কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুজিত চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ৪)

নীলচে সুখ 

সকালে ডেকে ঘুম ভাঙাতে হলো না। প্রবল বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার দাপাদাপি তে ঘুম এমনিই ভেঙে গেল।
নীল ঘরের বাইরে এলো। পাহাড়ি বৃষ্টিকে আরও কাছ থেকে দেখবে বলে। বারান্দায় এসে দেখলো মানালি , একা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে একমনে তাকিয়ে আছে , পাহাড়ের গায়ে ঝরে পরা মুক্তোগুলোর দিকে। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে আসা জলের কণায় ভিজে যাচ্ছিল ওর এলো চুল, শান্ত মুখ। মানালি যেন আশ্রয় দিচ্ছিল , প্রশ্রয় দিচ্ছিল অপরুপ প্রকৃতির ভালবাসাকে। লালন করছিলো তাদের সর্বাঙ্গে।
একি! মানালি,,
নীলের আচমকা ডাকে সামান্য চমকে উঠে পিছন ফিরে বললো ,,,, ও, তুমিও উঠে পরেছ। দ্যাখো , কী সুন্দর বৃষ্টি। জানো, আমি জানতামই না বৃষ্টি এমন আশ্চর্য রকম সুন্দর। সিনেমায় দেখেছি , গল্পে পড়েছি। কিন্তু বাস্তবে এই প্রথম। সেগুলোর সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই। বলেই চটকরে ঘুরে, নীলের চোখের দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো জিজ্ঞেস করলো ,
তোমার ভালো লাগছে না ?
সেই সময় মানালির হাত দুটো মুঠো করে বুকের কাছে জড়ো করা ছিল। আর কাঁপছিল থরথর করে , ভিজে যাওয়া পাখির মতো।
নীল কিচ্ছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইলো। এমন অপরুপ ক্ষণে সম্ভবত কথারা নির্বাসনে যায়। শুধু কথা বলে মন। সে কথারা ভেসে যায় , মন থেকে মনে , চোখ থেকে চোখে। সাক্ষী থাকে সময় ,
শুধুই সময় ।
কী ব্যাপার রে তোদের ? ভোরবেলা এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টির জল গায়ে লাগাচ্ছিস। অসুখে পরবি যে। মিসেস রায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠসর। তৈরি হয়ে নে। গাড়ি এসে যাবে তো ! বাবা নীল , তোমরাও যাও। রেডি হয়ে নাও। ওফ্ফ , হঠাৎ কিরকম বৃষ্টি আরম্ভ হলো বলো দেখি,,, সময় মতো বেরতে পারলে হয়। দুরছাই ভালোলাগে না।
আওয়াজ শুনে তন্ময় বেরিয়ে এসেছে। পাশের ঘর থেকে প্রফেসরের ফরমায়েশ ভেসে এলো,,,
একটু চা পাওয়া যায় কিনা দ্যাখো না,,,,। ইন্টারকম কাজ করছেনা,,,,,,।
তন্ময়, করিডর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। চায়ের তদারকি করতে।
সবাই রেডি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। গাড়ি এলো ন’টায়। দেরির কারণ জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। অকাট্য যুক্তির সাজানো বাহানা তৈরিই আছে। সুতরাং সময় নষ্ট করার কোনও মানেই হয়না। এখন বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে আকাশের যা অবস্থা , ভরসা করা যায় না। ব্যাগ গুছিয়ে সবাই বসতেই গাড়ি রওনা দিলো , লাচেন লাচুনের পথে।
যে ভয় ছিল , তাই হলো। বেশ কিছুদূর যাবার পরেই আবার বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি চললো। তবে খুবই ধীরগতিতে। দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু ওদের মনের মধ্যে ভয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইভাবে রিস্ক নেওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছেনা। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। কেননা , বিপদটা তাহলেও একই থেকে যাচ্ছে। উপায় নেই। এগিয়েই যেতে হবে। জানালার কাঁচ সব বন্ধ। কাঁচ গুলো সাদাটে হয়ে গেছে। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। আশ্চর্য ভয়ার্ত নীরবতা বিরাজ করছে গাড়ির ভেতর। আরও কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার আর তার সঙ্গী , দুজনেই নেমে গেল নিঃশব্দে।
মিনিট খানেক অপেক্ষা করে , ব্রজেশ আর দীপেন নেমে গেল। প্রায় তক্ষুনি ফিরে এসে খবর দিলো। গাড়ি আর যাবেনা। সামনের রাস্তায় বিরাট ধ্বস নেমেছে। রাস্তা বন্ধ।
মিসেস রায়, হতচকিত হয়ে বললেন,,, তাহলে , কী হবে এখন। এই পাহাড়ি রাস্তায় জঙ্গলে রাত কাটাতে হবে নাকি,, সর্বনাশ,,।
বড়ো বড়ো চোখ ভয়ে আরও বড়ো হয়ে গেল। প্রফেসর, চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেছেন। কারণ , মনেহয় উনি বুঝতে পেরেছেন , চশমা চোখে খুঁজেও , এই বেমক্কা বিপদ থেকে বেরুনোর পথ পাওয়া দুষ্কর। অসহায় ভাবে নীলের দিকে তাকিয়ে বললেন ,,, নীল, কিছু একটা ব্যবস্থা কী করা যায় , মানে এই ঝড়বৃষ্টিতে পাহাড়ি জঙ্গলে,,
নীল হঠাৎ লক্ষ্য করলো , মালতি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে না জানি কী ছিল। নীল একলাফে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে গেল। তার সঙ্গ নিলো বাকি তিনজন। ওদের চলার ভঙ্গিতে দৃঢ়তার চিহ্ন স্পষ্ট ।
পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই , ওরা চলে গেল দৃষ্টির বাইরে। এখন একটানা ঝিঁঝি পোকার কান্না ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বৃষ্টি থেমে গেছে। আলো কমে আসছে । সন্ধ্যা নামছে ।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।