সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী (পর্ব – ৪)

জন্ম কলকাতায়(২৭ নভেম্বর ১৯৮০)।কিন্তু তার কলকাতায় বসবাস প্রায় নেই।কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়ান গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।সেখান থেকেই হয়তো ইন্ধন পেয়ে বেড়ে ওঠে তার লেখালিখির জগত।প্রথম কাব্যগ্রন্থ "আকাশপালক "(পাঠক)।এর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো শিকারতত্ত্ব(আদম), আড়বাঁশির ডাক(দাঁড়াবার জায়গা), জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার(পাঠক), কানাই নাটশালা(পাঠক),বহিরাগত(আকাশ) ।কবিতাথেরাপি নিয়ে কাজ করে চলেছেন।এই বিষয়ে তার নিজস্ব প্রবন্ধসংকলন "ষষ্ঠাংশবৃত্তি"(আদম)।কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্য ও গল্প লিখতে ভালোবাসেন।প্রথম উপন্যাস "কাকতাড়ুয়া"।আশুদা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশিত "নৈর্ব্যক্তিক"(অভিযান)।'মরণকূপ' গোয়েন্দা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় অভিযান,যদিও তার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুতে সে একেবারেই স্বতন্ত্র।এই সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস 'সাহেববাঁধ রহস্য '(চিন্তা)।সম্পাদিত পত্রিকা "শামিয়ানা "। নেশা মনোরোগ গবেষণা,সঙ্গীত,অঙ্কন ও ভ্রমণ ।

চার

আজ ব্যাঙ্কে কাজের চাপ ছিল অনেক।অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট মিলছিল না।এদিকে নভেম্বরের মাঝামাঝি।বেলদায় যেখানে তরুলতাদের ব্যাঙ্কটা,তার থেকে তার ভাড়া নেওয়া বাড়িটার দূরত্ব কিলোমিটার চারেক।দূরত্ব খুব সাঙ্ঘাতিক বেশি না হলেও পুরো রাস্তাটাই মরামের।অনেক কষ্ট করেও ব্যাঙ্কের আশপাশে কোনও মাথা গোঁজবার ঠিকানা পায়নি সে।অবশ্য তার এই চেষ্টায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তরুলতার ব্রাঞ্চেরই সিনিয়র ম্যানেজার অখিলেশ চৌধুরী।অখিলেশবাবু ব্যাঙ্কের পাশেই থাকেন।বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই। বিয়ে করেননি।একলাই থাকেন।ব্যাঙ্কের অন্যান্য কর্মীদের প্রতিও সবসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।শেষমেশ এখন যেখানে তরুলতা থাকে,সেই ঘরটিও তারই খুঁজে দেওয়া। ঘরটি এমনিতে খুব খোলামেলা।রাণাঘাটে এমন বাড়িতে সে থাকতে অভ্যস্ত ছিল না।বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা খোলা জমি।তারপর বারান্দা।সদর দরজা পেরিয়ে পর পর তিনটি ঘর।বাথরুম ও রান্নাঘর।বাড়িটা চারিদিক দিয়ে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।পাশের প্লটটাতেই বাড়িওলা থাকেন।তিনি স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের হেডমাস্টার।সস্ত্রীক দুটো মেয়ে নিয়ে থাকেন।তাই নিরাপত্তাহীনতারও অসুবিধে নেই।এই মানুষটি আবার অখিলেশবাবুর সহপাঠী। মেদিনীপুরের কলেজে এক ব্যাচ।তাই তার সুপারিশ থাকায় বেশ কম ভাড়াতেই ঘর পেয়ে গেছে তরুলতা।
আজ তরুলতার বাড়ি ফেরবার পথেও সেই অখিলেশ চৌধুরীই ভরসা।তরুলতা তার ঠিক পরের পোস্টেই জয়েন করেছে।স্তুপাকৃত ফাইলে অঙ্ক মেলাবার মরিয়া প্রচেষ্টা করতে থাকা মেয়েটাকে দেখে হয়তো অখিলেশবাবুর কষ্ট হলো।কিন্তু উপায় নেই।কাল সেন্ট্রাল অডিট।আর তরুলতা ক্যাসিয়ার।ব্যাঙ্কে ধীরে ধীরে দারোয়ান ছাড়া বাকি সকলেই চলে গেছে।অখিলেশবাবু তরুলতার কিউবিকলে গিয়ে দাঁড়ালেন।
-কীই।হিসেব মিললো?
-নাহ।একটা পঞ্চাশ হাজার টাকার ট্রানস্যাকশন কিছুতেই মেলাতে পারছি না।
-ফাইলগুলো ভালো করে দেখেছ?
