সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৮)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

বিন্দু ডট কম

মাটির কোল ঘেঁষে ছটফট করছে একদল প্রজাপতি ।তাদের ওড়ার মধ্যে গতি নেই তেমন।তবু ডানা ঝটফটানিতে তাদের মধ্যে অসম্ভব অস্থিরতা গোপন থাকে না।একটা কাওয়াগোড়া ঝোপের কাছে ওদের এই মুক্ত বিচরণে হন্যে শিকারীর মতো অখিলেশ প্রজাপতি ধরবার চেষ্টা করছে।এই ধরে এই পালিয়ে যায়। ফের ধরতে যায়।
তরুলতাদের রিসর্টটা লোদাশুলি জঙ্গলের একদম ভিতরদিকে।দোতলা কটেজে উঠতে হয় কাঠের সিঁড়ি দিয়ে।মাটির থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই কটেজগুলো উঠিয়ে তৈরি করা হয়েছে।এই অঞ্চলে বন্যহাতি চলে আসে যখনতখন।এছাড়া বুনো শুকর তো আছেই।সেই কারণেই এই ব্যবস্থা। বেশ দশ পনেরো বিঘাজুড়ে এই রিসর্ট।অখিলেশের এক পুরনো ক্লায়েন্ট এই রিসর্টের মালিক।তাঁর সুপারিশেই হঠাৎ বুকিং পাওয়া সহজ হলো।এখানে প্রতিটি কটেজের নাম দেওয়া হয়েছে আলাদা করে।তরুলতাদের কটেজটার নাম “ডুলুঙ”।ছোট একটা বারান্দা ছাড়া একটা বেশ বড়সড় ডাবলবেডরুম।সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ।অখিলেশ বলছিল আলাদা দুটো ঘর নেবে।তরুলতাই বারণ করল।মনকে ছলনা করে মিথ্যা লৌকিকতা করতে চায় না সে।আর এতো বড় পৃথিবীতে দুটো ছোট ডানা মেলা প্রজাপতি একটা ফুলের পাপড়ির আড়াল পাবে না কিছুতেই?তরুলতা জানে তার কটেজের নাম একটা নদীর নামে।সেই নদী বেলপাহাড়ির দিকে।আজ অখিলেশ সকালে চেকইন করার সময় বলেছে তাকে নিয়ে যাবে।কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দেখছিল তার দিকে পিঠ করে অখিলেশবাবু কেমন প্রজাপতি ধরছেন।দেখতে দেখতে মনেমনে হেসে ফেলে সে।আজ তার শরীরে যন্ত্রণাটা নেই তেমন।যেন প্রকৃতির স্পর্শে নতুন জীবনীশক্তি ধারণ করেছে তার শরীর।কোনও রকমে চেক ইন সেড়ে ফেলেই প্রজাপতি ধরতে থাকা মানুষটা শেষমেশ তার জালে একটা ময়লা ফিকে আকাশি প্রজাপতি বন্দি করতে পারে।দলছুট প্রজাপতিটা জালের মধ্যে আপ্রাণ ডানা ঝাপটাচ্ছে।নিজের এই সাফল্যে খুশি হয়ে অখিলেশ ‘ইয়েস ইয়েস’ বলে ওঠে।হাততালি দিয়ে ওঠে তরুলতাও।জালবন্দি প্রজাপতি নিয়ে সম্রাটের মতো উঠে আসে অখিলেশ।
-বলো দেখি এই প্রজাপতিটা স্ত্রী না পুরুষ?
-স্ত্রী।
-একদম ঠিক।কী করে বুঝলে?তুমিও কী পিয়েরিডি নিয়ে গবেষণা করেছ নাকি?
-পিয়েরিডি?সেটা কি?
-প্রজাপতির একটা গোত্র।এই প্রজাপতির বাংলা নাম তল্লার।এটা আকাশি ওয়ান্ডারার।কিন্তু তুমি জানলে কী করে এটা স্ত্রী?
-কেন?ঠিক বলিনি।
-বলেছোই তো।কিন্তু ভাবছি কীভাবে!
