• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে সজল বন্দ্যোপাধ্যায়

রহস্যময় মৃত্যুর খুব কাছে

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সমর । মাস্টার্স করার বিষয় ছিল ইউরোপের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব । পড়াশোনা শেষ করে সে ইতালিতে যায় বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করতে । সরকারি স্কলারশিপের বদান্যতায় সে পৌঁছে যায় এথেন্স । সেখানকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে সে গবেষণা করবে । কম রেন্টে একটা থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যায় । অনাথ সমরের জীবনে এটা একটা সুন্দর সুযোগ । জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা ধাপ ।
দেশটা দেখতে দেখতে আর গবেষণার কাজ করতে করতে এক বছর কেটে গেছে সমরের । এখন সে অনেককিছুই জেনে ফেলেছে ইতালির । আর খোদ গ্রিসে বসে ইউরোপের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ব নিয়ে গবেষণা এডভেঞ্চারি করে ফেলেছে সমরের মনকে । সে শুধু ইতালি বা রাজধানী এথেন্স নয় রোমও ঘুরে এসেছে । একবার ঘুরে এসেছে ফ্রান্সের মার্শাই । সংগ্রহ করেছে বেশ কিছু প্রাচীন প্রত্ন নমুনা । যেগুলো তার গবেষণার কাজে খুবই মূল্যবান ।
আজ সমর যাত্রা শুরু করেছে জাহাজে করে । এক সপ্তাহের এই যাত্রায় সে যাবে নতুন নতুন দ্বীপে । সংগ্রহ করবে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন । জানবে সেখানকার ইতিহাস ।
লেসবস থেকে যাত্রা শুরু হয় । সেখান থেকে শিয়স । শিয়স থেকে ইকারিয়া দ্বীপ পর্যন্ত পাঁচ দিনের ঘোরা সাঙ্গ হয় বেশ নির্বিঘ্নে । তারপর ইকারিয়া থেকে সাইকলাডিস দ্বীপমালার যাত্রাপথেই ঘনায় দুর্যোগ ।
জাহাজের ডেকে অনেক মানুষ সকালবেলায় জড়ো হয়েছে । নীল জলরাশি ভেদ করে এগিয়ে চলেছে সমরদের জাহাজ । সবাই উপভোগ করছে এই যাত্রা । সামনে তাকিয়ে দেখছে অসীম নীল সাগরে কেমন ভেসে ভেসে চলছে তাদের জাহাজ । অনেকেই ডেকে ঘুরছে । সেলফি তুলছে । নিজেদের ভাষায় কথা বলছে । গল্প করছে । সমর একমগ কফি নিয়ে ডেকের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে । তাকিয়ে থাকে সামনে । সীমাহীন নীল ফেনিল জলরাশির দিকে । হঠাৎ একজন জাহাজের স্টাফ আসে ডেকে । যাত্রীদের অনুরোধ করে ডেক খালি করে যে যার কেবিনে যেতে । আরও বলে , একটা মৃদু ঝড় আসছে । ডেকে থাকলে জলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা । সাগর কিছুটা উত্তাল হবে কিছুক্ষণ পর । তবে ভয়ের কিছু নেই । এই ঝড় জাহাজের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না । ক্যাপ্টেন নাকি এমনটাই জানিয়েছেন ।
সবাই ডেক খালি করে নিচে নেমে যায় । ঘন্টাখানেক পর ঝড় আসে । আবার মিনিট পাঁচেক পর চলেও যায় । জাহাজ কিন্তু ঠিকই আছে । শুধু ওই সময়টুকু প্রচন্ড দুলুনি আর ঝাঁকুনি অনুভব করছে সমররা । ব্যাস , তারপর সব আগের মতোই শান্ত ।
