হ্যালোইন ভুতের গল্পে সাহানা ভট্টাচার্য্য

তুহীরে

এই সময়টা আমার বেশ একলা লাগে, তুমি অফিস বেরোনোর পরে। টালিগঞ্জের এই ফ্ল্যাটে দুটো ঘরে আমি ঘুরঘুর করি – কখনো বা ফ্রিজের জিনিসগুলো এদিকসেদিক করি, কখনো বা তোমার জামাকাপড় গোছাই। একই কাজ আর কতবার করবো? তবু করি। কখনো কখনো নির্জন দুপুরে আমি ছাদের ধারেও দাঁড়াই কখনো। আজ আকাশ মেঘলা, গুমোট। আজ ছাদে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছিলো আগেরবার আমার কলকাতায় আসার কথা। এয়ারপোর্টের সেই মুহূর্ত – তোমায় প্রথম দেখা, তোমার প্রথম স্পর্শ, তোমার বুকে লুকিয়ে পড়ে চুরি করে ফুসফুস ভরে নেওয়া তোমার গন্ধ যেন সাতজন্ম পরিচিত।
ফুলগাছের টবে একটা ছোট্ট পোকাকে আঙ্গুল দিয়ে চিপে ধরে ফেলে দিলাম। মারতে কষ্ট হয়, হাজার হোক প্রাণ তো! হঠাৎ মনে পড়লো সেই শর্মার চায়ের দোকানে একটা কাপে দুই ঠোঁটের একসাথে চুমুক! তোমার হলুদ হুডিতে একটা ছোট্ট লালপিঁপড়ে দেখে আমি চিপে মেরেছিলাম। ইশ, সেই পিঁপড়েটাকে বাঁচানো গেলে বেশ হতো! আর সেদিন, পিকনিক যাওয়ার পথে উবেরের নিভৃতে তোমার খুনসুটির মাঝে হঠাৎ সেই মশাটা – হিহি, আমাদের খুনসুটি দেখে লজ্জাযা পালিয়ে গেছিলো বোধহয়! মঞ্চে তোমার পাশে বসে তোমার গান শোনা – মুখটা তো দেখোনি আমার, লজ্জায় লাল, ইশ! পরে তোমার পাশে নিজের ছবি দেখে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলাম। তোমার তো তাতেও আপত্তি – আমার ঠোঁট কামড়ানোর অধিকার তুমি আমাকেও দাওনি সেদিন। তোমার রূপে-গুণে-ভালোবাসাভরা কথা ও তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কাহিনী শুনে আবেগে-আশ্লেষে-আদরে আমার সবটুকু দিয়ে ঘিরে রাখার প্রতিজ্ঞাটুকু বড্ড মিষ্টি! আমার এবারের কলকাতায় আসার ঠিক আগেরবারেই ওই দেড়মাস আমার কলকাতাযাপনের দিনগুলোয় রোজ অপেক্ষা করতাম – আজ খবর আসবে তোমার ডিভোর্সের। আমার চোখে তোমার গভীর চোখদুটো রেখে রোজ বলতে তুমি, তোমার বৌ কত অত্যাচারী, অহংকারী! আহা তোমার মতো মানুষ কিনা এতো কষ্ট পেয়েছে! না, কখনও তোমায় যেন কষ্ট দিয়ে না ফেলি! কালীঘাট যাওয়ার দিন বন্ধু কৌস্তভকে ডাকলাম। বিয়ের সাক্ষী তো ওকেই রাখবো, তাই আজ সংকল্পের সাক্ষীটাও ওই থাক! পুজো দিয়ে নিয়ে আসা কালীঘাটের সিঁদুর যত্নে তুলে রাখলাম, তোমার ডিভোর্সের খবর পেয়ে মাথায় ছোঁয়াবো বলে। যতই থাকি বিদেশে, ঝাঁচকচকে শহরে, গ্রাম্য পারিবারিক মূল্যবোধ পারেনি তোমার হাতে নিজের শরীরের পূর্ণ অধিকার ছেড়ে দিতে! হাজার হোক, তুমি যে তখনও অন্য কারোর স্বামী! এখনকার মতন এই আদরটুকুই থাক! তবে এটা তো জানি, ওই দুটো চোখ, ওই হাসি, ওই জাদুভরা কণ্ঠস্বর তো শুধুমাত্র সত্যি কথাই বলে! ডিভোর্স তো হবেই, অত খারাপটা চলে যাবেই তোমার জীবন থেকে। আমার ভালোবাসা কি ঐটুকু আইনে আটকায়? অবিশ্বাস করবো তোমায়? পাগল?
