• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সাহানা ভট্টাচার্য্য (পর্ব – ৯)

অস্ত্রদান – একটি কাল্পনিক কথা 

পর্ব ৯ – শঙ্খ 

“কোয়েল তুই একটু ও ঘরে যা, এখানে একটা শুভকাজ হচ্ছে”
শাঁখে ফুঁ দেওয়ার আগেই হাতে ধরা শাঁখ নেমে এলো। প্রিয় জ্যাঠতুতো দাদার ছেলের ষষ্ঠীপুজো বলে কথা! সেই জ্যাঠতুতো দাদাই সরাসরি শাঁখটা রাখতে বললো।
কোয়েল নিউজ রিপোর্টার, শান্তশিষ্ট, গভীর নদীর মতো। ছেলেপিলে তাকে সমঝে চলে তার স্বভাব ও যোগ্যতার জন্য। গতবছর সম্বন্ধ করে খুব বড়ঘরে বিয়ে হয়েছিল। সম্বন্ধের বিয়েতে পাত্র-পাত্রীর দেখাই হয়নি বিয়ের আগে। বুকে ধুকপুকানি থাকলেও বাবামায়ের ওপর অগাধ আস্থা ছিল কোয়েলের। বরের যে রাতের পর রাত অন্য কারোর ঘরে পড়ে থাকার অভ্যেস, তা বিয়ের পরে টের পেয়েছিলো। দিন সাতেক দেখে বাড়ি চলে এসেছিলো কোয়েল।
সামনে বিবাহিতা আরেক বোন দোয়েলের হাতে শাঁখ দিয়ে কোয়েল সরে গেল সামনে থেকে। দোয়েলের কপালে ব্যান্ডেড লাগানো, সবাই জানে দোয়েলের ছেলে খেলতে খেলতে খেলনা ছুঁড়েছে, দোয়েলের কপাল কেটে গেছে। দোয়েলের বর যে মদের ঘোরে ধাক্কা মেরে ফেলে ছাদের কার্নিশে মাথা ঠুকেছে, তা কাউকে জানতে দেয়নি দোয়েল। ডিভোর্সী বোন কোয়েলের মনে পড়লো, তার নিজের বিয়েতেও শাঁখ বেজেছিল। এই তো, গতবছরের কথা!
“আহা হা তুই এসে পদ্মফুলে হাত দিলি? এত্তবড় থালার সব ফুলগুলো ফেলা গেলো রে”
“কিন্তু ভাই তো চান না করেই বাজার থেকে পদ্ম এনে রাখলো মা”
“ভাই ব্যাটাছেলে যা খুশি করতে পারে, তাই বলে তুই নোংরা হয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকবি?”
বাড়িতে কালীপুজো, সদ্যরজস্বলা নয়বছরের বাচ্ছা মেয়ে দিশা ছলছলে চোখে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আজ পুজোয় কত লোক আসবে। সে থাকবে তার নিজের ঘরে, কারণ সে “নোংরা”!
রুবাইয়ের ছেলের অন্নপ্রাশন, পাড়াসুদ্ধ ঝেঁটিয়ে নেমন্তন্ন। রুবাই নিজে সব্বাইকে এসে কার্ড দিয়ে গেছে। খালি দেবশ্রীর বাড়িতে কার্ড দিতে এসেছিলো রুবাইয়ের মা।
“তোমার জন্য সব খাবার বাক্সে প্যাক করে পাঠিয়ে দেব গো বৌমা। অরূপের নেমন্তন্ন রইলো। তুমি সব ছবি দেখো পরে।”
দেবশ্রী আর রুবাইয়ের বৌ ঝুম্পা একই বছরে বিয়ে হয়ে এ পাড়ায় আসে। রুবাইয়ের বৌ চাকরি করে না, ঘরকন্না করে। দেবশ্রী কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি। দুজনে বিয়ের পরপর একসাথেই  পোয়াতি হয়েছিল। পাড়ার দুই বৌ এমনিতে তেমন সময় পেতো না মেলামেশার, কিন্তু অন্নকূটের পুজোয় একসাথে মন্দিরে গিয়ে দুজনে হেসে গড়াগড়ি। হোয়াটস্যাপ নম্বর চালাচালি। তারপর থেকে ডাক্তার দেখানোগুলো একসাথে হতো।
ঝুম্পার লেবারে যাওয়া, ছেলে হওয়ার দুদিনের মাথায় দেবশ্রী যায় নার্সিংহোমে।
