কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুজিত চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ৭)

নীলচে সুখ

নীল আর মানালি চাঁদের আলোয় হেঁটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তায়। একটা বাঁক ঘুরতেই তারা দেখলো, পাহাড়ের কোলে একটা মন্দির। মন্দিরের চারপাশ বেশ আলো সাজানো। জেনারেটর ব্যবহার করা হয়েছে। আরও এগিয়ে গেল মন্দিরের কাছে। বেশ কিছু মানুষের ভীড়। সবাই স্থানীয়। সেখানেই হচ্ছে সেই ভজন গান। যা দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। কাছে গিয়ে মূর্তির দর্শন করলো। দুর্গা মূর্তি। পার্বতী। পর্বতেই যায় আবাস। প্রণাম সেরে ঘুরে দাঁড়াল। এবার ফিরতে হবে। লজ থেকে অন্তত মাইল খানেক দূরে চলে এসেছে ওরা। সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। অচেনা অজানা জায়গা। কাউকে তেমন করে কিছু বলে আসা হয়নি। মানালির বাবা মা দুশ্চিন্তা করবেন , তাতে আশ্চর্যের কী! ঠান্ডাও এখানে অনেক বেশি।
ঠিক তখনই একজন সাধু গোছের লোক , তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সাদা দাড়ি গোঁফ। মাথায় সাদা লম্বা চুল। সাদা ধুতি আর গায়ে একটা সাদা শাল। অনেকটাই বয়স হয়েছে। হাতে একটা পিতলের থালা , তাতে কিছু পাহাড়ি ফুল আর খেজুর কিসমিস। মৃদু হেসে বললেন,,, দুর্গামাঈ আপকা ভালা করে। লিজিয়ে , পরসাদ লিজিয়ে।
ওরা অযাচিত এই আহ্বানে একটু কুন্ঠিত বোধ করলো। তারপর আড়চোখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নির্বাক সম্মতিতে, বাড়িয়ে ধরা থালা থেকে ইতস্তত ভাবে যৎসামান্য প্রসাদ তুলে নিলো।
লোকটি অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে দুজনের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তে বললেন,,,
দুর্গামাঈ আপ দোনো কো সুখী রাখে , কুশল মঙ্গল রাখে। জয় দুর্গামাঈ।
লোকটি ভীড়ের ভেতর চলে গেলেন ।
ওরা ফেরার পথ ধরলো।
মন্দির চত্তরের বাইরে এসে , নীল বললো,,,
মানালি , তোমার কাছে রুমাল আছে ?
মানালি অবাক হয়ে বললো , হ্যাঁ আছে , কেন ?
নীল দাঁড়িয়ে গেল। বললো,,, গুড, দাও।
মানালি হাতের ছোট ব্যাগের ভেতর থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো। নীল, রুমালটা নিয়ে বললো ,,,, এবার তোমার হাতের প্রসাদ আর ফুল গুলো এর মধ্যে রাখো। মানালি যন্ত্রচালিতের মতো তাই করলো ।
নীল নিজেও তার হাতে ধরে রাখা ফুল, প্রসাদ রুমালের মধ্যে রেখে ভালো করে বেঁধে , মানালির হাতে ফেরৎ দিয়ে বললো ,,,
নাও, যত্ন করে রাখো। এটা এখন আমাদের কৈফিয়ত কিংবা সাক্ষী যা খুশি বলতে পারো।
মানালি কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে বললো ,,,
তার মানে ?
তার মানে লজে ফিরে গেলেই বুঝবে। কতরকম প্রশ্নের মুখে পরবে জানো ? কোথায় ছিলি , কোথায় গেলি, এতো দেরি কেন? উরিব্বাস!
সব প্রশ্নের মুশকিল আসান, এই দুর্গা মা’য়ের প্রসাদ। কী? কিছু ঢুকলো মাথায় ?
মানালি হি হি করে হেসে বললো,, যাঃ, খালি ফাজলামো।
নীল বললো , তোমার কোন কলেজ যেন ?
_ রামমোহন , কেন ?