কিন্তু একটা বড় ব্যাপার ঘটিয়ে দিয়ে গেছে ঝড়টা । সমরদের জাহাজ দিকভ্রষ্ট হয়ে একটা অচেনা অজানা দ্বীপের কিছুটা দূরে জলের মধ্যে পাথরের দেয়ালে আটকে গেছে । না পারছে এগোতে , না পারছে পিছোতে । একজন কেবিন ক্রু বলে কথাটা । আরও বলে , দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট । কিন্তু এই দ্বীপ সম্পর্কে তারা কিছু জানে না । কখনও আসেনি এখানে ।
এখন আর ডেকে যেতে নিষেধ নেই । সমর বাইনোকুলারটা হাতে করে ডেকে আসে । নতুন অজানা দ্বীপের খবরে তার মনে আলোড়ন ওঠে । হয়তো ওই দ্বীপে গেলে ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে অনেককিছু নতুন ব্যাপার জানতে পারবে । সংগ্রহ করতে পারবে অজানা প্রত্নতত্বের নিদর্শন ।
চোখে বাইনোকুলারটা লাগিয়ে সে দেখতে থাকে দ্বীপটাকে । তেমন বিশেষ কিছুই চোখে পড়ে না । সব দ্বীপ যেমন হয় তেমন । বিস্তীর্ণ সাগরতট । বালুকা ভরা সৈকত । গাছগাছালি । এখানে কী সভ্যতা আসেনি ! পা পড়েনি মানুষের ! একটু অবাক হয় সমর । বাইনোকুলারটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দ্বীপের সব জায়গা চোখের সামনে আনতে চেষ্টা করে ।
হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় দ্বীপের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে । স্পষ্ট দেখতে পায় একটা সাজানো উদ্যান । আরও নিবিড় করে দৃষ্টি । সত্যিই তো । একটা সাজানো গুছোনো উদ্যান । সুন্দর সুন্দর গাছপালা তার মধ্যে । একটা সরোবরও চোখে পড়ে । আর সরোবরের ধারে ধারে ওগুলো কি ! সুন্দর সুন্দর কিছু মানুষের মূর্তি ! অবাক হয় সে । তাহলে এতক্ষণ যা ভেবেছে সব ভুল । এই দ্বীপে সভ্য মানুষের বসবাস । না হলে এমন সুন্দর সুন্দর মূর্তিগুলো কে তৈরি করবে । এগুলো প্রস্তুতে তো শিক্ষা-দীক্ষা-সভ্যতার প্রয়োজন ।
সমরকে অবাক করে এবার তার দৃশ্যপটে ফুটে ওঠে জীবন্ত মানুষ । যা প্রমাণ করে এই দ্বীপে জীবন্ত মানুষ আছে । আর সভ্যতার ছোঁয়াও আছে ।
সে দেখে , এক অতি সুন্দরী সাদা গাউন পরা নারী একটা মূর্তির পাশে এসে দাঁড়ায় । হাত বোলাতে থাকে মূর্তির গায়ে । একি দেখছে সে ! মূর্তিটার গায়ে চুম্বন করছে নারীটা । এ নিশ্চয়ই শিল্প সমৃদ্ধ দেশ । এতো সুন্দর সুন্দর স্থাপত্য । আর তার কদর করছে এক নারী । সমর মনে মনে ঠিক করে নেয় , তাকে যেতেই হবে ওই দ্বীপে । সংগ্রহ করতে হবে সেখানকার ইতিহাস । সংগ্রহ করতে হবে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন । না হলে তার গবেষণা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে ।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ । সমর সোজা হাজির হয়ে যায় ক্যাপ্টেন রবার্টের কাছে । বলে ,” মিস্টার রবার্ট , জাহাজের অবস্থা এখন কেমন ? কতক্ষণ এখানে আটকে থাকবো ! সামনে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে । সেখানে যাওয়া যায় না !”
