গদ্যানুশীলনে সুদীপ ঘোষাল

সেকেন্ড মাষ্টার

কেতুগ্রামের সেকেন্ড মাষ্টার দয়ালু মানুষ। অপরের উপকার করাই তার ব্রত।স্কুলে নিজের টিফিন থেকেও খাওয়াতেন ছাত্রদের.!পড়া সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন ! তিনি বলতেন,এই চল্লিশ বছরে বহু ছাত্রদের আমি পড়িয়েছি,তারা মানুষ হয়েছে! তোরাও মানুষ হ!
তারপর রতন বড় হয়েচে!হেড মাষ্টারের পরেই সেকেণ্ড মাষ্টারের নাম!তাই পাঁচ গাঁয়ের লোকজন তাকে সেকেন মাষ্টার বলে!রিটায়ার হওয়ার পরেও সকলের ভালোবাসায় স্কুলে পড়াতে আসতেন!সব সময় তার হাসিমুখে কাজ মানুষের বিপদে আপদে কাজে দিত!পৃথিবীতে কিছু মানুষ মানুষের কাজ করতেই জন্মগ্রহণ করেন!তার ভালবাসার পরশ পাথরের ছোঁয়া পেয়ে মন্দ মনের মানুষও ভাল হয়ে যেত!
রতন দেখেছে বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে মানুষটা সকলের সেবার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছেন!
একবার মাঝি পাড়ার দুখিকে সাপে কামড়েছিলো ,সেকেন মাষ্টার গিয়ে দেখেন,ওঝা এসেই ঝাড়ফুঁক শুরু করেছেন!ওঝাকে বললেন মাষ্টার,ওকে ছেড়ে দাও ,আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব!সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেলেন মহুকুমা হাসপাতালে !দুখি ফিরে এলে ওর বাবা, মা মাষ্টারকে প্রণাম করে দুটি কুমড়ো দিয়েছিলেন !তারা বললেন ,এটা আমাদের ভালবাসার উপহার !লিতেই হবে !তিনি নিয়ে পরে ডোম পাড়ার খেনি বুড়িকে দান করে দিলেন !
সুখ দুখে তাকে ছাড়া কারও চলত না! গাঁয়ের সেকেণ্ড মাষ্টার সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন অজান্তে! একবার বন্যার সময় চার রাত স্কুলের ছাদে সকল দুর্গতদের সঙ্গে থেকে তাদের সাহায্য করেছিলেন! নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের সেবা করাই ছিলো তার ধর্ম!
তিনি নামতা পড়াতেন,দুই একে দুই,বাড়ির পাশে ভুঁই !দুই দুকুনে চার,দেশ তোমার আমার,দুই তিনে ছয়,জাতি দাঙ্গা নয়!এই রকম বিভিন্ন রকমের শিক্ষামূলক ছড়া শূনিয়ে শিশুদের জীবনের ভিত শক্ত করে দিতেন!তাঁর প্রত্যেক কাজেই ছিলো জীবনের ছোঁয়া !
সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পড়ে সাইকেল চালিয়ে তিনি স্কুলে আসতেন সাধকের মনে ! স্কুল ছিলো তার সাধনার স্থান !ছাত্র ছাত্রীরা ছিলো তার ভগবান,আল্লা বা যিশু !! তিনি যখন স্কুলে নিয়মিত শিক্ষক ছিলেন তখন সকল ছাত্রদের নিজের খরচায় টিফিন খাওয়াতৈন !সিদু কাকা বলতেন ,তখন তো আর মিড দে মিল ছিলো না !এই সেকেন মাষ্টার নিজের খরচে সকলকে খাওয়াতেন ,বুঝলে বাবাসকল !তারপর তার স্ত্রী গত হলেন ! তবুও স্কুল নিয়মিত আসতেন তিনি !আমাদের অনুরোধে রিটায়ার হওয়ার পরেও তিনি স্কুলে আসেন ! ইনি হচ্ছেন আদর্শ শিক্ষক গো !আর কোথাও এমনটি দেখলুম না !গ্রামের ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে শোনে সিদু কাকার কথা !