-হ্যাঁ। কম্পিউটারেও দেখলাম।কোনও ডাটা নেই ওতে।
-কার নামে ট্রানস্যাকশন একটু দেখো তো।
-দেখছি।
তরুলতা আবার ফাইলের পাহাড়ে ঝুঁকে পড়ে।অখিলেশের কষ্ট হয়।আহা।কতোই বা বয়স মেয়েটার।স্বামী থেকেও না থাকার মতো।খোঁজও নেয় না।খবরও নেয় না।এইটুকু বয়সে তার ব্রাঞ্চের মাধবীলতা গাছটার মতো কাজের চাপে নুইয়ে পড়েছে তরুলতা।
-পেয়েছি।এই ট্রানস্যাকশন হয়েছে সমরজিত দলুইয়ের নামে।
-ওহ।বুঝলাম।দাঁড়াও।আমি একটা ওটিপি জেনারেট করছি।ওটা অনাযভাবে মেকআপ করতে হবে।
তরুলতা একটু হকচকিয়ে যায়।মাত্র দুমাস হলো সে এই ব্রাঞ্চে যোগ দিয়েছে।এখনও এখানকার সব চোরা গলিঘুঁজি তার অজানা।কিন্তু এই অখিলেশ স্যারের ওপর তার একধরনের সুপ্ত বিশ্বাস জন্মেছে।এই মানুষটা খাঁটি।কোনও দুনম্বরি কাজ এর পক্ষে করা সম্ভব নয়।
অখিলেশ চৌধুরী একটা ওটিপি পাঠিয়ে দিলেন তরুলতাকে।ওই লেনদেনটা বেনামে দেখিয়ে হিসেব মেলানো হলো।কিন্তু কেন?অখিলেশবাবু বোধহয় তরুর চোখের ভাষা পড়তে পারলেন।তাই গলা নামিয়ে বললেন,এখানে নয়।বাড়ি চলো।যাবার পথে সব বলবো।
-অন্ধকার নেবে গেল।কে জানে ট্রেকার পাবো কিনা।
-চিন্তা করো না তরুলতা।আমার গাড়ি আছে।আমি নিয়ে যাবো তোমায়।এখন গুছিয়ে ফেলো ফাইলগুলো।জব ডান।
ফাইল গোছাতে গোছাতে আবার অভিমান চেপে বসে তরুলতার বুকে।এতোগুলো দিন কেটে গেল।শুভব্রত একবারও একটা ফোন্ও করলো না তাকে।এই না মিলতে থাকা হিসেবের মতোই বেহিসেবি তাদের দুজনের দাম্পত্য।কোমায় আচ্ছন্ন।শুধু ডাক্তারবাবুর সীলমোহরের অপেক্ষায়। লোকটার জীবন খালি প্রেস আর ফর্মার গাঁথুনিতে আটকে গেছে।তরুলতা বুঝতে পারে।লোকটা ওই গাঁথুনি থেকে আর মুক্ত হতে পারবে না কিছুতেই।
দিনের আলো নিভুনিভু।ব্যাঙ্কের বাইরেই অখিলেশবাবুর সাদা সুইফট ডিজায়ার দাঁড়িয়ে আছে।এই গাড়ি অবশ্য তাঁর নিজের নয়।সম্ভবত তার এক ক্লায়েন্টের যিনি এখন বিদেশে থাকেন।যাবার আগে অখিলেশবাবুকে চালাবার জন্য গাড়িটা দিয়ে গেছেন।অবশ্য এসব কথা তরুলতা জানতে পারে ব্যাঙ্কের দারোয়ান করম সিং এর কাছ থেকে।জগতের খবর থাকে তার কাছে।বাড়ি বিহার।তরুলতার কাছে মাঝেমাঝে চা খাবার পয়সা নিয়ে যায়।সে দিয়ে দেয়,আপত্তি করে না।বিনিময়ে হয়তো কৃতজ্ঞতা জানাতেই জগতের সংবাদ সে না জানতে চাইলেও তার কাছে বলবেই করম সিং।
গাড়ি অখিলেশবাবু নিজেই চালান।শাড়ির আঁচলটা একরকম গুছিয়ে নিয়ে দারোয়ান করম সিংকে স্যালিউট জানিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই তরুলতা যা দেখলো তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।গাড়ির ঠিক পাশেই একটি বুনো লতানো ঝোপ।সেখানে লাল টুকটুকে ফল হয়ে রয়েছে।এই গাছ এর আগেও এই অঞ্চলে দেখেছে তরুলতা।কিন্তু তার নাম জানে না সে।সেই ফল ঘিরে এক ঝাঁক প্রজাপতি ঘুরপাক খাচ্ছে।তাদের ওপরের পিঠে এক সার বিন্দু নেমে এসেছে ডানার শেষ প্রান্ত অবধি।