গল্পে সৌরভ দেবদাস

ব্রেকআপ

অনির্বাণ আজ দশ বছর পর গ্রামের বাড়ি এলো, তার বিয়ে নাকি শহরে হয়েছিল। স্ত্রীর, তার গ্রামের বাড়িতে দুর্গা পুজোর দেখার খুব ইচ্ছের কারণে সে আজ গ্রামের বাড়িতে এসেছে।
দুপুরে খাবার পাঠ চুকিয়ে তার বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, দূরের বটগাছটা তার চোখে এসে পড়তে তার বুকের ভেতর শিহরণ জেগে উঠলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল ছোট্ট বেলার সমস্ত স্মৃতি। অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনের রাখা চেয়ারটি তে বসলো, সামনের রাস্তাটা দেখে মনে পড়লো এই রাস্তায় সে স্কুলে যেতো মেটে পথ ধরে। এখন ক্রমাগত পিচ রাস্তায় পরিনত হয়েছে। তার হঠাৎ সুবাস এর কথা মনে পড়লো, বছর খানেক হল কথা হয়নি, যতো দূর জানা যায় দুবছর আগে সে গ্রামের বাড়িতে সস্ত্রীক চলে এসেছে। এখন সে এখানে থাকে, সে ভাবলো নিজে যাবে সুবাস এর বাড়ি অনেক দিন হল কাকু, কাকিমার সাথে দেখা হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল অনির্বাণ পথে হেঁটে সুবাস এর বাড়িতে এলো, সুবাস তাকে চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরলো। তারা ঘরে গিয়ে বসলো, আর গল্প শুরু করলো দুই বন্ধু মিলে। সুবাস এর মা এলো, অনির্বাণ গিয়ে ওনাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। উনি হাসি মুখে বললো কেমন আছো বাবা। অনির্বাণ হাসি মুখে বললো ভালো আছি। তার পর সুবাস অনির্বাণ আগের মতোন আবার গল্প শুরু করলো।
হঠাৎ করে সুবাস জিজ্ঞেস করলো.. কিরে অনি বৌদি কে নিয়ে আসলে কি হতো।
অনির্বাণ.. আরে সুবি আর বলিস না সারা রাত্রি রাস্তায় ঘুম হয়নি তাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আছি তো কয়েক দিন নিয়ে আসব একদিন।
সুবাস.. না নিয়ে আসলে মার খাবি সালা! লুকিয়ে শহরে বিয়ে করলি টের পেলাম না।
অনির্বাণ.. তুই তো সবটাই জানিস। ছাড় ওসব, তোর কাজ কর্ম কেমন চলছে বল?
সুবাস.. হ্যা, ভালো চলেছে আর তোর চাকরি কেমন চলছে বল?
অনির্বাণ… হ্যাঁ চলছে মোটামুটি। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টে।
সুবাস.. তারপর, কেমন আছিস বল।
অনির্বাণ.. ভালো আছিরে, আর তোকে এখন তো ভালো দেখাচ্ছে তো।
সুবাস.. হো হো করে হেসে উঠল। কাল মন্দিরে যাবি তো?
অনির্বাণ.. দেখি ভাই, যাবো ফোন করে দিস তাহলে তোর বৌদি কে নিয়ে যাব।
সুবাস এর বউ দু’কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো, হাসি মুখে অনির্বাণ কে জিজ্ঞেস করলো ” কেমন আছ ঠাকুরপো।”
অনির্বাণ.. মুচকি হেসে উত্তর দিলো ভালো।
সুবাস এর বউ রান্না ঘরে চলে গেলো।
সুবাস.. চা খেতে খেতে বললো কিরে জুই এসেছে জানিস?
অনির্বাণ.. কি জানি। আমি জেনে আর কি করব, বলে কিছুটা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুবাস.. দেখ ভাই তোর তো এতে কোনো দোষ নেই তাই না বল, কারণ
জুই এর বাবা তো জুইয়ের বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক করে দিয়েছিল, জানিস তো জুই এর কোনো মত ছিল না তাকে বাড়ির লোকের জন্য বিয়ে করতে হয়েছে। তুই ভাল করে জানিস।
অনির্বাণ.. দেখ সুবি, দোষ আমারও ছিল তখন যদি চাকরি পেতাম আজ আমি জুইয়ের হতাম। আমিও জুই কে বেকারত্বর জন্য হারিয়েছি। (বলে চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে অনির্বাণ।)
সকালে সুবাসের ফোন আসে অনির্বাণের ফোনে,
সুবাস.. কিরে রেডি হয়েছিস?
