শেষমেষ মেয়েটা রাজি হল। ছুটন্ত ট্রেনটার ভারী চাকাগুলোকে বেছে নিল। পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ, আটপৌরে শাড়িটা তুমুল ঢেউয়ে ঢেউয়ে লেপ্টে, প্ল্যাটফর্মটার একেবারে ধার ঘেঁষে ধনুক শিরদাঁড়াটার খানিক ছড়ানো বিভাজিকায় অল্প ঝুঁকে দাঁড়ানো।
ট্রেনটা ঢুকছে।
বডিটা ক’টুকরো হতে আর ক’সেকেন্ড।
কিন্তু না। লাইনটার উপর যেই ঝাঁপাতে যাবে, এক হেঁচকায় পিছন থেকে টেনে নিল একটা লোক। তারপর প্ল্যাটফর্মটার উপর ছিটকে পড়ে একেবারে বুকের ভেতর।
এত ভেতরে কে থাকে!
তার সঙ্গে দেখা হয়?
তো সেখান থেকে মুখ উঠিয়েই সপাটে একটা চড় কষাল মেয়েটি। তারপর সশব্দ ফণা তুলল, ‘কেন বাঁচালেন আমায়?’
লোকটা নিরুত্তর। হাঁপাচ্ছে।
মেয়েটি শান্ত হল।
গেল-রাতে রেপড্ হয়ে গেছে। কোল্ড ড্রিংকসের বোতলের ভেতর পাইপ ঢুকিয়ে সবটুকু টেনে নেওয়ার মতো বউটা খালি হয়ে গেলে স্বামীটি মুখ মোছে। তারপর গলা তোলে। পাল্টা স্বরে খেপে যায়। দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়ে। গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় মাঝরাতে।
এভাবে মাঝে মধ্যেই বাপের বাড়ি ছিটকায়।
তবে বেরোতে পারে না।
ক’দিন বাদে ফের মাথা নামিয়ে স্বামীগৃহে।
কিন্তু বাপের বাড়িটি এবার থুম। ঘুমন্ত রাতের মতো ঘাপটি মারা। এত ডাকাডাকি, শব্দ, কড়া নাড়া। কিছুতে ঘুম ভাঙে না। মেয়েটি শিকড় অব্দি কেঁপে ওঠে। কান্না পায়। ক্ষুব্ধ গাছের মতো চুপ। অভিমানে সারারাত পাতা ফেলে দেয় গা থেকে। তারপর ভোর হতেই একটা ছুটন্ত ট্রেনের উদ্দেশ্যে দৌড়তে লাগে।
কিন্তু না, কিছু ভোরের আলোর মতো মানুষ থাকে। পথে এমন একটা মানুষ দেখা দিল। পিছন থেকে আচমকা টেনে ধরল তাকে। কে এই লোকটা! পথে এইরকম কেউ পড়ে? পড়ার কথা?
#
প্ল্যাটফর্মটা থেকে বেরিয়ে এসেছে। লোকটার পাশে পাশে হাঁটছে। শাড়ির ভাঁজটা আস্তে ভাঙছে পায়ের কাছে। আঁচলটা মাঝে মাঝে গায়ে এসে লাগে। হঠাৎই না তাকিয়ে পাশে প্রশ্ন ঠেলল, ‘কী করেন?’
‘বাঁচি।’
‘মানে!’
‘বাড়ি বাড়ি পাখি কিনি।’
‘কেন?’
‘উড়িয়ে দিই।’
মেয়েটির চোখে জল, ‘মানুষ ওড়াতে পারেন?’
লোকটা থমকাল। ফের হাঁটতে লাগল। শহরটা থেকে এখন অনেকটা দূর। দূরে সীমানা ছাড়িয়ে এক মাঠ, জীবন, ছড়ানো আকাশ। লোকটা সেখানে পাখি ওড়ায়।
দুজনা সেদিকে হাঁটছে।
দূরে সরে যাচ্ছে শাঁখা, পলা, একটা রেললাইন…