|| মানচিত্র আর কাঁটাতার, হৃদয় মাঝে একাকার || বিশেষ সংখ্যায় সায়নী বসু

একবার যদি

প্রাণপণে ছুটছে কুন্তল জঙ্গলের রাস্তা ধরে। পায়ের যা হাল তাতে ছোটার মত অবস্থা আর তার নেই, কিন্তু সেপাইগুলো যেভাবে তাড়া করেছে তাতে দৌড়ানোর গতিবেগ কমালে চলবেনা। ওদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে এভাবে মৃত্যু হওয়া ঢের ভালো।

‘ ঐতো একটা কুটির দেখা যায়, আর পারছিনা, একটু যদি বিশ্রাম নেওয়া যেত..’ এই ভেবে এক ভাঙাচোরা মাটির বাড়ির দিকে এগোয় কুন্তল।

– কেউ আছেন? আছেন কেউ ভিতরে?
বলে ডাক দিতেই দরজার একটা পাল্লা খুলে কেউ তাকে ভিতরে টেনে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমটায় সে দেখতেই পায়নি কে ছিল ভিতরে। ঘরের আধো অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতে পরিষ্কার হয় চেহারাটা। এত অপূর্ব লাবণ্যময়ী রূপ সে আগে দেখেনি, যেন এক দেবী তার সামনে উপস্থিত হয়ছে, যার থেকে চোখ ফেরানো যায়না। পরক্ষনেই মোহ ভঙ্গ হয় কুন্তলের, দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার ব্রতে ব্রতী কুন্তল আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করবে বলে ঠিক করেছে, এসব অযাচিত মোহ তাকে মানায় না। সে তার নিজের পরিচয় দিতে উদ্যত হলে মেয়েটি তাকে বলে ওঠে,
– থাক কিছু বলার দরকার নেই আমি যা বোঝার বুঝেছি। এখানে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিন ওরা এখানে আসবেনা।
কুন্তল কে একটি ছেঁড়া চটের ওপর বসতে বলে সে নিজে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় দরজার ফাঁক দিয়ে মুখটুকু বাড়িয়ে বলে যায়,
– বেরোবেন না কিন্তু। আমি ফিরে এলে আবার দেখা হবে তখন কথা হবে।

ওই জীর্ণ কুটিরের ছেঁড়া চটে নিজের সব ক্লান্তি সঁপে দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে কুন্তল। সেই ঘুম ভাঙ্গে ভোর হতেই। শরীরে তার বল ফিরেছে, কিন্তু মেয়েটি তখনও ফেরেনি দেখে সে কুটির ছেড়ে বেরিয়ে আসে পথে। দেখা হয় এক বৃদ্ধের সাথে। বয়স্ক মানুষটি কুন্তল কে দেখে বলে,

– এদিকে কি করছো বাছা? শুনলাম জঙ্গলের ধারে অনেকগুলো সেপাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে। দিনকাল ভালো নয় বাড়ি যাও।

অস্ত্রধারী সেপাইদের এত সহজে কে মারতে পারে তা ভেবে পায়না কুন্তল। তার দল এর কাছে তো তার খবর নেই তবে কি অন্য কোনো দল? বৃদ্ধটিকে সে প্রশ্ন করতে যায়,

– এই কুটিরের একটি মেয়ে..

কুন্তলের প্রশ্ন থামিয়ে বৃদ্ধটি বলে ওঠে,
– ওঃ কমলাকে খুঁজতে এসেছো? সে তো বছরখানেক আগে এক বিপ্লবীকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেছে।

সেই মুহূর্তে কিছুই বোধগম্য হয় না কুন্তলের। কিসব বলছে লোকটা! যাই হোক তার আর দাঁড়ানোর সময় নেই, অনেক টা যেতে হবে। একেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, গোপন খবরটা দলের কাছে তাড়াতাড়ি না পৌঁছতে পারলে বিপদ। তাই আর অপেক্ষা না করে আবার ছুট লাগায় সে।

*****
চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত, দেশের জন্য লড়াই করে করে কুন্তলের শরীর আজ ভেঙে গেছে, সেই সুঠাম দেহ আজ বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছে, একটাই স্বস্তি, দেশ আজ স্বাধীন। লাঠিতে ভর দিয়ে কুন্তল আবারও হাঁটছে চল্লিশ বছর আগে একদিন আসা সেই রাস্তাটায়, এখন সেখানে আর জঙ্গল নেই ততোটা, মেঠো রাস্তা গিয়ে মিশেছে পাট ক্ষেতে। জীবন সায়াহ্নে এসেও সেই রাতটা তার স্মৃতিতে অমলিন। একদল জোয়ান চাষী যাচ্ছিল ক্ষেতের দিকে, তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে,

– কি দাদু কোথায় যাও ওদিকে?
তাদের দিকে তাকিয়ে খুব ক্ষীণ স্বরে বলে কুন্তল,
– বলেছিল দেখা হবে, কথা বাকি ছিল যে। যদি একবার দেখা হয়। এ..একবার যদি!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।