অনির্বাণ.. হ্যাঁ, আমি রেডি। তোর বৌদি ও রেডি আছে আয় তাহলে আমার বাড়িতে একসাথে যাবো মন্দির।
সুবাস.. ঠিক আছে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাক আসছি মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে।
সুবাস এর কথা মত অনির্বাণ সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে থাকলো বাড়ির সামনে, সুবাস ও তার স্ত্রী এলো তাদের বাড়ির সামনে।
সুবাস কে অনির্বাণ তার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপর চার জনে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
রাস্তায় হাঁটা অবস্থায় দু বন্ধুর অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো, পুজোর সময় একসাথে মন্দিরে যাওয়া, প্রতিমা তৈরী করা দেখা, এ ছাড়া গ্রামের পুকুরে পদ্ম ফুল তোলা, সারা দুপুর চরে বেড়ানো, বিসর্জন এ নাচানাচি আর সব কিছুই মনে পড়লো, অবশেষে মন্দিরে পৌঁছয় তারা।
মন্দিরে মায়ের মূর্তি দেখে তাদের পথের ক্লান্তি নিমেষে দূর হল, অনির্বাণ যেনো কিছুটা হারানো মায়ের ডাক ফিরে পেলো কারণ মা মরা ছেলেটা দুর্গা মাকে নিজের মা মনে করত। কিছুক্ষণ পরে খুব একটা চেনা কন্ঠ স্বর শুনতে পেলো অনির্বাণ। পিছনে ঘুরে দেখতে পেলো জুই কে, সে আগের মতোন সুন্দর আছে যেমন টা দশ বছর আগে দেখে ছিল তেমনটাই আছে, একে একে মনে পড়লো অনির্বাণ এর এই পুজোতে তাদের প্রেম হয়, অনির্বাণ জুইকে প্রপোজ করে এই পুজোতে। আজ আবার পুজোতে তাদের দেখা।
জুই অবশেষে অনির্বাণের দিকে তাকালো। অনির্বাণ কাছে গিয়ে মুচকি হেসে বললো “কেমন আছো জুই?”
জুই… অনির্বাণ এর দিকে তাকিয়ে বলল ভালো। আর তুমি?
অনির্বাণ… আমি.. আমিও ভালো আছি।
জুই… কই তোমার বউ আসেনি? (জুইয়ের চোখের কোণে জল দেখতে পায় অনির্বাণ।)
অনির্বাণ .. ওই যে দাঁড়িয়ে আছে সুবাস এর বউয়ের সাথে।
জুই.. ও দেখতে তো বেশ। ভালো আছ তো?
অনির্বাণ.. ভালো থাকতে হয় তাই আছি। জানো তোমাকে খুব মিস করি যে এখনো।
জুই… আরে পুরোনো কথা মনে রেখে কোনো লাভ নেই বলে চোখের জল মুছে নিলো। দেখো অনি আমাদের ভালোবাসাটা সত্যি ও খাঁটি ছিল, ব্রেকআপ হয়ে গেছে বলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যাবে এটা তো কোনো দিন হতে পারে না, কারণ প্রকৃত প্রেম কোনো দিনও মরে যায় না। তুমি যে আমাকে কতটা ভালোবাসো সেটা আমাকে নতুন করে বোঝাতে হবেনা গো।
হঠাৎ জুই এর স্বামী ফিরে এলো, অনির্বাণ ও ফিরে গেলো তার স্ত্রীর কাছে “বলল চলো বাড়ি। তারপর
চার জনে বাড়ি ফিরে গেলো। অনির্বাণ এর একটা কথা মনে পড়লো জুইয়ের ব্রেকআপের সময়ের কথাটা ” বাকিটা জীবন আমরা অন্যের শরীরে নাই একে অপর কে খুঁজে নেব, অনির্বাণ নিঃশব্দে কেঁদে চোখের জল মুছে নিলো আর, তার স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।