২৪
পিসেমশাই আজ আমাদের বাড়িতে আছেন। তিনি সাদা কাপড় পড়েন সাদা পাঞ্জাবি আর সঙ্গে একটা পেল্লাই ঝোলা কাঁধে ঝোলানো থাকে। দাড়ি গোঁফ কামানো। মুখে অশ্লীল শব্দ লেগেই আছে। আর ঝোলাতে কি নেই।চটি থেকে চন্ডি, চয়নকরা ঝোলা । প্রয়োজনে একটা করে বের করেন আর জিজ্ঞেস করলে বলেন, এই ঝোলায় ভূত আছে। সঙ্গে মুখে লেগে থাকে রহস্যময় হাসি। রতন বলে, বেশি পিসেমশাইকে ঘাঁটাস না। কি বের করতে কি করে দেবে তখন সামলাতে পারবি না। কঙ্কালসার, মাংস গলে পড়ছে পুতিগন্ধময় ভূতের উচ্ছিষ্ট খান পিসেমশাই। সাধারণ লোক পারবে না। ওনাকে ওনার মত থাকতে দেওয়াই ভালো।
পিসেমশাই বলেন আমাকে সাধু বলবি না। আমি সাধু নই। তোদের মত সাধারণ লোক। তবে আমাকে আলাদা বিছানা দিস। আমার ঝোলার ভূত রাতে আসে। শোয় আমার পাশে। ওকে বিরক্ত করা যাবে না। আমার রক্ত হিম হয়ে নামে। আমার বাবা, মা পিসেমশাইকে ভক্তি করেন। বলেন, ওনার চরণধুলা বাড়িতে পড়লে সে বাড়ি পবিত্র হয়ে যাবে। আমরা সব জানি। তোরা তো কদিনের ছেলে। উনি সকলের পিসেমশাই । আট থেকে আশি সকলেই ওনাকে পিসেমশাই বলে ডাকে।উনি সকলের সঙ্গেই মেশেন।বেশি বেগরবাঁই করলে পিসেমশাই রেগে যান। এমনিতে ওনাকে রাগানো দুস্কর। পিসেমশাই বলেন, বহিরাগত আর্যদের বৈদিক ধর্মবিশ্বাসটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক। পক্ষান্তরে পৃথিবীর অনার্যদের তান্ত্রিকের ভিত্তি হল মাতৃতান্ত্রিক। তা ছাড়া আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিকেন্দ্রিক। তার মানে দার্শনিক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল।
আমার বাবা বললেন, এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত। বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। পিসেমশাই বলেন, ঠিক এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিধান্ত, দর্শনের মতে সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত, আদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই সাধনা সম্পূর্ণ হয়। এ কারণেই বেদের হোম, পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতনধর্মকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। তন্ত্র থেকে তান্ত্রিকের আবির্ভাব । তন্ত্রের উদ্দেশ্য হল এই তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। সবকিছুই তন্ত্র বই থেকে প্রাপ্ত পুরোনো আমলের সময় থেকে লেখা। সেগুলো নাড়াচাড়া করে নতুন কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আমাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আমার মা বললেন, আপনার কাছে শুনেছি তন্ত্রে নারী জগত হল আদি অনাদির কারণ। তন্ত্রেবিদ্যার উদ্ভব হয় প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক ব্যাধের জীবনে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। একটা তান্ত্রিকের বইয়ে লেখা পড়েছি, সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ”।।এর তাৎপর্যঃ হলো “হে পার্বতি! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক”।
আমার বাবা বললেন, মাংস, মদ বা সুরা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, “মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত, যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায়। মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী”। এরা মানুষের মাংসও খায়। এরা কি অঘোরী বাবা বলেও পরিচিত?
