সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সুদীপ ঘোষাল (পর্ব – ৩১)

তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন 

৪৪
পিসেমশাই আজ একটা জমজমাট ভূতের গল্প শুরু করলেন। তিনি বললেন গঙ্গা আর অজয়ের মিলনস্থল দেখার মত। দুরকম রঙের জল। একটা অজয়ের ধারা আর একটা গঙ্গার ধারা।গঙ্গার বিভিন্নঘাট আছে। কোনোটা শ্মশানঘাট কোনোটা
বাংলোঘাট।মুন্সেফ কোয়ার্টারে রাতের দৃশ্য যে দেখেছে সেই জানে। চাঁদের আলো ফিরিয়ে দেয় পুরোনো মায়া। গোপনে শুনেছি এই স্থানে রাতে মুন্সেফ তার খাতাপত্তর বগলে নিয়ে ফাঁকা মাঠে কোর্টের কাজ সারেন। হয়ত তার অভ্যাস এখনও ভুলতে পারেন নি।
রতন বলল,এর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটি  অজয় ঘাটে মিলেছে। অজয়ের রূপ এখানে এসে অপরূপ অথচ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে চোরাবালি অনেকেরই প্রাণ কেড়েছে। তাই এখানে সাবধানবাণী লেখা আছে। বিপজ্জনক এই জায়গায় সহজে কেউ আসে না।
সকলেই এড়িয়ে চলে।
কিন্তু মানুষ তো একপ্রকার হয় না। কিছু মানুষ চেনা ছকের বাইরে ছক কষে। কি করে টাকা পয়সা বেশি করে অর্জন করা যায় তার মকসো কষার লোক আছে বই কি। আর এইসব লোক নিশাচরের মত। দিনে কোথায় থাকে দেখা যায় না। কিন্তু রাত হলেই ঘুরঘুর করে বিপজ্জনক এলাকায়। যেখানে সাধারণ মানুষ দিনের বেলা যেতে ভয় পায় সেখানে রাতের বেলায় নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করে নিশাচরের দল। চোরাবালির মত চোরাচালান আর চোরাকারবারির ব্যবসা চলে রাতভর। আর তার সঙ্গে চলে পৈশাচিক রক্তের খেলা। মদ আর গাঁজার আড্ডায় পাওয়া যায় বেশ্যা আর জুয়ার মেলবন্ধন।
আমি বললাম, ভূতের কথা শুনেছি কিন্তু কোনোদিন চোখে দেখি নি। বাবা বলতেন, চোখে না দেখা জিনিস সত্যি হয় না। কথাটা অন্তরে গেঁথে ছিলো। ফলে কোনোদিন ভূত দেখা দূরের কথা ভয় পর্যন্ত পাই নি।
পিসেমশাই বললেন, তখন আমি সাধারণ তোদের মত আনাড়ি ছেলে। তন্ত্রপথে আসি নি তখনও। দাদু বলেছিলেন, সব কিছুর সময় আছে। ভুঁইফোড় কোনো কিছু  দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই আমি বাংলোঘাটের একটা বদনাম আছে জানি।  এখানে নাকি ভূত, বাঁশবাগানের ভিতর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। একদিন ব্যাগপত্তর গুছিয়ে চলে এলাম বাংলোঘাট। গরমের সময়। নৌকাবিহার বেশ জমে উঠলো। দুজন বন্ধু জুটে গেলো নদীর তীরে। তাদের একজন বুড়ো মদনদা আর একজন ছোকরা মরাদা। মরা নামটা শুনে আমার গা টা ঘিন ঘিন করে উঠলো। শ্মশানের সময় শবদেহ পোড়ার গন্ধ নাকে ভেসে এলো। আমি বললাম, মরাদা এরকম বোটকা গন্ধ কোথা থেকে আসছে?  মরা দা বললো, সামনে শ্মশানে মরা পুড়ছে হয়ত। আর তাছাড়া আমার মুখে দুর্গন্ধ আছে। অনেকদিন রক্ত খায় নি তো?  আমি বললাম, কি যে বলো। রক্ত আবার খায় না কি?  মরাদা বললো, আমি কি তাই বললাম নাকি?  