সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ২২)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

বিন্দু ডট কম

-আমাকে মুক্তি দাও অখিলেশ।আমি আর পারছি না।
তরুলতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় যতবার ,ময়ালসাপটা ততোবার ঘিরে ধরে তাকে।ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে তার ঘাড়ে।তারপর লাফাতে থাকে।তরুলতার পাদুটো যেন ডানার মতোই ক্রমশ অবশ হয়ে উঠছে।সেই সাপের খোলশের আড়াল থেকে মিটিমিটি জ্বলন্ত দুটো চোখ হঠাৎ অখিলেশের হয়ে যায়।তার মুখে লালা গড়িয়ে পড়ছে।
-লেপিডপঠেরিস্টদের থেকেও প্রজাপতি কাকে বেশি ভয় পায় জানো তরুলতা?মাকড়শার জালকে।লেপিডপটেরিস্ট তাকে বেশি কষ্ট দেয় না।কারণ সে শিল্পী। আর ঊর্ণনাভ…
-কেন এমন করছো অখিলেশ?কী চাও তুমি?তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম হঠকারিতায়।এটাই কি আমার অপরাধ?
ময়াল সাপ ধীরে ধীরে তার বন্ধন শিথিল করতে থাকে।সোফায় হেলে শুয়ে পড়ে।অথচ তার চেড়া জিব আর কন্ঠ থেকে অট্টহাসি বেরিয়ে আসে।
-তুমি আর চাও না তরুলতা?মা হতে?নাকি এবার তুমি কাহিনীর নায়িকা হতে চাও?
-তুমিও তো ওয়ান্ডারার প্রজাপতি হয়ে গেলে অখিলেশ।সেই একই পথে আসাযাওয়া করছো।তোমাকে একদিন ডুলুঙ নদী ভেবেছিলাম।আজ চেষ্টা করেও একটা মরাসোঁতার বেশি কিছু ভাবতে পারি না।
-বেশ।তাই না হয় হলাম।কিন্তু তুমি কী হবে তরুলতা?সুচরিতার মতো মা হতে চাও নাকি মেরিলিন মনরোর মতো নায়িকা?
-বারবার নায়িকার কথা বলছো কেন অখিলেশ?আমি কী প্রজাপতি হয়ে গেলাম তোমার অ্যালবামের?সকাল থেকে তো নজরবন্দি রয়েছি।আমার প্রতিটি চাল চলন তোমার ক্যামেরা বন্দী…
-বাহ তরুলতা।তুমি আমার অ্যাসেট।ধরে যখন ফেলেইছো এটা,তোমাকে একটা জিনিস দেখাই..
ময়াল সাপ এতক্ষণে প্যান্ট জামা গলিয়ে খানিকটা মিনুষের মতো দেখতে লাগছে।কিন্তু তরুলতা তখনও নগ্ন।দেখতে চাস তো?দ্যাখ কতো দেখবি।একটা টাওয়েল কোনও মতো উরুতে জরিয়ে সে স্নানঘরের দিকে যাচ্ছিল।কী অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে তার মধ্যে।আগে এই গায়ে লেগে থাকা গন্ধটা তার মুছতে ইচ্ছে করতো না।এখন ঠিক সেটাকেই সে ঘৃণা করে।অখিলেশ নামক একটা ঘেন্না লেগে আছে তার শরীরে।
-এখানে এসো তরুলতা।দেখো তো নিজেকে চিনতে পারো কিনা?
তরুলতা আবার সোফার কাছে আসে।অখিলেশ তার মোবাইল স্ক্রিনের দরজা খুলে ধরল তার সামনেই।দেখামাত্র অবচেতনেই তরুলতা তার শাড়ির আঁচল খুঁজতে শুরু করলো পাগলের মতো।কী আশ্চর্য!যে নগ্নতা এতক্ষণ এক নীরব প্রতিবাদ হয়ে লেপ্টে ছিল তার শরীরে,সেই নগ্নতাই মুহূর্তে হয়ে উঠলো তার দুর্বলতম দিক।অখিলেশের মোবাইলে লোদাশুলি জঙ্গলের সেই রিসর্ট ঘরের ছবি।তরুলতা ডানা মেলে বলছে,”এই প্রজাপতির নাম তল্লার…”।পাতার আশ্রয় খুঁজছিল যে ডানা মেলা কীট,আজ তার আকাশপাতাল জুড়ে যেন শুধুই প্রতিধ্বনি হচ্ছে একই শব্দ।পাতার আশ্রয় খোঁজে।ওরা পাতার আশ্রয় খোঁজে।তরুলতার মাথাটা যেন এইবার ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।সে দুইকান প্রাণপণে চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়ে।বিড়বিড় করে বলে,”ইউ বাস্টার্ড।সান অফ আ বিচ।ইউ রেকর্ডেড ইট!”