_ ওই তো,, সেই জন্যেই,, পড়তে আমার মতো প্রেসিডেন্সি তে,,, দু-দিনেই বোলচাল , মগজ সব অন্যরকম গল্প হয়ে যেতো ।
_ আরে রাখো তোমার প্রেসিডেন্সি । ওখানে কি-হয় নাহয় সবাই জানে। আমার বোলচাল মগজ ঠিক জায়গাতেই আছে।
_ আরে আমারই সামনে , আমার কলেজের কুৎসা! না না এ অসহ্য।
_ ঠিক আছে , তুমি তোমার অসহ্যতা নিয়ে সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। আমি চললাম।
মানালি সত্যিই গটগট করে অন্ধকারে মধ্যে হাঁটতে শুরু করলো । নীল থতমত হয়ে পিছন থেকে বললো ,,,, আরে, কী মুশকিল । আমি আসছি তো। মানালি সেকথায় ভ্রুক্ষেপ না করে , তার চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো। নীল পিছন থেকে প্রায় ছুটে এসে মানালির হাত ধরে ফেললো।
মানালি একটুও সেই হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো না। শুধু মুখে কৃত্রিম বিরক্তি ভাব এনে বললো ,,, প্রেসিডেন্সি ।
মানালির নরম হাত , নীলের শক্ত মুঠোয় ধরা। সেটা কী মানালির নিরাপত্তার কারণে , সাবধানতা! নাকি আবেগ দূর্বলতা ! কারণ যাইহোক , এক আশ্চর্য সুন্দর সুখানুভূতি স্নিগ্ধ ঝর্ণার মতো বয়ে যাচ্ছিলো , দুজনের মনের গহীনে, যা অব্যক্ত।
নীল, হালকা ধমকের সুরে বললো,,,, অন্ধকারে ঐভাবে কেউ দৌড়োয় ! আছাড় খেলে বুঝতে মজা।
মানালি , একটু সময় চুপ করে থেকে বললো,,,,
অন্ধকার পাথুরে রাস্তায় চলতে আমরা ভয় পাই। আঘাত লাগার ভয়। কিন্তু এটাও তো সত্যি , এই পথ আমাদের শিক্ষাও দেয় । জীবনের চলার পথ আলোকিত মশৃণ নয়। অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে চলতে চলতে আলোর দিশা পেতে হয়। তাইনা?
রাস্তায় মাঝেমধ্যেই বড়ো বড়ো ভাঙা গর্ত। বৃষ্টির জলে টইটম্বুর। আকাশের ভাঙা চাঁদের প্রতিবিম্ব সেই জলে এসে পড়েছে। যেন এই মায়াময় নির্জনতায় ওদের দুজনকে দেখবে বলে , জলের নিচে ঘাপটি দিয়ে বসে আছে। তিরতির করে বহে যাওয়া ঠান্ডা হাওয়ায় সেই জল কেঁপে কেঁপে উঠছে , কাঁপছে প্রতিবিম্ব।
নীল, সেই কম্পমান চাঁদের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললো,,,, তোমার সাবজেক্ট যেন কী?
মানালি কপাল কুঁচকে বললো ,,, ফিলোসোফি ,, কেন ?
নীল হাসতে হাসতে বললো,,,, না,, এমনিই,,
মানালি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে , এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে , নীলের পিঠে চটাস করে একটা চাপড় মেরে বললো , ইয়ার্কি হচ্ছে না , অসভ্য ছেলে।
নীল এইবারে হো হো করে হেসে বললো ,,,,
মাফ করো , জুলজির মাথায় ফিলোসোফি ঢুকবে না। হা হা হা।
নীলের অমন প্রাণখোলা হাসি দেখে , মানালিও স্থির থাকতে পারলো না। সেই হাসিতে সেও যোগ দিলো। হা হা হা,,,,,,,
তাদের সেই সম্মিলিত নির্মল হাসি , প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো রাত সুন্দরী পাহাড়ের নিঝুম কোলে কোলে।
সুন্দরী সিকিম , নব যৌবনের উচ্ছ্বলতায় আরও সুন্দরী হয়ে উঠলো।
কিন্তু , লজে অপেক্ষারতা মাতা সুন্দরী কী করেন সেটাই এখন দেখার।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।