাৎ মুখটা এমন শুকনো হয়ে গেলো কেন তোমার! – অমৃতা কথাটা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
আসলে কিছু মানুষের জীবনে যুক্ত থাকে এমন একটা মানুষ যাকে দেখতে তারই মতন লাগে কিন্তু দেখা যায় না! সে দুখন্ড হয়ে যায় তোমার আমার সামনে। ঘড়ির দিকে তাকালাম । বেলা এগারোটা।
বাইরে একটা গাড়ির তীব্র শব্দ…. “দরজাটা খোলো। ”
অমৃতা গালে হাত রেখে বললো স্থির হয়ে – ” তোমার চোখ একদম লাল হয়ে গেছে। কেউ আসছে কিন্তু –
টিংং টংংংংংং টিংংংং টংং
– “যাও, খুলে দাও দরজা । ” এখন শুধুই ঝুলে থাকা মুখের হাসি, চোখটা বন্ধ করে নিলাম ।
দরজা খুলে গেলো-
– “আসুন , আসুন পারিজাত বাবু, আপনার বন্ধু তো ভাবতে ভাবতে তিনবার চা ঠান্ডা করে ফেললো!” অমৃতার গলায় ঠেসটাও বেশ সুরেলা লাগে। ওর সামনে যেন কন্ঠস্বর উচু মাত্রায় ঠিক তোলাই যায় না।
– উফ বৌদি! এমন একটা জায়গা বাড়ি নিলে কি আর বলবো, আরও দার্শনিককে বিয়ে করো, এমন পাগলামি আরও সহ্য করতে হবে দিনের পর দিন।
পারিজাত যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। উফ…..
– কি হয়েছে পারিজাত দা? লেগেছে নাকি?
– না না, কিন্তু আসার পথে কি যে হলো….
ভিতর থেকে রান্নাঘরের বেসিনটার জলের শব্দ থেকে এক একটা কথা ভিজে আসতে শুরু করলো এদিকের ঘরে।
পারিজাত শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু কথাগুলো অমৃতার কানে আসছে। দরজা দিয়ে ঢুকেই ঘরটা অন্ধকার, অনেকগুলো ছাযা়র কোলাজ তৈরি হয়ে ঝুলে আছে এ-দেওয়াল ও-দেওয়াল। অমৃতা কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে …. একটা একটা শব্দ পারিজাতের জন্য রেখে দিচ্ছে ওই ঘরে যাওয়া পর্যন্ত, শুধু একটাই কথা বললো – ” মেট্রোর সামনে নেমেছিলে কেন?”
পারিজাত এক মুখ বিদ্যুৎ কাটা চোখে অমৃতার দিকে তাকালো – তুমি কি করে…
ভিতরের ঘরে ঢুকতেই মুখে জল ছিটানোর শব্দ আসছে –
– ছপাং , ..ছপাং… মেট্রোর পাশে একটা নতুন গলি নেমে গেলো, তাই তো!
– মানে , কি বলছিস ভাই!
– মানে ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশনের …. ছপাংং…… ছপাং ..উল্টো দিকে একটা নতুন গলি নেমে গেছে তাই তো?
– কিন্তু, তো…রা কি করে জানলি রে.. বুঝতেই-
জলটা পড়ছে .. মুখে শুধুই জল ছিটছে, ছিটছে ছপাংং
– একটা কাগজ তোর পায়ের নিচে ছিল, গাড়ি থেকে কোনও কারণ ছাড়াই নেমে গেছিলি
– হ্যাঁ , কিন্তু কি .. মানে, কি করে বলছিস বল তো
পারিজাতের মুখে লেগে থাকা বিদ্যুৎ দাগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে । অমৃতা চুপ করে দেখছে আমাদের ।
– পারিজাত, একটু পা’টা দেখতো? মুখে জলের শব্দ ছপাং…ছপাং….. ব্লেড ছিল তো একটা , কেটে যেতে পারে পা’টা, আজ তো স্লিপার পড়েছিস আবার!
– পা টা তো সত্যিই কেটে, আআআমার খুব ভয় করছে রে………
কি করে তুই সবটা বলে যাচ্ছিস রে…. বিছানায় বসে পড়ে । কিন্তু যে কারণে আজ আসা পারিজাতের ….. সেই কারণটাই বদলে যায় গাড়ি থেকে নামার পর থেকেই।
ঘরের মধ্যে এখন এক তামসিক নীরবতা। তিনটে প্রাণ কথা বলছে ইন্দ্রিয়ের ওঠা আর নামার মধ্যে । পারিজাত শুরু করলো কথা- ওর চোখ ভেদ করে যাচ্ছে জানলা দিয়ে ওই কলাগাছটার কাছে যেখানে আবার ফিরে এসেছে সেই কাক যার চোখে লেখা আছে অজানা ভাষার ইতিহাস । অমৃতার কানে ভেসে উঠছে একটা শব্দ ‘সফ্রোসাইন’! আমি তাকালাম .. পারিজাতের মুখে।
একটা বিদ্যুৎ রেখা তুলে দিলাম নাম – তীব্র অনিবার্যতা, আরও একটা রেখা তুলে বললাম – স্বান্ত্বনাহীন শোচনীয়তা। এর মাঝে যে শুদ্ধ প্রজ্ঞা আছে , সেইখান থেকে পারিজাতের ঠোঁট কাঁপছে –
রাস্তায় হঠাৎ গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিলাম। কেন জানি না। হঠাৎ একটা গলি দেখলাম ওখান দিয়ে নেমে গেছে। দশ বছর হলো, কোনও দিন তো দেখি নি, হঠাৎ কিভাবে ……পাযে় কি একটা যেন লাগলো, নিচু হয়ে দেখতে যাবো এমন সময় মনে হলো, একটা তীব্র গতিতে একটি মেয়ে আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে সরে গেল, ও সারা শরীর জুরে পারফিউমের বোতল পুরোটা উল্টে গেলে যেমন গন্ধ হবে ঠিক সেরকম। বিশ্বাস কর, মাথাটা ঘুরে গেল জানিস, ওর লাল ওড়না আমার গা ছুঁয়ে গেল, মাথা ফিরে তাকাতেই দেখি …….
অমৃতা আস্তে করে বললো – ও আর নেই ! কি তাই তো।