-খুব সহজ।যবে থেকে তোমার ঈশ্বর এই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি করলেন,তবে থেকেই জালে আবদ্ধ হয়ে তিলতিল করে মরবার বিধিলিখন কেবল তিনি স্ত্রীদের কপালেই লিখে গেছেন।
-জানো।এই প্রজাপতিদের এক অদ্ভুত স্বভাব আছে।এরা একটিই মাত্র বাধা পথে যাতায়াত করে চলে।বিশেষত পুরুষেরা।অবসেসড থাকে বোধহয়। কাকে খোঁজে যেন সবসময়!কাকে খোঁজে?
-আমি জানি কাকে খোঁজে।
-কাকে?
-পাতার আশ্রয় খোঁজে।সেই আশ্রয়ে লুকিয়ে থাকে তাদের প্রেয়সীরা।
-তুমি পেলে?
-কী?
-পাতার আশ্রয়?
-পেয়েছি।
টেবিলে জালবন্দি প্রজাপতি রেখে অখিলেশ আর তরুলতা ঘরে ঢুকে দরজা টেনে দেয় অগোছালোভাবে।জালবন্দি প্রজাপতি ততক্ষণে তার শক্তি ফুরিয়ে ফেলে স্তব্ধ হয়ে যায়।
ডুলুঙ নদীর তীরে মৃদু জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে।তরুলতা অস্ফুট প্রজাপতির মতো ডানা মেলে দেয়।আর জাল নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে অখিলেশ।ধীরে ধীরে সে কাওয়াগোড়ার ঝোপের দিকে অগ্রসর হয়।ডুলুঙ নদী কেঁপে ওঠে শিহরণে।অখিলেশের ঠোঁটের কোণায় সামান্য রক্ত লেগে।অখিলেশ রক্তপায়ী শ্বাপদের মতো এবার উঠে আসে তরুলতার বুকের ওপর।তারপর আবার ডুলুঙ নদী দুলে ওঠে।একবার বারবার। চোখ বন্ধ করে তরুলতা দেখতে পায় একটা ছোট্ট গলিপথ।তার একপাশে বসে আছে যে মানুষটা তাকে সে খানিকটা চেনে।খানিকটা চেনে না।চাঁদিপুরের কথা মনে পড়ে তরুলতার।সেদিনও তার শরীর রক্তাক্ত ছিল।শুভব্রত তাকে জোর করেনি সেদিন।তরুলতা সেদিন হতাশ হয়নি।মনের ভিতর একটা বিস্ময় তৈরি হয়েছিল।আজ সেই বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে অখিলেশ।যেন ছেনি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দিচ্ছে সেই চাঁদিপুরের ঢেউগুলো।তরুলতা ভাসছে।ভাসতে ভাসতে তার ডানাদুটোও অবসন্ন হয়ে পড়ছে ক্রমশ।

খানিকটা বেলা করে লাঞ্চ সারলো দুজনে।এখান থেকে ডুলুঙ নদী কাছেই।তার এক কোলে কনকদুর্গার জাগ্রত মন্দির।অন্য কোলে প্রাচীন চিলকিগড় দুর্গ।শরীরে সামান্য ব্যথা আছে তরুলতার।কিন্তু সে ব্যথা অপরাধবোধের ব্যথা নয়।এই ব্যথা প্রকৃতির।সে তো আসলে ডুলুঙের মতোই একটি ক্ষরস্রোতা নদী।অখিলেশ সেই নদীতে আজ রক্তস্নান সেরেছে।কিন্তু এই শোনিতে হিংসা নেই।আছে প্রেম।আছে বিপ্রলব্ধ।

কনকদুর্গার মন্দিরে বেশ ভিড় হয়েছে আজ।এদিকে তরুলতা মুখোশ আনতে ভুলে গেছে।জীবনের প্রতি পদে মুখোশ পরার সভ্যতাকে মনে মনে ঘৃণা করে সে।কিন্তু অতিমারী কী তা মানবে?ভাগ্গিস অখিলেশের গাড়িতে একস্ট্রা মাস্ক ছিল।মন্দিরের দিকে যেতে গেলে সামান্য বনপথ।সেই পথে নিজের অজান্তেই অখিলেশের হাত ধরে ফেলল তরুলতা।
-থ্যাঙ্কস।
-কেন?কীসের জন্য?
-মাস্কের জন্য।বুদ্ধু।লেপিডপটেরিস্ট আমার।
-তোমাকেও থ্যাঙ্কস।
-কীসের জন্য?আমি তো ভেস্তে দিলাম সব।ওই বিছানার চাদর বালিশ।সব লালে লাল।আচ্ছা।ওই রিসর্টের লোকগুলো কী ভাববে?