নিজের পুরো গুগল ক্যালেন্ডার শেয়ার করিনি আগে কখনও কারোর সাথে। ঘড়ির সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক তো জানে সব্বাই, কিন্তু পুরো ঘড়িটা ভাগে ভাগে ধরে যায়, ছোট্ট ছোট্ট সুখদুঃখের মুহূর্তগুলো ধরে যায় – সেই জিনিসটা হলো ক্যালেন্ডার। তোমার হাতে সেটা তুলে দিয়ে নিজেকে বড় দায়মুক্ত মনে হয়েছিল, ঠিক যেমন নিজের আধো-অনাবৃত শরীরটাকে নির্দায় মনে হতো – ভিডিওকলের ওপার থেকে চুঁইয়ে আসা তোমার প্রবল আদরের পরে! মনেই হতো না আমরা দুটো মহাদেশে থাকতাম! সেবারে কলকাতা আসার আগে জমিয়ে শপিং করেছিলাম। মেসি’জ থেকে নিজের জন্য কিছু কিনতে পারিনি কখনও, বড় দাম। কিন্তু তুমি যে দুর্মূল্য, তাই তোমার জন্য ভ্যান হুসেনের ঘড়ি কিনে ফেলেছিলাম মেসি’জ থেকে, এক্কেবারে লেটেস্ট ফ্যাশন। সে ঘড়ির মডেল রিলিজ করেছে নিউ ইয়র্কে, আমার কেনবার পাঁচদিন আগে! সেদিন আমার নিজেকে দেবী অন্নপূর্ণা মনে হয়েছিল।
আগেরবার এতো কাজ নিয়ে এসেছিলাম কলকাতায়, কোথা দিয়ে যে তোমার সাথে থাকার সময় পেরোলো বুঝলাম না! নিজের অস্পর্শিত শরীরটাকে টানতে টানতে চোখের জলে বিদায় নিলাম তোমার কাছ থেকে। এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছিলে তুমি। ব্যাগ ভর্তি হয়ে রয়েছিল তোমার দেওয়া ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র উপহার – সেই আমাদের দুজনের ছবিটা, যেটা তুমি বিশাল করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে আমায় গুছিয়ে দিয়েছিলে। তোমার স্মৃতি, ফোনভর্তি তোমার ছবি আর হৃদয়ভর্তি তোমার ভালোবাসা নিয়ে ফিরে এসে ডুবে গেছিলাম কাজে আর রেওয়াজে! চটপট কাজ সেরে পাকাপাকি তোমার কাছে ফেরার তাড়া আমার, লকডাউন উপেক্ষা করে রোজ ল্যাব যেতে লাগলাম। লকডাউন – এই একটা শব্দ টালিগঞ্জ আর নিউ ইয়র্কের দূরত্বটাকে “মাত্র টেইশঘন্টা” থেকে হ্যাঁচকাটানে “মাসের পর মাস” করে দিলো। ঘ্যানঘ্যান মন, থৈথৈ ভালোবাসা আর অবিশ্রাম কাজ – খেয়ালই করলাম না টানা দু সপ্তাহ রোজ কথা হচ্ছে মাত্র পাঁচমিনিট করে। তুমি রাতে মাত্র পাঁচমিনিট কথা বলেই মাথাধরার কথা বলছো, ঘুমের কথা বলছো! তাতে কি? তোমার গায়ের গন্ধমাখা টিশার্ট আছে তো আমার! আমার ঘুম এসে যেত!