ক্যাপ্টেন বলেন ,” আমরা চেষ্টা করছি মিস্টার । একটু সময় লাগবে । আসলে এতো সাইডে তো জাহাজ আসে না । গভীরতা কম । ঝড় আমাদের এনে ফেললো ! জলের ভিতরের পাথরের দেয়ালে আটকে গেলো জাহাজটা । নিচে ডুবুরি নামিয়েছি । ওরা যন্ত্র দিয়ে পাথরটা কেটে জাহাজ মুক্ত করবে । খবর পাঠিয়েছে , চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগবে । ততোক্ষণ একটু অপেক্ষা । এই সময়টুকু নিজের মতো করে কাটান । মুভি দেখুন । ইনডোর প্লে ব্যবহার করুন । সুইমিং পুলে গা ভেজান । সাঁতার কাটুন । কিংবা বারে গিয়ে গলাও ভেজাতে পারেন । এনজয় করুন মিস্টার । আর এই সময়টায় আমরা আমাদের কাজটুকু করে নিই ।”
সমর বলে ,” একটু দূরে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে । আমি এই সময়টুকু ওখানে কাটাতে চাই । কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিন ওখানে যাবার ।”
ক্যাপ্টেনের চোখে-মুখে ভয়াল ছায়া নেমে আসে । অবাক দৃষ্টিতে বলেন ,” ওই জনমানবহীন দ্বীপে কি করবেন ! আর কেনই বা যাবেন । ওখানে মানুষ যায় না । আর যদি বা যায় ফিরে আসে না । অনেক বদনাম ওই দ্বীপের ।”
সমর ক্যাপ্টেনের মুখের ভয়াল ছবি পড়তে পারে । কিছু ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে ওই দ্বীপে । তাকে সবটা জানতে হবে । সে জেদ ধরে । বলে ,” একটা ছোট নৌকোর ব্যবস্থা করে দিন ক্যাপ্টেন । আমি নিজে চালিয়ে যাবো । জানতেই হবে ওই দ্বীপের রহস্য । প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছি । অনেক সুন্দর সুন্দর পাথরের মূর্তি দেখেছি ওই দ্বীপে । সেগুলোর কিছু ছবি নিয়ে ফিরে আসবো । আর কিছু একটা ভুল হচ্ছে আপনার । ওই দ্বীপ জনমানবহীন নয় । একজন পরীর মতো সুন্দরী নারীকে দেখেছি । সে মূর্তিকে আদর করছে ।”
ক্যাপ্টেন বলেন ,” সেই জন্যই তো আপনাকে ওখানে যেতে নিষেধ করছি । ওই সুন্দরী নারীই তো সর্বনাশের কারণ । বিশদে আপনাকে বলতে পারবো না । শুধু বলবো ওখানে গেলে ফিরতে পারবেন না । সারা জীবন ওখানেই আটক থেকে যাবেন । একটু ধৈর্য্য ধরুন । আমাদের জাহাজ চালু হয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর । নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন সবাই ।”
সমর তবুও নাছোড় । সে যাবেই ওই দ্বীপে । আর ক্যাপ্টেনও যেতে দেবে না । এই কথা কাটাকাটির মধ্যে ক্যাপ্টেন বলে ওঠেন ,” ঠিক আছে । নিজেই যখন নিজেকে শেষ করতে চান , তাহলে আমার কিছু করার নেই ! আপনি একটা বন্ড লিখে দিন যে জাহাজ থেকে স্বেচ্ছায় অজানা দ্বীপে নেমে গেছেন ক্যাপ্টেনের নিষেধ না শুনে । আপনার দায়িত্ব আপনার নিজের । জাহাজ কর্তৃপক্ষের নয় । তাহলে একটা ছোট নৌকো দেবো আমি । আপনি একাই যাবেন । কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন , জাহাজ ছাড়াতে পারলেই আমরা চলে যাবো এই জায়গা ছেড়ে । আপনার জন্য অপেক্ষা করা যাবে না । আর করেই বা কী হবে ! আপনি তো আর ফিরবেন না । নিন , রেডি হয়ে নিন ।”
কিছুক্ষণ পর সমর ছোট্ট নৌকোর দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলে অজানা দ্বীপের দিকে । সঙ্গে খাতা-পেন , ক্যামেরা , কিছু ড্রাই ফুড , জলের বোতল আর বাইনোকুলারটা এনেছে । বাকি সব জাহাজেই আছে । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে , কেউ না ফিরলেও সে ফিরবে । ঠিক ফিরবে ।
