কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুজিত চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ৮)

নীলচে সুখ 

এখন রাত আটটা। ছোট্ট এই প্রায় জনমানবহীন পাহাড়ি গ্রামে মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতা। মিসেস রায় একা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়ের আকুল প্রতিক্ষায় ।
ছেলে গুলো কে জোর করেই পাঠিয়েছেন একটু এগিয়ে গিয়ে , যদি ওদের কোনও হদিস করা যায়, এই আশায়। একেই বলে উদ্বেগ। স্বাভাবিক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেরা ফিরে এলো। ওদের দেখা পায়নি। তবে অন্য খবর এনেছে । রাস্তা পরিস্কারের কাজ চলছে। আন্দাজ মতো কাল সকল নটার পরেই রাস্তা চালু হয়ে যাবে। যদি না আবারও নতুন করে ধ্বস নামে।
মিসেস রায় কথা গুলো শুনলেন বটে , কিন্তু বিশেষ উৎসাহ পেলেন বলে মনে হলো না।
শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে গেলেন।
প্রফেসর চোখ বুঁজে শুয়ে একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করছিলেন। মিসেস রায়ের কথায় , সে চেষ্টায় জল ঢেলে উঠে বসলেন। চাপা গলায় বললেন,,,
আরে,, এতো মহা মুশকিল। আমি কী করলাম ?
মিসেস রায়ও একইভাবে বললেন ,,,,,
তুমিই তো ওদের জোটালে । গায়ে পড়ে।
_ কেন? তুমিও সামনেই ছিলে। তুমি ওদের অফার , আই মিন প্রপোজাল , দাওনি ?
তাছাড়া এসব কথা উঠছে কেন ? কোথায় কী রামায়ণ মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে ?
_ তুমি চুপচাপ ঘরে বসে আছো কেমন করে ? এতখানি রাত হলো , এই ভয়ঙ্কর জায়গায় মেয়েটা একটা সামান্য পরিচিত ছেলের সঙ্গে ,,, ওফ্ফ,,,, কী কুক্ষণে এখানে এসেছিলাম। আসা থেকে দুর্ভোগ পিছু নিয়েছে। যাক, তুমি একবার বাইরে বেরিয়ে দেখবে , নাকি আমিই যাবো ?
_ কেন ? ওরা গেলো তো,,,
_ ওরা ফিরে এসেছে । দেখা পায়নি । রাস্তা সারাইয়ের খবর এনেছে।
_ তাইনাকি , বেশ ভালো। সারাইয়ের কাজ কী হয়ে গেছে ?
_ তোমার যাবতীয় মুখোরোচক প্রশ্নের পছন্দের উত্তর পাশের ঘরে গেলেই পেয়ে যাবে। যাও পাশের ঘরে যাও। জমিয়ে বসে সবকিছু ঠিকঠাক জেনে এসো, যাও।
_ তুমি এভাবে কথা বলছ কেন ? একটা কথা ব’লে রাখছি শোনো , আমি দীর্ঘদিন যাবৎ এইরকম তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে শিক্ষকতা করে কাটিয়েছি । আমি চিনতে ভুল করিনা। তুমি যা কল্পনা করছ , তা একেবারেই ভুল। নতুন জায়গায় একটু ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে।বেড়াতেই তো এসেছে। ঘরে শুয়ে বসে থাকার জন্য তো আসেনি। এটাই স্বাভাবিক। আমার সেই বয়স থাকলে, আমিও এইরকম গ্যাঁট হয়ে ঘরে বসে অকারণ বকবক করে সময় নষ্ট করতাম না। সে অভিঙ্গতা তোমার যথেষ্টই আছে।
মিসেস রায় বুঝলেন , এইভাবে বলা তার উচিৎ হয়নি। মানুষটা মনে মনে দুঃখ পেয়েছেন।
পায়ে পায়ে খোলা জনলার ধারে এসে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে বেশি দূর দেখা যায় না। মনের মধ্যেও একরাশ দুশ্চিন্তার অন্ধকার। মায়ের মন , সন্তানের জন্য ব্যাকুল হবেই। অনিচ্ছা সত্বেও দু’একটা অবান্তর অপ্রিয় কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবেই। উচাটন বাগ মানেনা।
প্রফেসর , আরচোখে মিসেস রায়ের দিকে তাকিয়ে , পায়ে চটিটা গলিয়ে , বাইরে বেরুতে যাবেন , ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে একটা সমবেত কোলাহল ভেসে এলো।
,,,,,, এই এসে গেছে । কোথায় গিয়েছিলি এতক্ষণ ? বলে যাবি তো।
মানালি তুমি মায়ের কাছে যাও। উনি তোমার জন্য খুবই চিন্তা করছিলেন। যাও।
প্রসেসর বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। মানালি বাবার পাশ দিয়ে ঘরে চলে গেল। মিসেস রায় , তখনও একইভাবে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মানালি কাছে গেল না। সামান্য দূর থেকে আদুরে গলায়বললো,,,, মা,, তুমি রাগ করেছ ?