হঠাৎ একদিন হুঁশ এলো। রোজ তোমার ঘুম, নাকি ঘুমের অছিলা? প্রতিদিনের ভিডিওকলে হঠাৎ আদরগুলো বদলাতে লাগলো! কত কোলাহল, কত কলহ, কত অশান্তি – ঠিক দম্পতির মতো। যত ঝগড়া করতাম সময় চেয়ে, ততই একটু একটু করে তোমার দিকে আরো আরো এগিয়ে যেতাম।
তারপর একদিন হঠাৎ ভিডিওকল করে ফেলেছিলাম। অনেক ঘন্টা তুমি ফোন ধরতেই পারলে না। ইন্দ্রপতন হল, তোমার ফিরতি ভিডিওকলে। রাত্রিজাগরণ ও রতিশ্রমের ক্লান্তি ও তৃপ্তি তুমি সেদিন কথা দিয়ে লুকোতে পারছিলে না। পাশে বসে থাকা মহিলাটি, তুমি দিদি ডাকো, তার তৃপ্তিভরা হাসি আর ক্লান্ত চোখ আমার সন্দেহকে পোক্ত করলো। তোমার সঙ্গে আরও কোলাহল, তোমার করা আরো তীব্র অপমান – নিভৃতরাতে নিশি হয়ে ডাকলো বোধহয়। হৃদয় ভাঙলে অমন হয় শুনেছি – এক লহমা খুব যন্ত্রণা, পরের মুহূর্ত নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, পরের মুহূর্তে উজ্জ্বল আলো! লকডাউন আটকাতে পারলো না, গেলাম দমদমে – তোমার সঙ্গিনীর বাড়ির বেডরুমে। চিৎকার করতে লাগলাম তোমাদের মশারির বাইরে থেকে “দিদি, ওকে ছেড়ে দাও, ওর যে এখনো ডিভোর্স হয়নি!” তোমরা তখন এতই উন্মত্ত, আমায় দেখতেই পেলে না।
হিংসে হলো, কেন কে জানে! মিনিটখানেকের বেশি দাঁড়াতে পারলাম না তোমাদের প্রবল আদরের সামনে। চলে এলাম এ বাড়ী, যেটা আমাদের বাড়ী হওয়ার কথা ছিল বলে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েছিলে তুমি আমায়! সেদিন এসে কিচেনের ইন্ডাকশন ওভেনটা আলতো করে মুছলাম, যাতে তোমার জন্য রান্না করেছিলাম, তোমার অফিসের টিফিন বানিয়েছিলাম আগেরবার। ফ্রিজের মাথায় রাখা ছোট্ট আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করলাম। শোবার ঘরের আলমারি হাঁতড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তোমার-আমার সেই যত্ন করে তুলে রাখা ছবিগুলো পেলাম না। ফেলে দিয়েছো, না গো?
খাটের বেডকভারটা টানটান করলাম। বুঝতে পারলাম, দিদির সাথে এখানেও ঘনিষ্ঠ হয়েছিলে তুমি। অন্ধকারে মিশে মেঝেতেই বসে পড়েছিলাম সেদিন। তোমার ইলেক্ট্রনিক তানপুরা চালিয়ে গাইলাম – “তুম তো বালমা জ্যায়সে তারোঁ মে চন্দা, তুম চন্দা ম্যায় চকোর, নজরিয়া নাহি লাগে কঁহি ওর”
পরের দুদিন তুমি বাড়ি এলেনা। যেদিন এলে, সেদিন থেকে তোমার একুয়ারিয়ামের পিছনের অন্ধকারে মিশে রইলাম আমি। দেখলাম, আমার না-থাকা তোমায় কতটা মুক্তির আনন্দ দিলো! তুমি ডুবে গেলে মাদকে-নারীতে! সে নারীদের বলতে লাগলে তোমার বৌয়ের দেওয়া কষ্টের কথা, যেমন আমাকে বলেছিলে। সাথে এবারে বলতে লাগলে আমার শরীর-মনের কুরূপের কথা! নারীরা তোমায় আগলে নিলো।
তাহলে কি আমাকে যেগুলো বলতে তোমার বৌয়ের করা অত্যাচারগুলো – সেগুলোও মিথ্যে ছিল?