আসলে দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তের ওই মূর্তিগুলো ও সুন্দরী নারী তাকে টানছে । ক্যাপ্টেন বলেছেন , জনমানবহীন ভয়াল দ্বীপ । ওই সুন্দরী নারীই সর্বনাশের কারণ । কেউ ফেরে না । কিন্তু কেন বলছেন এসব ! সবটা জানতে হবে তাকে ।
দ্বীপের কাছাকাছি চলে এসেছে সমর । এখানে কিছু ঢেউ আছে । পাড়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে যাচ্ছে ঢেউগুলো । দূরে তাদের জাহাজটা খুব ছোট লাগছে এখন । যেন ডিঙি নৌকো । ঘড়ি দেখে সমর । প্রায় এক ঘন্টা লাগলো এখানে আসতে । এবার দক্ষিণ দিকে যাবে সে । দাঁড় টেনে চলেছে সে । কাঁধে খুব কষ্ট হচ্ছে । এসবে অভ্যাস নেই তো । প্রথমবার । তাই এতো কষ্ট । কুছ পরোয়া নেই । নতুন আবিষ্কারের নেশা তাকে শরীরের কষ্টকে তুচ্ছ ভাবতে শেখায় ।
দশ মিনিটেই চলে আসে নির্দিষ্ট সৈকতে । একটা বড় বোল্ডার দেখে নৌকোটা বাঁধে । এবার এগিয়ে চলে উদ্যানটার দিকে ।
উদ্যানে ঢুকে আরও অবাক হয় সমর । বাইনোকুলারে দেখা উদ্যানের চেয়েও জায়গাটা আরও সুন্দর । একেবারে ছবির মতো । কতো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন । একটা ছোট প্রাসাদও আছে । হয়তো এই উদ্যানের মালিকের আবাস । কিন্তু সেই সুন্দরী নারী । সে কোথায় ! উদ্যানটা কী তার ! কিন্তু আর মানুষজন ! এগিয়ে যায় সমর একটা মূর্তির কাছে । খুব সুন্দর । যেন জীবন্ত মানুষ । কারও অভিশাপে পাথর হয়ে আছে ।
প্রায় আধঘন্টা সে ঘোরাফেরা করে উদ্যানে । মূর্তিগুলোর আশপাশে । ছবি তোলে । টলটলে জল সরোবরটায় । হাওয়ার টানে দোলা খাচ্ছে । সমর ভাবে , অনেকক্ষণ সে এই দ্বীপে আছে । কই , কোনো মানুষজন চোখে পড়ছে না ! এমনকি একটাও পাখি বা সরোবরের জলে মাছেদের কোনো নড়াচড়াও দেখতে পাচ্ছে না ! কেমন যেন নিস্তব্ধ-নির্জন । অনেকটা মৃত্যুপুরীর মতো । যদিও এখন সূর্যের আলো আছে । তবুও যেন চারপাশে গা-ছমছম পরিবেশ । তবে কি সে ভয় পাচ্ছে ! না , সে ভয় পেতে জানে না । ভয় তাকে ডরায় । ভয় বলে কিছু হয় না । অশরীরী , আত্মা , ভূত সবই মানুষের কল্পনা । অলৌকিক কিছু ভেবে ভেবে ভয় পাবে না সে । মন শক্ত করে সমর । এবার তাকে আওয়াজ দিতেই হবে ।
সমর চিৎকার করে ,” এখানে কেউ আছেন । আমি ভিন দেশি । কেউ থাকলে সামনে আসুন । আমি কথা বলতে চাই ।”
দরজা খুলে যায় ছোট্ট প্রাসাদটার । বাইনোকুলারে দেখা সেই সাদা গাউন পরা নারী বেরিয়ে আসে । তাকে দেখতে থাকে অবাক চোখে । তারপর অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে । একজন সুন্দরী নারীর এমন অট্টহাস্য সমর এর আগে শোনেনি । কেমন যেন হাড় হিম করা হাসি ! এ কি নারী ! না কি কোনো পিশাচিনি ! এসব ভাবতে ভাবতে নারীটির দিকে এগুতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায় সমর ।
নারী বলে ,” এই প্রথমবার কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছে । সবাই তো বিপদে পড়ে সাহায্য নিতে আসে । কেউ জাহাজ ডুবির পর । কেউ বা সাগরে দিকভ্রষ্ট হয়ে । তা , তুমি থামলে কেন ? এগিয়ে এসো । দেখো আমি কতো সুন্দরী । তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করি । তারপর তুমি আমার হয়ে যাবে । শুধু আমার । চিরকাল থাকবে আমার সাথে । আমার কাছে ।”
সমর বলে ,” কেন ? আমি তো কয়েকঘন্টার জন্য এখানে ঘুরতে এসেছি । আমি কেন থেকে যাবো এখানে !”
