মার্গে অনন্য সম্মান সুমিতা চৌধুরী (সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

পাক্ষিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ২০
বিষয় – আলোর উৎসব দীপাবলি

আশার প্রদীপ

পুজো কেটে গেছে, তবু ছেলেমেয়ে দুটোকে নিজের রোজগারের টাকায় একটা কিচ্ছু কিনে দিতে পারেনি বিশু। পদ্ম লোকের বাড়িতে কাজ করে যে বোনাস পেয়েছিল, তা থেকেই ছেলে মেয়ে দুটোর একটা করে জামা হয়েছে কোনোরকম। তাই পরেই সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে ওরা মনের আনন্দে। দারিদ্র্যের মাঝে বড়ো হচ্ছে বলেই হয়তো খুব ছোটো বয়সেই অনেককিছু বুঝতে শিখে গেছে। তাই হয়তো তেমন দাবিদাওয়া নেই ওদের কোনোদিনই। ছোটোখাটো আবদার করে মাঝে সাঝে। কিন্তু তাও মেটানোর মতো সাধ্য হয় না বিশুদের বেশিরভাগই। বাচ্চাগুলোর মলিন মুখের সামনে তখন নিজেকে বড়ো ছোটো মনে হয়। এবারও ওদের তেমনই এক ছোট্ট আবদার পেশ করেছে তারা বাবার কাছে। একটু ফুলঝুরি রংমশাল এনে দিতে হবে দীপাবলিতে।
চড়তে থাকা বাজার দরে সংসারে হাঁড়ির হাল। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। শুধু পদ্মর অক্লান্ত পরিশ্রমে, তিন / চার বাড়ি কাজের দৌলতে সংসারটা চলছে টিমটিম করে। তার মধ্যেই বাচ্চাদুটোকে স্কুলেও ভর্তি করিয়েছে পদ্ম। সত্যিই তো, সেও তো চায় অন্তত সন্তানদের ভবিষ্যৎ যেন তাদের মতো নষ্ট না হয়। সে যখন কারখানায় কাজ করতো, এতোটা অভাব ছিল না। পদ্মকেও এতোগুলো বাড়িতে কাজ করতে হতো না। দুজনের কাজের শেষে একটু নিজেদের জন্য সময় ছিল, মনের কথা বলার, আমোদ-আহ্লাদের। কিন্তু তার এক্সিডেন্টের পর কাজটা চলে গেল আর যখম পা নিয়ে কোনো কাজও জোগাড় করতে পারল না সে। আর তাই এখন পদ্মর কখনোই সময় নেই, তাকে বাড়িতে পাওয়াই দুষ্কর। যতোটুকু সময় থাকে ,তাও রান্নাবান্না, ঘরের কাজেই কেটে যায়। একটু কাছে ডাকলেও বিরক্ত হয়ে মুখ ঝামটা দেয়। সে বোঝে সারাদিন অস্বাভাবিক পরিশ্রম করে সংসারের বোঝা বইতে বইতে পদ্ম এমন রুক্ষ শুষ্ক, রসকষহীন এক যন্ত্রমানবে পরিণত হয়েছে। তবু সে চেষ্টা করে পদ্মকে একটু সাহায্য করার, সংসারের জন্য কিছু করতে, একসময়ের তার শখকেই কাজে লাগিয়ে। কিন্তু মাটির জিনিসের চাহিদা এখন একদমই নেই। আর যাও বা আছে , সেসব ঐ ফোনেই আজকাল কেনাবেচা করে সবাই। আর নাহলে বড়ো বড়ো মল থেকে। তাদের মতো পথের ধারের খুচরো বিক্রেতার থেকে এখন আর কেউই তেমন কিছু কেনে না। তবু যদি কেউ কেনে তাই মন ঢেলে অনেক প্রদীপ বানিয়েছে সে মাটির সুন্দর সুন্দর। সারাবছর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে একঘেয়ে মাটির ভাঁড়ই