পিসেমশাই বলেন, শুধু এটুকুই লেখা নেই। শাস্ত্রে আছে এর তাৎপর্য প্রতীকী। “গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক। আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা ও যমুনা, ইড়া ও পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়”।
আমি বললাম, তাহলে এই সাধনায় মাছ, মাংস, নারী, মদ সবকিছুর প্রয়োজন আছে।
পিসেমশায় বললেন, ধারণা আরও পরিষ্ককার করতে হবে। এই সাধনা এইরকম। শাস্ত্র পড়ে পাবে “…শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনীশক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন”।মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে ‘অতি জটিল’ বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী। কারণ তাঁরা “বায়ুরূপ লিঙ্গকে আঁধার শূন্যরূপ, জঙ্গুলে যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন” কিন্তু বীর্যস্খলন হয় না। কাপুরুষের তন্ত্ররসাধনা হয় না।
আমার বাবা বললেন, আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে, “মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে”।যে ‘সাধারণ’ লোকেরা তন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা ছিল এবং ম-কার যাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ, তাদের প্রতি পুরোহিতশ্রেণীর আশংকা, “…সাধারণ লোকে উদ্দেশ্য ও প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রোক্ত পঞ্চ-মকারের প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন”। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য, উভয় ঘরানার তন্ত্রেরই আকর উৎস বিভিন্ন আগমশাস্ত্র। আগমশাস্ত্র বস্তুতঃ আদি প্রযুক্তি প্রকৌশলের গ্রন্থিত সংগ্রহ। খেটেখাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই আদিতে যাবতীয় আগমশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিল। কালক্রমে এইসব ভৌতশাস্ত্র আধিদৈবিক অতীন্দ্রিয় কর্মকান্ডের রূপ পরিগ্রহ করে ইতরজনের নাগালের বাইরে চলে যায়। ‘সাধারণ’ জনগোষ্ঠীর নৈতিকতায় ‘মৈথুন’ কখনই ‘কদর্য, কুৎসিত’ বোধ হয়নি। এই বোধটি আর্যায়নের সঙ্গে এসেছিল। শাস্ত্রকার এভাবে ব্যাখ্যা করছেন, “…আপাততঃ মৈথুন ব্যাপারটি অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হইতেছে, কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহার কতদূর গূঢ়ভাব সন্নিবেশিত আছে তাহা বুঝা যাইতে পারে। যেরূপ পুরুষজাতি পুংঅঙ্গের সহকারিতায় স্ত্রীযোনিতে প্রচলিত মৈথুন কার্য করিয়া থাকে, সেইরূপ ‘র’ এই বর্ণে আকারের সাহায্যে ‘ম’ এই বর্ণ মিলিত হইয়া তারকব্রহ্ম রাম নামোচ্চারণ রূপে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম-মৈথুন ক্রিয়া নিষ্পাদিত হইয়া থাকে”।শারীরিক মৈথুনের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন আলিঙ্গন, চুম্বন, শীৎকার, অনুলেপ, রমণ ও রেতোৎসর্গ – তেমনই আধ্যাত্মিক মৈথুন ও যোগক্রিয়ায় তার সমান্তরাল কৃত্য, সেখানে ‘তত্ত্বাদিন্যাসের’ নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন, আবাহনের নাম শীৎকার, নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, জপের নাম রমণ আর দক্ষিণান্তের নাম রেতঃপাতন। এই সাধনাটির নাম ‘ষড়ঙ্গসাধন’ এবং শিবের ইচ্ছায় একে ‘অতীব গোপন’ মোহর দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া “কলির জীব পঞ্চ ম-কারের মর্ম বুঝিতে পারিবে না বলিয়া কলিতে ইহা নিষিদ্ধ হইয়াছে”। অতএব ইতরজনের জন্য এইসব দর্শন অধরা হয়ে গেল এবং তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত চক ছাড়া আর কিছু থাকতে দিল না। শুদ্রজন ও নারী এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান লাভ করত। সাধনযোগিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে এক ধরনের পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে। নামে নারীই ‘শক্তি’, কিন্তু শক্তি সাধনের সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে, তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী। সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী ও রক্তনেত্রা। শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী। সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী। এসবে মতান্তর থাকতে পারে। যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্র, খর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা ও মৃদুভাষিণী। এরপর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা, নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয়।শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশু আচারী ও বীরাচারী। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে পঞ্চ-ম কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু’ প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে। বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম। কৌলাচারের চেয়ে উত্তম ।বিভিন্ন দেবতা এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা ও বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র বা কৃষ্ণশাপ বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয়। এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা এরকম। রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ , কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ড এই লক্ষণটি তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন। এই সব ‘পুষ্প’ বামাচারী তন্ত্র সাধনার জরুরি উপকরণ। বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই।