দেখুন দেখি নেপালের এই প্রথাটির সঙ্গে আমাদের কুমারী পুজোর কোন মিল পাওয়া যায় কিনা ?
কিছু মানুষের চেতনায় আমরন লেপটে থাকে গভীর দুঃখের বোধ । তাঁরা বোধহয় সহজেই বুঝে যান মোহাবিষ্ট পৃথিবীর স্বরূপ । যারা আস্তিক তাঁরা মানেন জীবনপথে সুখ এবং দুঃখ চক্রাকারে আসে । কাঠমান্ডু শহরের এই দুই ধরনের মানুষেরই আবিষ্ট চোখে বিরাজমান আলতার ছোপ দেওয়া দুটো ছোট্ট পায়ের ছাপ । একটি ছোট্ট বালিকার দেবী হয়ে ওঠা । আলতা দিয়ে ধোয়ানো পা , লাল চেলী দিয়ে মোড়ানো ছোট্ট শরীর , কপালের মাঝে সোনার টিপ হয়ে থাকে তৃতীয় নয়ন । সমস্ত পাপ গন্ডুষ ভরে পান করে নীলকন্ঠ হয়ে থাকা এই ছোট্ট মেয়েটিই নেপালের একচ্ছত্র দেবী —- The Guardian Deity বা The Living Goddess । হিন্দুদের কাছে সাক্ষাৎ দেবী পার্বতী আবার তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কাছে দেবী তারা ।
বালিকার দেবীত্বে আরোহনের সময়কাল অবশ্য বেশীদিনের নয় , তিনশো বছরেরও কিছু কম । তখন নেপালে মল্লদের রাজত্ব । ১৭৩৬ সালে সিংহাসনে বসেন মল্ল বংশের শেষ রাজা জয়প্রকাশ মল্ল । সিংহাসনে আরোহনের প্রথমদিন থেকেই গোর্খা আক্রমন ও রাষ্ট্রবিপ্লবের আশঙ্কায় জেরবার জয়প্রকাশ একদিন স্বপ্ন পেলেন শাক্য গোত্রের এক স্বর্ণকারের একটি শিশুকে দেবীরূপে দেখার । কি অদ্ভুত দেখুন রাজা জয়প্রকাশ কিন্তু তাঁর মন্ত্রীকে বলছেন যে শিশুর তো কোন লিঙ্গ হয় না , তাহলে দেবীত্ব ধরবই বা কি করে ? মহামন্ত্রীর উত্তর ছিল যে শিশুর মধ্যে মাতৃত্ব সুপ্ত অবস্থায় থাকে তাঁকেই দেবীত্বে বরন করা যায় ।
নেপালের The Living Goddess সম্বন্ধে পড়তে পড়তে অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের -এর গল্প নিয়ে সত্যজিত রায়ের কালজয়ী সিনেমা ’দেবী’ -র কথা । তবে ছবি বিশ্বাসের ঐ পুত্রবধুকে ’ দেবী ’ রূপে দেখার পিছনে কোন কোন পন্ডিত ফ্রয়েডিয়ান দুষ্টুমি খুঁজে পেয়েছেন , নরম্যান হল্যান্ডের মত মানুষ অস্পষ্টতাকে ব্যাখ্যা করেছেন ফ্রয়েডিয় ভাষায় “the navel of the dream,” a strangeness like the religiosity that bedevils India । নেপালের ক্ষেত্রে বোধহয় তা নয় , কারন স্বর্ণকারের মেয়েটি নিহাতই শিশু ।
হিন্দু ধর্মের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের অভ্যন্তরেই দেবত্বের অবস্থান । এর মোদ্দা কারনটা মূলত দার্শনিক হলেও এর একটি জাগতিক ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন Appayya Dikshita ।সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না । আমার তো মনে হয় দার্শনিকতা হিন্দুদের জন্মগত প্রবৃত্তি বলে জাগতিক আপাত অসহায়তার মধ্যে পড়লেই মানুষ বিমূর্ত ধারনায় আশ্রয় নেওয়ার পরিবর্তে অসাড় দেবতাকে স-সাড় মানুষে আরোপ করে , সেই মানুষের কথা-বার্তা , চলা -ফেরার মধ্যে ঈশ্বরপ্রেরিত সম্ভাব্য সমাধানসুত্র ভেবে সংকটমোচনের একটি আশ্রয় খুঁজে নেয় । শাক্য কন্যাকে ’ দেবী ’ ডাকের মধ্যে দিয়ে এইরকমভাবেই হয়ত বা জয়প্রকাশ মল্ল বাঁচার উপায় খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন ।
সত্যজিৎ রায়ের ’ দেবী ’ ছবিটির পোষ্টারটা মনে ভেসে ওঠে বারবার । দ্বিখন্ডিত কপালের একাংশে অর্ধেক টিপ আর অপর অংশে অর্ধেক নয়ন — মুখের অর্ধেক ছায়ার আড়ালে । ছায়ার আড়ালে থাকা ঐ অস্পষ্ট অংশটি দেবীরূপ না মানবরূপ জানতে চায় বা কে ? আশ্বিনের কৃষ্ণা চতুর্দশী ও তার আগের দুটো দিন দেবরাজ ইন্দ্রকে শ্রদ্ধা জানাতে মেতে ওঠে কাঠমান্ডু উপত্যকা । নিয়ম অনুযায়ী কৃষ্ণা চুতুর্দশীতে ইন্দ্রযাত্রা বলে যে শোভাযাত্রা বেরোয় তার নেতৃত্ব দেন সবার অভিভাবক —-The Guardian Deity বা The Living Goddess । এই রথ আর শোভাযাত্রা ঘিরে মানুষের বন্যা প্রাচীন শহরের হৃৎপিন্ড ছাপিয়ে চারিদিকে বয়ে যায় । মানুষের আরোপিত দৈব অন্ধকার থেকে অনরক্ষিত পৃথিবীর পরিবেশে দেবীকে আনা হয় এই একদিনই । তাকে শুধু চোখের দেখা দেখতে কাঠমান্ডু উপত্যকার মানুষ খুনও করতে পারে ।
ঐ বালিকার দেবীরূপের মেয়াদ মোটামুটি বছর সাত – আট । দুই -চার বছর বয়সী শাক্য বালিকারাই দেবী হওয়ার যোগ্য । সেই বালিকাকে হাঁটতে শিখতে হবে , শরীর হতে হবে অক্ষত , ত্বকে থাকবে না কোন দাগ । চোখ হতে হবে নীল কিংবা কালো , চুল কালো , কুঞ্চিত চুল হলে সে চুলের ঢল ডানদিকে বিন্যস্ত হতে হবে । হাতদুটো নরম হলেও সুঠাম হতে হবে , অক্ষিপল্লব হতে হবে গরুর মত ঈষৎ উর্ধ্বমুখী । রাশিফল হতে হবে বর্তমান রাজার রাশিফলের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক যুক্ত । এইরকম ৩২ টি লক্ষণ মিললে হয় অন্তিম দুটো পরীক্ষা । অমাবস্যার রাতে বালিকাকে নিয়ে আসা হয় তালেজু মন্দিরে । এরপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় মন্দিরের উঠোনে যেখানে একটি মশালের স্বল্পালোকে ছড়িয়ে আছে বলি হওয়া মোষের ছিন্ন শরীর । যে বালিকা ঐ নরকে পৌঁছেও একটুও ঘাবড়াবে না , সেই হবে দেবী । এরপর পূর্ণিমার রাতে নিয়ে যাওয়া হবে সদ্যোজাত শিশুদের সুতিকাগৃহে । যে বালিকা ঐ স্বর্গে পৌঁছেও বাচ্চাগুলোর প্রতি বাড়তি আকর্ষণ দেখাবে না , সেই হবে দেবী ।
The Living Goddess র ছুটি হয় হাত -পা কেটে রক্তক্ষরণ ঘটলে বা আঘাত পেয়ে দাঁত পড়ে গেলে । আর হয় স্বাভাবিক নিয়মে ঋতুদর্শন হলে । প্রচুর অনুদান নিয়ে দেবী বাড়ি ফেরেন । তার বাকি জীবনের পড়াশুনো, চিকিৎসা থেকে বিয়ের খরচ সবই দেবে সরকার ।
Isabella Tree এর ‘ The Living Goddess ‘ পড়তে পড়তে মানসচক্ষে দেখতে পেলাম কুমারী বহালের ফটকটা খুলছে । পুরোহিতরা লাল কার্পেট টানটান করে পাতছেন ফটকদ্বার থেকে রথের সিঁড়ি পর্যন্ত , কুমারীর যে ভূমি স্পর্শ করা মানা । কোলে চড়ে বা কার্পেটের ওপর দেবীকে ধুলোর সাথে ঐশী দূরত্ব রাখতে হয় । উপরের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম । যে জানলার আপাত শূন্যতা সাধারণের কাছে ঈশ্বরের উপলব্ধির মতই ধ্রুবক ও স্বতঃসিদ্ধ , সেখানে এক বালিকার মুখ । সেই বালিকা আরোপিত দেবী নয় । কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন জাফরির নকশার আড়ালে ছোট্ট মেয়েটি তার গাল চেপে তাকিয়ে আছে নীচে । ঘন ছায়ার পিছনে কপালজোড়া চন্দনের ফোঁটা , চোখের কাজল , মুকুটের সাজসজ্জা , তৃতীয় নয়নের সোনার দিব্যদৃষ্টি আগুনের নির্মমতায় পুড়িয়ে দিচ্ছে যা কিছু বাস্তববোধ , যা কিছু agnostic দর্শন । ঐ মেয়ের চোখে এখন ধুলোময় পৃথিবীর আলো । ধুলোর মতই আর্ত মানুষ , কাঙাল মানুষের তীব্র অসহায়তাকে দূর করে এই পৃথিবীতে নতুন করে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতেই যেন বালিকাটির দেবীত্বে উত্তরণ।