মদনদা বললো  , হ্যাঁ বললি তো। গাঁজার নেশা ধরেছে নাকি। মরাদা বললো, ঠিক বলেছ। আজ টানটা বেশি হয়ে গেল। দাও দিকিনি আর এক ছিলিম। তারপর আমার সঙ্গে দুইজনে গাঁজা খেয়ে গল্প করতে লাগলো। তারপর আমার দিকে কল্কেটা এগিয়ে দিয়ে বললো, দাও একটান। দেখবে কেমন হাল্কা মেজাজে গান আসবে অন্তরে। আমি বললাম, আমি ওসব খাই না। তারপর বললাম, মদনদা নৌকায় মাঝি কই। কি করে চলছে নৌকো। মরাদা বললো, সন্দে হয়েচে তো। অন্ধকারে দেখা যায় না। তারপর মাঝ নদীতে নিয়ে নৌকায় গল্প শুরু করলো মদনদা। আমাকে বললো, তোমার খুব সাহস মনে হচে। বেশি সাহস ভালো নয়। আমরা মুন্সেফ ঘাটে এসে পড়েছি। মৃত মুন্সেফের আত্মা এখন মুন্সেফ কোয়ার্টার থেকে পায়ে হেঁটে বৈকালিক ভ্রমণ সাড়ে। এই ঘাটে এসে চোরাবালিতে ডুব দিয়ে চান করে। আমি বললাম, চোরা বালি থেকে তো উঠতে পারবে না। মদনদা বললো, আরে বোকা এ তো মানুষ নয় ভূত। ভূতরা সব পারে। রাত হয়ে এসেছে। মুন্সেফ ঘাটে মুন্সেফ চোরাবালিতে ডুব দিল। নিজের চোখে দেখলাম। মদনদা আর মরাদা আছে বলে আমার ভয় পেল না। মরাদা বললো, কি গো ভয় লাগছে না?
আমি বললাম, তোমরা আছো তাই।
মরাদা বলল, আমি মদনদাকে ডাকি।
দেখলাম মরাদা একলাফে নদীর পাড়ে নৌকা থেকে লাফ মেরেই আবার নৌকায় ফিরে এল। মদনদা বলল, এবার তোর রক্ত চাই। ভূত দেখবি নয়। এই মরা এখানে আয়। তারপর মদনদা মরার হাতটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো আর পা টা ধরে চিবোতে লাগলো। আমি ওদের রক্তমাখা মুখ দেখে নৌকার মধ্যে চিত হয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পরেরদিন সকালবেলা আমি জ্ঞান ফিরে পেলাম। দেখলাম হাসপাতালে শুয়ে আছি। ব্যাগপত্তরগুলো কোয়ার্টার থেকে লোক গুলো এনে দিয়েছিলো। তারা বললো, কি মশাই, মদনদা আর মরার খপ্পরে পড়েছিলেন নাকি। যাক খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছেন।
আমি বললাম, আপনারা তো লোকাল লোক। আচ্ছা ওদের আসল ঘটনাটা  কি জানেন?
একজন বললেন, হ্যাঁ জানি। মুন্সেফ, একদিন সান্ধ্য ভ্রমণ শেষে স্নান করতে গিয়ে দেখেন  মদন গুন্ডা ও মরা গুন্ডা একজনকে চোরাবালিতে ফেলে হাসছে। হঠাৎ ওরা মুন্সেফকে দেখে ফেলে। ফলে মুন্সেফ ওদের শত্রু হয়। তারপর সঙ্গে সঙ্গে  ওরা  মুন্সেফকে ধরে বেঁধে এনে চোরাবালিতে ফেলে।   মুন্সেফ একা ছিলেন। ওদের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি বদলা নিয়েছিলেন একমাসের মধ্যে। এক অমাবস্যার রাতে দু’জনকে মুন্সেফের আত্মা টেনে আনে চোরাবালির ধারে। তারপর তারাও ডুবে যায় পাপকর্মের চোরাবালিতে। তারপর থেকে ওদের দুষ্টু আত্মা আনাড়ি ভালো মানুষকে নিয়ে আসে চোরাবালির ধারে আর মুন্সেফ এসে লড়াই করে বাঁচান মানুষদের। মুন্সেফ তাই এখানকার লোকেদের কাছে শুভ আত্মার দেবতাস্বরূপ। তাঁর জন্মদিন পালন করে এখানকার লোক।
আর প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে মুন্সেফ নিজে চোরাবালি থেকে উঠে এসে তার কোয়ার্টারে বসেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।