একোয়ারিয়ামের পিছনে, সিঁড়ির অন্ধকারে, বাথরুমের ক্যাবিনেটের আড়ালে অন্ধকারে রইলাম লুকিয়ে, সে কি চারটিখানি কথা! ঐভাবে লুকিয়ে থাকা যায়? তুমি আমার নাম দিয়ে এতো মিথ্যে বলছো জোরেজোরে, সক্কলের কাছে – আমার খালি ইচ্ছে করছিলো বেরিয়ে এসে তোমার কলার চেপে ধরতে! জানি তো তোমার কলার চেপে ধরলেই তুমি ভুলে যাও সব, তোমার সিগারেটের গন্ধেভরা ঠোঁটদুটো দুষ্টুমি শুরু করে দেয়!
দুমাস এমনি করে লুকিয়ে আছি। তুমি অফিস বেরোলে নিজের মতো থাকি, অন্যসময়গুলোয় কিকরে যে তোমার চোখ এড়িয়ে থাকি তা শুধু আমিই জানি।
ধুর, ভালো লাগছে না, আজ তুমি বাড়ি আসার পরে তোমায় একবার চোখের দেখা দেখে নিয়ে ভাবছি চলেই যাই!
কলিংবেল, তুমি এলে, চাবি খুলে ঢুকলে। বাথরুমে স্নান করতে ঢুকে কি গুনগুনাচ্ছো আজ? আহা! “তু হী রে”! আহা এ গান প্রথম আমায় ভিডিওকলে শুনিয়েছিলে। দুমাস পরে আজ প্রথমবার চোখে জল এলো। তুমি বাথরুম থেকে বেরোনোর আগেই পালাতাম, মনে পড়লো তোমার দেওয়া কালীঘাটের সিঁদুরের প্যাকেটটা আমার আঁচলে বাঁধা। তড়িঘড়ি ঘরে এলাম আলমারিতে ডুপ্লিকেট চাবির গোছা আর সিঁদুরটা রেখে বেরোতে যাচ্ছি, তোমার মুখোমুখি পড়ে গেলাম। মায়ের সিঁদুর, ফেলতে নেই যে, কিন্তু তোমার মুখোমুখি পড়তে চাইনি বিশ্বাস করো!
খোলা আলমারী দেখে তুমি এগিয়ে এলে!
সেকি! একটা নিরীহ সিঁদুরের প্যাকেট আর একগোছা চাবি দেখে এতো ভয় পেয়ে গেলে! ডাক্তার ডাকবো? কি করি এখন?
তুমি এতো ভীতু মানুষ টের পাইনি গো! ভাগ্যিস, তুমি সেদিন এফডিআর ড্রাইভের ওপর উল্টো দিক থেকে প্রবলবেগে ছুটে আসা ট্রাকে-থেঁতলানো দলাপাকানো রাস্তায় মিশে যাওয়া আমার বিচ্ছিরি রূপটা দেখোনি! সারাজীবনে আর কোনোদিন ভয় ভাঙতো কিনা, কে জানে! কিন্তু ভাগ্যিস ট্রাকটা এসেছিলো, নাহলে লকডাউন না মেনে এবারে কলকাতা আসতাম কিকরে?
ও কি? কাঁদছো? কেঁদো না! বরং আর মিথ্যে বলোনা আমায় নিয়ে! আর কখনো কোন মেয়েকেই মিথ্যে বোলোনা, কেমন?
কথা ছিল দুজনে একসাথে ভালো থাকবো। অন্ততঃ কোনো একজন তো ভালো থাকুক!
তুমি ভালো থেকো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।