মুহূর্তে ময়াল সাপটা একটা মাকড়শার জাল হয়ে ওঠে।
-শুধু ওটাই নয় তরু।আমার প্রতিটা ক্লিপ রেকর্ড করা আছে।আধোভ্যাজানো দরজার আড়াল থেকে আমার দক্ষ অনুগামীরা সেই সব রেকর্ড সযত্নে করে রেখেছে।
-তাহলে আর অপেক্ষা কেন?ছেড়ে দাও ওদের আন্তর্জালে…
অখিলেশ একটা চুরুট ধরায়।একসময় তরুলতা বিদেশী সিনেমা দেখতো অনেক।তার ওই সোফায় বসে থাকা লোকটাকে চেনা লাগছেই না।সে চুরুটের ধোঁয়ার মাধ্যমে হয়ে উঠছে কোনও অ্যালফ্রেড হিচককের ছবির খলনায়ক।তার চুরুটের ধোঁয়া তৈরি করছে মাকড়শার জাল।সেই জাল লেপিডপটেরিস্টের জালের থেকেও ভয়ঙ্কর।
-মন্দ বলোনি।ইন্টারনেটে এগুলো দিলে আগুন জ্বলবে।কিন্তু কী জানো,আই এম আ ফ্যামিলি ম্যান।আমার তোমার বর,কী যেন নাম,ওই লিটল ম্যাগাজিন পাগল?ইয়েস
শুভব্রতর কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে।হি ব্লাডি লাভস ইউ….”
বাস্তবে ফিরে এসে তরুলতা দেখে তার চারপাশ দুলছে।লোকটা শুভব্রতর কথা জানলো কী করে?তাহলে কি শুভব্রতকেও ফলো করছে অখিলেশের চোখ?আর সে জানলো কী করে শুভব্রত তাকে ভালোবাসে?তবে কী ওদের মধ্যে যোগাযোগ আছে?
-আপনি শুভব্রতর কথা জানলেন কী করে?
-কাম অন তরুলতা।এতো দারুণ অরগ্যাজম যার সঙ্গে মিলনে,তাকে ‘আপনি’ বলতে হয় নাকি।তাছাড়া আমার সবখানে চোখ আছে।তোমার বরটা পাগল।ওই সম্পাদক কবি শিল্পী টাইপের।আমি এইরকম আরেকজনকেও চিনি।যাক সে কথা।বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু মেস ইয়োর লাইফ।আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই তরুলতা।
-হঠাৎ। এতো মানবিক!একটু একঠু করে রস শুষে নেবে বলে?মাকড়সার মতো?
-না।তীর্থর জন্য। ঠিক অতোটুকুই সত্যি এখনও এই শরীরে বেঁচে আছে।কিন্তু তুমি বাঁচতে হলে আমার শর্ত তোমাকে মানতে হবে।
-কোন শর্ত?সব শর্তই তো মানছি।একটা মেয়ে যা যা কিছু দিতে পারে,সব দিয়েছে তোমায়?আর কী চাও তুমি?বারোয়ারি করবার বিনিময় ব্ল্যাকমেইলিং?
-না।বলছি।আগে স্নান সেরে এসো।
শাওয়ার চালিয়ে তরুলতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।একদিন সঙ্গীতার বাড়িতে একসঙ্গে স্নান করেছিল দুজন।তখন দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক।একটা পরীক্ষা ছিল ওটা।চুম্বন করেছিল দুজনে দুজনকে।কিন্তু ওইটুকুই।তখন সে খুব টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করতো।মনের মাধ্যমে আরেক মনকে খবর পৌঁছে দেওয়া।আজ যেন তরুলতা প্রাণপণে চাইছিল তার সামনে সঙ্গীতা এসে দাঁড়াক।সে তো ল ইয়ার।তাকে আর শুভব্রতকে পারবে না সে বাঁচাতে?ঠিক পারবে।হঠাৎ যেন তার শুভব্রতর জন্য আবার মন কেমন করে উঠল।ওই সোফায় বসে থাকা ময়াল সাপটাও জানে শুভব্রত তাকে ভালোবাসে।অথচ সে জানে না?কেন জানতে পারেনি এতোদিন।তবে কি তার জীবনের সবকটা ট্যালি শিট ভুলে ভরা?সব অডিটিং ভুল?