ডানা মেলে চঞ্চল প্রজাপতিগুলো ঘিরে ধরেছে ফলের গাছগুলিকে।মাথা উঁচু করে তারা ফলের মহাভোজে ব্যস্ত।তারই মাঝে বেলদা স্টেট ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অখিলেশ চৌধুরী ছেলেমানুষের মতো প্রজাপতি ধরবার চেষ্টা করছে।এই কাজে সে এতোটাই বিভোর যে কখন তার এই কীর্তির নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরই এক অনুজ অফিসার,এ সত্যি সম্পর্কে তিনি একেবারেই নির্বিকার।এই ঘটনা বেশ খানিক চলতে চলতেই একটি প্রজাপতি ধরা দিল তার হাতের মুঠোয়। এক ঝলক স্ফূর্তি ঝলকে উঠলো তার দুই চোখে।আর ঠিক তখনই সে দেখলো তরুলতা তাকে নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ করে চলেছে।স্ফূর্ত মুহূর্তে বদলে গেল অপ্রস্তুতভাবে।প্রজাপতিটা পকেটে থাকা একটি পাউচে ঢুকিয়ে ‘আই এম এক্সট্রিমলি সরি’ বলে অখিলেশ চৌধুরী গাড়িতে চালকের আসনে বসে পড়লেন।তরুলতাও বসে পড়লো তার পাশের সীটেই।কিন্তু তার চোখ থেকে কৌতূক তখনও মুছে যায়নি।
-আপনি প্রজাপতি ধরেন?
-ওহ।ও কিছু না।
-না না।বলুন না।আপনার মধ্যেও যে এমন একটা শিশু লুকিয়ে ছিল কে জানতো।
গাড়ি তরুলতার পিচ রাস্তা ছেড়ে তরুলতার বাড়ির দিকের মরামের রাস্তা ধরলো।ইতস্ততভাব অখিলেশকে তার চোখে চোখ রাখতে বাধা দিচ্ছে। পরিবেশটা খানিকটা সহজ করতেই তরুলতা বলল,’আপনার বুঝি প্রজাপতি ধরবার শখ?’
-বলতে পারেন।যে প্রজাপতিটা আজ ধরলাম তার নাম ভুশন্ডা।প্রচলিত জীববৈজ্ঞানিক নাম কমন ব্যারন।এই প্রজাপতির বিশেষত্ব কি জানেন?
তরুলতা জানে না কি বিশেষত্ব।তাই সে অবোধ বালিকার মতো অখিলেশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-এরা অনেকক্ষণ সময় ধরে একটি ডিম পাড়ে। অনেকটা মানুষের মতো।অন্য প্রজাতির প্রজাপতির মতো অন্তত এদের ডিমপাড়ার ক্ষেত্রে কোনও তাড়া থাকে না।
-বাহ।দারুণ তো।আচ্ছা। ওই লালরঙের ফল।যার পাশে ওরা গুরছিল।কী নাম ওই ফলটার?
-কাওয়াগোড়া।ঝাড়গ্রামের দিকে আরও বেশি পাওয়া যায়।বুনো ফল।মাঝেমধ্যে বেলদার পথঘাটেও একটু খুঁজলে এদের দেখা পাওয়া যাবে।যাবেন ঝাড়গ্রাম?বেলপাহাড়ি?
তরুলতা ঘাড় নাড়ে।গেলেই হয়।কাল পড়শু ছুটি।ভাবতে ভাবতেই তার ঘরের সামনে গাড়ি পৌছোলো।অখিলেশবাবুকে একপ্রকার ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ি থেকে নামতে গিয়েই হঠাৎ তরুলতা দেখলো তার আশপাশের পৃথিবীটা যেন টলে উঠছে।সন্ধ্যার অন্ধকার যেন রাতের মতোই গভীর।স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে অখিলেশবাবুকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই তরুলতা বুঝল পা নয়,তার চলমান অঙ্গ এখন ডানা।প্রজাপতির মতোই তার ডানা গজিয়েছে। এই মাত্র পিউপা থেকে বেরিয়ে এল সে।কিন্তু উড়তে গিয়ে মাথাটা আবার ঘুরে গেল তার।কালো ঘন কালো চারদিক।তরুলতা ধপ করে পড়ে গেল গেটের সামনে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।