রুবাইয়ের মা চলে যাওয়ার পরে অরূপ-দেবশ্রী দুজনের দিকে তাকিয়ে একমুখ হাসলো। দেয়ালে মা দুর্গার ছবির পাশে জ্বলজ্বল করছে ওদের যমজ মেয়ের ছবি। ওদেরও তো এই সময়েই অন্নপ্রাশন হবার কথা ছিল।
কালীপুজোর ঘটা হচ্ছে চারিদিকে, এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে ভেসে আসছে শাঁখের আর কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ। মা দুর্গার আজ কালীরূপ। দিশাদের বাড়ির ছাদে অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে মা বসে ভাবছেন। নিয়তিকে তিনি ঠেকাতে পারেন না, কেউ-ই পারে না, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীও সাবালক হয়ে গেছে, এখনো এই? মঙ্গলকাজে অনাহুত একটা বড় অংশ। অস্বস্তিকর সামাজিক নীতিকে ঠেকানোর জন্য নিয়তির দরকার নেই তো! শাঁখটা গঙ্গাজলে ধুয়ে মা দুর্গার মনে হলো, আওয়াজ ওঠানো দরকার। পাঞ্চজন্য বেজেছিল কুরুক্ষেত্রে। আওয়াজ না হলে কারোর হুঁশ হয় না তো! এম্বুলেন্সের মতন আওয়াজ না হলে কেউ রোগীকে পথ ছাড়ে না। বাচ্ছা না কাঁদলে মা দুধ দেয় না। আওয়াজটা খুব জরুরি।
**************************************************************************************************
আজ বাসন্তীপুজো, বসন্তকাল, মা দুর্গারও মন মাতাল। রেডিওতে বেজে উঠলো দেবশ্রীর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর। কর্পোরেটে চাকরি করা রুবাই-ঝুম্পার প্রতিবেশী সেই দেবশ্রীর প্যাশন বাচিকশিল্প বা কথা বলা। পার্টটাইম রেডিও জকি দেবশ্রী আজ দারুন খুশি। গতকাল ওর মেয়েদের জন্মদিনে অনেক ঘটা করে অনুষ্ঠান হয়েছে। এসেছিলো আরো অনেক মা-বাবারা, সাথে তাদেরও সন্তানদের ছবি। গতকালকের দিনটা তারা সবাই মিলে উৎসব পালন করেছিল। দেবশ্রী কলেজের বন্ধু কোয়েলের সাথে মমিলে অর্গানাইজ করেছিল এক অনুষ্ঠানের। কোয়েল খুব যত্ন করে সেজেছিল, সাজিয়েছিল দেবশ্রীর বাড়ি, সামনের লন। পাড়ার বাচ্ছা মেয়ে ছোট্ট দিশা ও তার বন্ধুবান্ধবরা আর্ট এন্ড ক্রাফটের কাজ শিখেছে স্কুলে। খুব সুন্দর ডেকোরেশন করেছিল বাচ্ছাগুলো। আর এই অনুষ্ঠানে এসেছিলো নিকটবর্ত্তী এক অনাথ আশ্রমের অনেক অনেক বাচ্ছারা। ক্যাটারারের রান্না ছাড়াও দেবশ্রী আর বাদবাকি বাবা-মায়েরা নিজেদের হাতে রান্না করেছিল কিছু কিছু পদ।
কোয়েল কি সুন্দর করে কভার করলো গোটা অনুষ্ঠানটা। আজকের বাংলা কাগজে বড় করে প্রতিবেদনটা বেরোলো। দেবশ্রীর চ্যানেলেও বাজলো আজ আনন্দের গান।
মা দুর্গা গত দুদিন ধরে বাসন্তীরঙা শাড়িতে সেজে বসে সবটা দেখলেন হাসিমুখে। কোয়েল-দেবশ্রী-দিশার এই শুভ উদ্যোগ “প্রজেক্ট শঙ্খ” সফল হবেই, এ নিয়ে তাঁর আর কোনো দ্বিধা নেই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।