বানাতে হয়, সংসারের সুরাহার জন্য। এই পুজোর সময়টা সে মন ঢেলে দিয়েছে, তার শিল্পকলার প্রমাণ স্বরূপ। কিন্তু তাতেও বিক্রি খুব সামান্যই হয়েছে। তবু আজও সে ফের চলেছে মনে আশা জিইয়ে রেখে, যদি কিছু বিক্রি হয়। একমাত্র আশাই যে সম্বল তার। বেশ কিছু প্রদীপে সুন্দর রংও করেছে। বেরোতে যাবে এমন সময় দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটা তার পড়ার দিদিণণিকে নিয়ে হাজির। বিশু একটু অস্বস্তিতে পড়ে বলে, ” এখন ওর মা বাড়িতে নেই। আমি বলে দেবো, আজ আপনার সাথে ঠিক একবার দেখা করে নেবে।” অর্পিতা( মেয়ের দিদিমণি), ” আমি আপনার কাছেই এসেছি। (ব্যাগ থেকে দুটো মাটির প্রদীপ বের করে) এগুলো আপনি বানিয়েছেন তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। মিলি আমাকে দিয়েছে এইদুটো। তাই আমি এসেছি, আপনার থেকে প্রদীপ কিনতে। এতো সুন্দর প্রদীপ আমি সত্যিই খুব কম দেখেছি। আপনার সব প্রদীপই আমার চাই। আমি পুরো বাড়ি সাজাবো এবার দীপাবলিতে আপনার এই সুন্দর সুন্দর প্রদীপ দিয়ে।” বিশু মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতোক্ষণ অর্পিতার কথাগুলো শুনছিল ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিল না। অর্পিতা, ” কি হলো দেখান প্রদীপগুলো আমায়।” সম্পূর্ণ অগোছালো অবস্থা থেকে নিজেকে কিছুটা সামলে তাড়াতাড়ি প্রদীপের ঝুড়িটা অর্পিতার সামনে রাখলো বিশু। অর্পিতা প্রদীপগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলে চলল, ” অসাধারণ হাতের কাজ আপনার। মিলি আমায় সব বলেছে। এটা আপনার একসময়ের শখ ছিল। এক্সিডেন্টের পর কারখানার কাজ চলে যাওয়ার পর, এটাকেই সম্বল করেছেন আপনি। আসলে আমার এই ধরনের হাতের কাজ ভীষণ ভালো লাগে। তাই মিলি আমায় প্রদীপ দুটো দেওয়ায় একরকম আমিই মিলিকে আপনার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করায় মিলি সবটা বলেছে, নিজে থেকে নয়। তাই ওকে ভুল বুঝবেন না। তবে একটা কথা বলি, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আপনার এতো সুন্দর শিল্পকলার কদর নষ্ট হতে দিতে চাই না আমি, আপনার ছোট্ট মিলিও না। আমি ওকে বললাম এখন ফোনের মাধ্যমে আপনি এগুলো বিক্রি করতে পারবেন আর খুব ভালো দামও পাবেন, শিল্পের কদরও পাবেন, তাই মিলি আমায় নিয়ে এসেছে। যাতে আপনাকে সবটা বুঝিয়ে শিখিয়ে দিয়ে যেতে পারি। আমার একটা পুরোনো মোবাইল এখন আমি আপনাকে দিচ্ছি, পরে আপনি রোজগার করে নতুন ফোন কিনলে নয় এটা ফেরৎ দিয়ে দেবেন।” অর্পিতা এরপর সেই ফোন থেকে বিশুর নামে একাউন্ট খুলে সব দেখিয়ে শুনিয়ে দিয়ে, তার প্রদীপের বেশ কিছু