নারীটি বলে ,” এটাই তোমার ভবিতব্য । এখানে যারা আসে তারা আমার হয়ে যায় । ওই মুর্তিগুলোর মতো । তুমিও মূর্তি হয়ে যাবে আমার আলিঙ্গনে । এসো , তোমায় আলিঙ্গন করি ।”
চকিতে সমরের মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত গ্রিস কিংবদন্তির কথা । যা বহু বছর আগের কাহিনী । অতীত । ——-
একসময় এক গ্রিস মহাবীর এক দানবীকে হত্যা করেছিল এমন এক নির্জন দ্বীপে । সে নাকি মানুষদের ধরে এনে মন্ত্রবলে পাথরের মূর্তি বানাচ্ছিল । তাই সে মহাবীরের হাতে নিহত হয় । কিন্তু সেই দানবীর দুই বোন বেঁচে যায় । পালিয়ে আশ্রয় নেয় অন্য এক নির্জন মানবহীন দ্বীপে । একদিন খবর পেয়ে মহাবীর হানা দেয় সেই দ্বীপে । যুদ্ধ হয় সেই দুই নারীর সঙ্গে মহাবীরের । এক নারী নিহত হয় যুদ্ধে । কিন্তু অপর নারী জাদুশক্তির সাহায্যে পরাস্ত করে মহাবীরকে । তারপর মন্ত্রবলে তাকে পাথর করে দেয় ।
এর পরেও প্রতিশোধের আগুন নেভে না । জলপথে বিপদে পড়ে যত মানুষ এখানে এসেছে সবাইকে পাথর করে রেখেছে সে এতকাল ধরে । তাই এই দ্বীপ সম্পর্কে এতো ভয় মানুষের ।
সমর ভাবে , সে কি প্রতিশোধের আগুনে জ্বলা সেই দানবীর পাল্লায় এসে পড়লো ! তাই কি ক্যাপ্টেন রবার্ট বলেছিলেন , সুন্দরী নারীই সর্বনাশের কারণ । কিন্তু এ কি করে সম্ভব । এ তো গল্প কথা । এগুলো বিশ্বাস করতে মন চায় না ।
কিন্তু মন না মানলে কি হবে , তাকে তো বাঁচতে হবে । এই জন্যেই হয়তো ক্যাপ্টেন তাকে এই দ্বীপে আসতে দিতে চায়নি । ক্যাপ্টেনরা সব দ্বীপ সম্পর্কেই জানেন । জলেই তাঁদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে । সমর নিজের হটকারী সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হয় । ক্যাপ্টেনের কথা না শুনে সত্যিই সে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে । এখন তাকে এই নারী ছুঁয়ে ফেলার আগেই পালাতে হবে । উঠতে হবে নৌকোয় । ফিরে যেতে হবে জাহাজে । আগে জীবন বাঁচুক । পরে হবে যুক্তি-তর্ক । বিশ্বাস-অবিশ্বাস । পাথর হয়ে এই দ্বীপে থাকতে চায় না সে ।
সমর পিছন ফিরে ছুটতে থাকে সৈকতের দিকে । যেখানে তার নৌকোটা বাঁধা আছে । একবার নৌকোতে উঠতে পারলেই বেঁচে যাবে সে । পিছন থেকে দানবী তখনও তার পিছনে ছুটে আসছে । আর চিৎকার করে বলছে ,” তুমি পালাতে পারো না । তুমি তো আমার বাগানে থাকবে চিরকাল আমার আপন হয়ে ।”
সমরের কানে সেসব কিছু ঢুকছে না । শুধু তার ভিতরে বাজছে ‘ তাকে বাঁচতেই হবে । পৌঁছতে হবেই নৌকোয় ।’
ছুটতে ছুটতে একসময় সমর পৌঁছে যায় তার নৌকোটার কাছে । দড়ির বাঁধন খুলে সেটা ঠেলে দেয় সাগরে । তারপর এক লাফে উঠে বসে নৌকোয় । দাঁড় টেনে এগিয়ে চলে অনেক দূরের জাহাজটার দিকে ।
পিছন থেকে তখনও দানবীর চিৎকার শোনা যায় । –” ফিরে এসো মানব । এই দ্বীপ থেকে , আমার কাছ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ফিরে যায় নি । তুমিও যেতে পারো না ।”
সমরের অবসন্ন দেহ-মনে আর কোনো আওয়াজ এসে ঢুকছে না । সে শুধু জীবনের সব শক্তি দিয়ে দাঁড় বাইছে অগাধ জলরাশির মাঝে । গন্তব্য দূরের ওই পাথরের দেয়ালে আটকানো জাহাজ । যেখানে যেতে পারলেই সে বেঁচে যাবে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।