প্রসন্ন মনে তাদের সেবা করতেন অবিরাম!গ্রামের মানুষজন তাকে মান্য করতেন গুরুদেবের মত!
কুকুর,বিড়াল,ছাগল কোনো প্রাণী তার করুণা থেকে বঞ্চিত হত না! এক ভালোবাসার মন্ত্রে সকলকে গেঁথে দিত তার হৃদয়!
সিদু কাকা একদিন বললেন,আমার একটা আশ্রম আছে!সেখানে অনেক অনাথ শিশু থাকে !মাষ্টার তুমি কিছু টাকা চাঁদা তুলে দিও !
সেকেন মাষ্টারের কথা কেউ ফেলতে পারে না !তার কথায় অনেক চাঁদা উঠলো আর নিজেও রিটায়ার্ডের টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা দান করলেন !
আশ্রমের শিশুরা এখন ভালভাবে খায় ,পড়ে!
সেকেন মাষ্টারের ছেলেপিলে নেই !নিঃসন্তান!
তিনি বলেন,ছাত্র ছাত্রীরাই আমার সন্তান !এইভাবেই হেসে খেলে জীবন কেটে গেলেই হলো !
একদিন সেকেন মাষ্টার স্কুলে এলেন !শুনলেন রাষ্ট্রপতি আসবেন নিজের গ্রামে! কেতুগ্রামের পাশেই বাড়ি !বিরাট তোড়জোড় ! পুলিশের ভিড়!তার বাড়িতে পুলিশের বড় বড় ইনস্পেক্টরের ভিড়!সেকেন মাষ্টার ছেলেদের বলেন ,মানুষ হওয়া জীবনের লক্ষ্য হোক তোমাদের !মানুষ হয়ে মানুষকে ভালোবাসো !তবেই ধন্য হবে তোমাদের জীবন !
সেকেন মাষ্টার তার জীবনের ছোটোবেলার কথা মনে করছেন !তার মনে পড়ে একবার স্কুলে যাওয়ার পথে কাংরা গাবার জলে তার বন্ধু অসীম জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলো!অসীম সাঁতার জানতো না !এক সাদুবাবা বলছেন ,মর শালা !সাঁতার জানিস না তো জলে নামার দরকার কি ?সেকেন মাষ্টার দেরী না করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসীমের চুল টেনে তুলেছিলো ডাঙায় !সাদু বলেছিলো ,ভালো কাজ করলে বাবা !ছেলেটা তা না হলে মরে যেতো !মাষ্টার বললো ,আপনি নামলেন না জলে ! সাদু বললো ,জলে আমার খুব ভয় !আমিও সাঁতার শিখি নাই ! তাই তো বুক বুক করছিলাম !অসীম এখন অই স্কুলের হেডমাষ্টার ! হেডমাষ্টার হলেও সেকেন মাষ্টারের কথা কখনও ফেলেন না হেডমাষ্টার !
দুদিন পরে রাষ্ট্রপতির গাড়ি গাঁয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো ! রাষ্ট্রপতি এই স্কুলেই ছোটোবেলায় পড়েছেন! তাই স্কুলে একবার এলেন ! ছেলে মেয়েরা ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিলো আনন্দে !গ্রামের লোকজন ভিড় করে এলেন !সেকেন মাষ্টার নীরবে নির্জন ঘরে বসে আছেন ! রাষ্ট্রপতি স্কুলে ঢুকেই সেকেন মাষ্টারের খোঁজ করলেন! রাষ্ট্রপতি মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বললেন ,আপনার জন্যই এখানে এলাম !কেমন আছেন স্যার ! সেকেন মাষ্টার বললেন, ভালো!তুমি আরও ভালো মানুষ হও বাবা !
পাড়ার সবাই দেখে অবাক ! সেকেন মাষ্টারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন রাষ্ট্রপতি ! সিদু কাকা বললেন ,অনেকেই রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পায় ! কিন্তু প্রণাম কজনে পায় গো?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।