ছবি তুলে, নতুন ব্যবসা জগতের প্রবেশ দ্বার খুলে দিয়ে, কোনো দরকারে সে সাহায্য করবে এই আশ্বাস দিয়ে ফিরে গেল, তার এ পর্যন্ত তৈরী সব প্রদীপ নিয়ে সত্যি সত্যিই। এটাও বলে গেল সে যেন তার এই সুন্দর শিল্পকলাকে কোনোভাবেই নষ্ট না হতে দেয়। তার আর মাটির ভাঁড় তৈরী করে জীবিকা নির্বাহের দরকার নেই। তার শিল্পী মন নিয়ে নানারকম মাটির সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরী করে যেন ফোনের মাধ্যমে লোকের কাছে ছড়িয়ে দেয়, তাহলেই দেখতে দেখতে ব্যবসাও জমে উঠবে আর শিল্পের কদরও পাবে সে।
অনেকগুলো টাকা পেয়েছে সব প্রদীপের বিনিময়ে বিশু অর্পিতার থেকে। কিছুটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যেই সে ছুটে চলে গেল ছেলে মেয়ে দুটোর আবদার মেটাতে আর নিজের কাজের জন্য কিছু রং তুলি এসব কিনতে। একমুখ হাসি নিয়ে ফিরে এসে ছেলে মেয়েদের কাছে ডেকে তাদের হাতে বাজি ধরিয়ে দিল। ভীষণ খুশী ওরা। মেয়ে বলল, ” বাবা, দেখো, তোমার থেকে কতোজন কিনতে চেয়েছে, দাম জিজ্ঞেস করেছে। বলো, কি লিখবো। তোমার তো একটাও প্রদীপ নেই এখন আর, তাড়াতাড়ি বানাও আবার, নাহলে দেবে কি করে সবাইকে?” বিশু অর্পিতার বলে যাওয়া দামটা মিলিকে লিখতে বলে দিয়ে সোৎসাহে কাজে বসে গেল। তাকে যে বেচার জন্য প্রদীপ ছাড়াও পদ্মর জন্যও প্রদীপ বানাতে হবে দীপাবলির উপহার স্বরূপ। এবার দীপাবলিতে তাদের নিজেদের বাড়িও সে তার প্রদীপ দিয়ে সাজাবে। এতোদিন পর সত্যিই দীপাবলি এসেছে যে তাদের দ্বারে। সংসারের নিভে যাওয়া প্রদীপগুলো আস্তে আস্তে ফের জ্বালাতে হবে। পদ্মকে একটু দম ফেলার ফুরসত দিতে হবে, ছেলেমেয়েদের ছোটো ছোটো আবদার মেটাতে হবে, সর্বোপরি বাবা আর স্বামী হয়ে উঠতে হবে প্রকৃতপক্ষে, সংসারের দায়িত্ব পালন করতে। ঠিক তেমনই, যেমন আজ বহুদিন পর জ্বলে উঠেছে তার জীবনের প্রায় নিভে যাওয়া আশার প্রদীপটা তার ছোট্ট মেয়ে মিলির সাহায্যে আর অবশ্যই তার এতো বড়ো মনের দিদিমণির সাহচর্যে। কাজ করতে করতেই সামনে বসা মিলিকে সে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল,” তোর মা এলে বলবো, এবার দীপাবলিতে লক্ষ্মী পূজো করতে। তুই যে এবার সত্যিই লক্ষ্মী হয়ে, লক্ষ্মী নিয়ে এলি আমাদের ঘরে।” মিলি, ” বাবা, মা রাগ করলেও তুমি তোমার হাতের কাজ ছাড়োনি, আর আজ সেটাই কাজে দিল বলো? মা আজ খুব খুশী হবে কিন্তু দেখো।” বিশু,” হ্যাঁরে মা। হাজার দুর্দিনেও আশাকে কখনো ছাড়তে নেই, মনে জাগিয়ে রাখতে হয়। আমিও ছাড়িনি, তাই তো আজ সেই আশার প্রদীপই ঠিক জ্বলে উঠলো দীপাবলি হয়ে।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।