চুল খোলা রেখেই অখিলেশের মুখোমুখি বসলো তরুলতা।বোঝাপড়া হয়ে যাক।কী চায় লোকটা?অখিলেশ প্রজাপতি অ্যালবামের উপর হাত বোলাতে বোলাতে বলে।
-আন্তর্জালের মহাবিশ্বে তোমার আর আমার ওই মুহূর্তগুলো এক একটা বিন্দুর মতো তরুলতা।আলোর নয়।ও বিন্দু অন্ধকারের।তুমি ভেবো না।ওই বিন্দুগুলো আমার কাছে সুরক্ষিত থাকবে।নিরাপদ ও গোপন থাকবে।যদি তুমি আমার শর্ত মেনে চলো।
-বলো।তোমার শর্ত।
-গুড।এটা একটা খেলা হিসেবে নাও তরুলতা।একটা ক্লাব।তুমি বুদ্ধিমতী।ঋতবানের মতো আবেগপ্রবণ মূর্খ নও।এই যে বেলদার ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চটা দেখছো,এটা একটা আই ওয়াশ।আসলে এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়।সেখানে কালো বিন্দুগুলো সাদা হয়ে যায়।সমরজিৎ দলুই তেমনই একটা বিন্দুমাত্র।
-আর আপনি কুশীলব?
-না।আমি একজন বিপন্ন পিতা।তীর্থ আমার বিপন্নতা…
-আর বাকিদের বিপন্নতা?
-এ জগতে সকলেই বিন্দুর মতোই বিপন্ন তরুলতা।তার কোনও নিজস্ব ডাইমেনশন নেই।সমরজিৎ দলুই বা অন্যান্য যারা আছে,তাদের কয়লাখাদান,অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার,কাঠচেড়াইয়ের কালোকারবারির সাক্ষী আমি।বলা বাহুল্য আমাকে ওরা সেই কারণে অনেক অর্থের মার্জিনও দেয়।কিন্তু একাজ আমার একার পক্ষে চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আমার মেধা দরকার।মেধাবী মস্তিষ্ক। তোমার যেটা আছে।
-আমাকে কি করতে হবে?
-যে সাপের গর্ত তুমি খুঁড়ে বের করেছো আজ,তার সদস্য তুমিও।প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে।আমি চাই,পরোক্ষ প্রত্যক্ষে বদলে যাক।তুমি চলে এসো আমার দলে।
-তাতে আপনার লাভ।
-পাতার আশ্রয় তরুলতা।পাতার আশ্রয় শুধু প্রজাপতিই খোঁজে না।লেপিডপটেরিস্টও খোঁজে।সে পাতা কাগজের পাতা।অ্যালবামের পাতা।
-ঋতবানের কি বিপন্নতা লকারবন্দি করে রেখেছেন আপনি?
-ওকথা জিজ্ঞেস করবে না তরুলতা।কাল থেকে আর তুমি বন্দি থাকবে না।তোমার নামে একটা গোপন অ্যাকাউন্ট থাকবে ব্যাঙ্কে।সেকথা তুমি জানবে।আর আমি জানবো।সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ফান্ড ট্রান্সফার হবে।সরাসরি নজরবন্দি না থাকলেও আমার চোখ সর্বত্র আছে তরুলতা।তারা তোমাকে দেখবে।ঋতবান বা অন্য কারো সঙ্গে তোমার কথা বলবার দরকার নেই।তুমি সরাসরি কথা বলবে আমার সঙ্গে।অন্যথা হলে এই মোবাইলবন্দি বিন্দুগুলোকে আমি সমুদ্রে পরিণত করে দেব।কী?বুঝলে?
তরুলতা ঘাড় নাড়লো।সে যে সম্মতির না অসম্মতির সে নিজেও জানে না।একঝলক ভেসে আসছে টাই জিন্স পরা তীর্থর মুখ।এক ঝলক সুচরিতার।একঝলক শুভব্রতর।আর একঝলক ঋতবানের।এদের সকলের বিপন্নতার সুতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে অখিলেশ।
-কাল দেখা হচ্ছে তাহলে ডার্লিং। সুইট ড্রিমস।
অখিলেশ ঝড়ের মতো ঘর থেকে বের হতেই তরুলতা দেখলো তার মোবাইলটা নেই।অখিলেশ নিয়ে গেছে!শুধু অফিসের সময়টুকু সে পাবে।যতোদিন না সে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করছে এই নতুন কাজে।কিন্তু সেই মানুষটার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার কোনও পরীক্ষাই তো সে দেয়নি এতোদিন।সেই মানুষ শুভব্রত।ঈশ।সত্যিই যদি টেলিপ্যাথি হতো।সে কথা বলতো শুভব্রতর সঙ্গে। কী বলতো?সত্যিই তো।একটা বিপরীত মেটামরফোসিসে প্রজাপতি থেকে পিউপা হয়ে যাচ্ছে তরুলতা।তার হাত পা গুটিয়ে যাচ্ছে।কাল সকাল থেকে সে শুধু একটা শুঁয়োপোকা হয়ে যাবে।তখন শুভব্রত তাকে দেখে চিনতে পারবে কি?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।