মা তখনও একটুও নড়লেন না। শুধু নির্বাক নিশ্চলভাবে এক আশ্চর্য রকম চোখে মানালির দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
সেই দৃষ্টিতে রাগ, স্নেহ , অভিমান আর স্বস্তির নিবিড় বন্ধন ছিল একাকার হয়ে। ছলছল চোখে বললেন ,,,, মানালি , এমন করিস কেন বলতো , কী পাস, আমাকে এমন করে কষ্ট দিয়ে।
মানালি ছুট্টে গিয়ে মাকে জাপটে ধরে বললো,,,
আর কখনও হবে না মা। প্লিজ,,, কথা শেষ হলো না, গলা বুঁজে এলো ।
বোধকরি এটুকুই যথেষ্ট ছিল। মমতার কাছে নত হওয়াই জগতের নিয়ম।
মা তার সন্তান কে সজোরে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে , অশ্রুসজল চোখে বললেন ,,,,
আমি যে বড়ো ভয় পাই মানালি, আমি যে বড্ড ভীতু। মানালি মা’য়ের বুকে মাথা রেখে বললো ,,, মা,, আমার ওপর তোমার বিশ্বাস নেই ! বিশ্বাস নেই মা ?
মা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেননা। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বুকের মাঝে জমে থাকা পাথর গুলো যেন বুলডোজার দিয়ে ধাক্কা মেরে কেউ সরিয়ে দিলো, আর সেই সরে যাওয়া পাথরের ফাঁক গলে পবিত্র ঝর্ণার ধারা কুলকুল শব্দে নদীর পানে ছুটে গেল।
মায়ের অশ্রু ভেজা গাল নেমে এলো , মেয়ের মাথায়। মানালির ডাগর দুটি চোখেও টলমল করছে জল।
পাইন গাছের পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টির জল, তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে ঝরছে ভিজে পাহাড়ের গায়ে , টপটপ , টপটপ ।
পাশের ঘরে ব্রজেশ ভরাট উদাত্ত গলায় গান ধরেছে,,,,
এ তুমি কেমন তুমি
চোখের তারায় আয়না ধরো ।
এ কেমন কান্না তুমি
আমায় যখন আদর করো,,,,,
পরদিন সবাই খুব সকালে উঠে পরেছে। ড্রাইভারের সঙ্গী এসে জানিয়ে গেছে । রাস্তা খুলে গেছে। ব্রেকফাস্ট করেই রওনা দেওয়া হবে , লাচুন লাচেন এর পথে।
নীল আর তার বন্ধুরা , একটু আগেই সেই ধ্বসের জায়গা দেখে এসেছে। প্রফেসর ওদের সঙ্গে লজের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে , খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের কাছে ধ্বসের খুঁটিনাটি বিবরণ জানছেন।
এতক্ষণে জানা গেল , এই জায়গার নাম মানগাং। মনে রাখবার মতো জায়গা।
মানালি আর মিসেস রায়ও রাস্তায় নেমে এলেন। এখন সবাই যাবার জন্য তৈরি। গাড়িটা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ মানালি তার মাকে শিশুসুলভ সরলতায় বললো ,,, মা,, একবার হাঁ করো ।
মিসেস রায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললেন ,,,, কেন ।
_ আহঃ, যা বলছি করো না। হাঁ করো।
মিসেস রায় খানিকটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে মেয়ের আদেশ পালন করতে , হাঁ করলেন।
মানালি সেই হাঁয়ের মধ্যে একটা কিশমিশ টুক করে ফেলে দিলো।
মিসেস রায় সেটাকে বারদুই চিবিয়ে নিয়ে , অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন ,, কী এটা ?
মানালি , রুমালে বাঁধা গতরাতের দুর্গামাঈ এর প্রসাদ , মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো ,
পাহাড় পার্বতীর প্রসাদ। সবাইকে দাও। বাবাকেও।
মিসেস রায় তেমন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। তবুও রুমাল শুদ্ধ প্রসাদ কপালে ঠেকিয়ে নিয়ে , ছেলেদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
তন্ময় বললো ,,,,,, কাকীমা , কালরাতে ওরা তো ওই মন্দিরেই গিয়েছিল। তারই প্রসাদ।
প্রফেসর হেসে বললেন ,,, বাব্বা, এই পাহাড়ি জঙ্গলে মন্দিরও খুঁজে বের করে ফেললি তোরা।এ তো দস্তুরমত একটা আবিষ্কার বলা যেতেই পারে। নাঃ, মানতেই হচ্ছে , তোদের ক্যালি আছে।
মিসেস রায় , প্রফেসরের মুখে একটা কিশমিশ দিয়ে দিলেন । প্রফেসর , মুখে প্রসাদ নিয়ে , বালককের মতো মুঠো বদ্ধ হাত আকাশ পানে ছুঁড়ে চিৎকার করে বললেন,,,, দুর্গামাঈ কী জয়।
সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো।
মানালি আর নীল দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে , সেই হাসিতে যোগ দিয়ে , প্রফেসর কে নকল করে চিৎকার করে বললো,,, দুর্গামাঈ কী জয়।
ড্রাইভার বললো , সবাই গাড়িতে বসুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সবাই গাড়িতে বসতেই , চলতে শুরু করলো গাড়ি। জানালা দিয়ে সবাই শেষ বারের মতো , প্রাণ ভরে দেখছিল , অখ্যাত আশ্চর্য সুন্দরী মানগাং কে।
বিদায় রুপসী মানগাং। একটি মাত্র রাত। তাও অযাচিত আকস্মিক ঘটনায় অসহায় ভাবে তোমার ছোট্ট কোলে আশ্রয় নেওয়া। তোমার কাছে যা পেলাম , সারাজীবন মনের মনিকোঠায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে।
গাড়ি মাত্র মিনিট পনেরো গড়িয়েছে । তখনই ঘটে গেল একেবারে ভয়াবহ ঘটনা। যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। থাকার কথাও নয়। ক্রমশ,,,,,,
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।