-কী আবার ভাববে?ভাববে ডুলুঙ নদীতে চান করে গেছে দুজন।চোখের জলে নয়।শরীরের জলে।
তরুলতা মুখ ঢাকে লজ্জায়।সে জানে অখিলেশের জানাশোনা ওই রিসর্ট।কিন্তু হঠাৎ তার মধ্যে সংশয় দেখা দেয়। এই পাশের মানুষটা।কতোটুকু চেনে সে ওকে।একটা অধিকার বোধ চেপে বসে তার বুকের ওপর।বাম দিকের পাঁজরে অখিলেশের কামড় দেওয়া কালশিটে টনটন করে ওঠে।অখিলেশও কি তার মতো বিবাহিত?তার পরিবার নেই?থাকলে তো সেও একদিন চলে যাবে তাকে ছেড়ে!শুভব্রত,তুমি দেখতে পারছো?এটাই তো চেয়েছিলে তুমি।তুমি উড়তে চেয়েছিলে।আকাশপথে উড়ে যেতে চেয়েছিলে তোমার দোয়াবভূমিতে।
-কী ভাবছো?
-কিছু না।
-বলো?
-ভাবছি তোমার পরিবারের কথা।সকলের প্রজাপতির ঝাঁক আছে।তোমার নেই?
-আছে তো।
-তাহলে?
-বলবো সব।সময় দাও।
মন্দিরে ঘন্টা বেজে ওঠে।পুরোহিত দুজনকে লাল টিকা পরিয়ে দেয়। তরুলতা দেখে তার হলুদ শাড়ির আঁচলে সেই লাল টিপের এক বিন্দু রক্তের ফোঁটার মতো লেগে রয়েছে।
রাস্তাটা চাতালের মতো নেমে ছুঁয়ে যাচ্ছে ডুলুঙ নদী।টলটল জল।ঠিক তরুলতার শরীরের মতো।সেখানে কাপড় থোবা করে কেচে নিচ্ছে এক বাগদি।নদী ছেড়ে তরুলতারা চিলকিগড়ের দিকে এগিয়ে গেল।শতাব্দীপ্রাচীন সদরফটক পেরিয়ে ভগ্নপ্রাসাদ।একপাশে একাকী শিবমন্দির। খানিক দূরে রাশমঞ্চ।মানুষ নেই।কোথাও কোনও মানুষ নেই।
-বলো অখিলেশ।
-কী বলবো?
-তোমার কথা বলো?
-তোমারটুকুও তো জানতে চাই আমি।
-সে হবে তো।সব বলবো।আগে তোমার কথা হোক।
-সুচরিতার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি আট বছর।অবশ্য মিল কখনোই ছিল না আমাদের।সমাজ জোর করে বেঁধে রেখেছিল।
-কেন ছেড়ে দিলে?
-ওকে শেষের দিকে আমার খাতার প্রজাপতিগুলোর মতো লাগছিল।তাই ওকে মুক্তি দিলাম।জানো।একটা ছোট্ট ছেলে আছে আমার জানো।ভারি মিষ্টি।নাম তীর্থ।
-তাই?
-হ্যাঁ। ফাইভে পড়ে কলকাতায়।মায়ের কাছেই থাকে।আমি শুধু টাকা পাঠাই।
-কথা বলো না?
-বলি।মাঝেমাঝে
ওর মায়ের অনুমতি পেলে তবে।আসলে আমার উপরের আক্রোশটা ওর মা আমার ছেলের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে ট্যাগ করে একধরনের প্রতিহিংসার আনন্দ পায়।
-থাক।
-কী?
-আর বলো না।তুমি কাঁদছো।
-তুমি তো শুনতে চাইলে।
-নাহ।আর চাইনা।ভালোবাসবে?
-বাসবো তো।
-বাসো।এক্ষুণি।
-এখানে!
-সন্ধ্যা নিভুনিভু।এই গড় আমার পছন্দ হয়েছে।এখানে কেউ আসে না।এখানে শুধু ছায়া আর ছায়া।আমাকে ভালোবাসা দাও অখিলেশ।এসো রক্তাক্ত করি তোমাকে।তোমার ঘেন্না করবে না তো।
-না।ভালো লাগবে।রক্তাক্ত হতে।আমার রক্ত ভালো লাগে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।