সাপ্তাহিক কোয়ার্কো ধারাবাহিক উপন্যাসে সুশোভন কাঞ্জিলাল (পর্ব – ৪৮)

আটচল্লিশ

ঠিক ছটায় আমি আর লুলিয়া যাদবপুর থানার সামনে দেখা করলাম। দেখা তো করলাম বেশ উৎসাহের সঙ্গে কিন্তু দেখা করার পর দুজনেই দ্বিধায় পরে গেলাম। কোথায় যাব, কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। শেষে আমিই প্রস্তাব দিলাম সাউথসিটির কফিশপে বসা যাক। লুলিয়া সায় দিতেই আমি অটো ডাকার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। কিন্তু লুলিয়া বললো ও হাঁটতে হাঁটতে যেতে চায়। অগত্যা দুজনে মিলে হাঁটতে শুরু করলাম। লুলিয়া হঠাৎ বললো, “আচ্ছা অর্ক এখানে কাছা কাছি একটা লেক আছে না? আমি ওই লেক টার কথা অনেক শুনেছি কিন্তু কোনোদিন দেখিনি। চলোনা আমরা ওই লেক এর ধারে গিয়ে বসি। আমি বললাম, “দেখো এই অঞ্চলে দুটো লেক আছে। একটা যোধপুর পার্ক সেটা ছোট। আরেকটা ঢাকুরিয়া বা রবীন্দ্র সরোবর। যেটা খুব বড় লেক। তুমি কোনটার কথা বলছো?। “লুলিয়া বললো হ্যাঁ হ্যাঁ ওই ঢাকুরিয়া লেক এর ই নাম শুনেছি ওখানেই চলো। “আমরা ঢাকুরিয়া লেকের দিকেই হাঁটা শুরু করলাম।
ঢাকুরিয়া লেকে পৌঁছে বেশ লজ্জায় পড়লাম। লেকের পারধরে আধো অন্ধকারে সারি সারি যুগল মূর্তির সমাবেশ। এ যেন প্রেমের মেলা। সুবিধা মতো জায়গা খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হল। লেকের মন মাতানো হাওয়ায় লুলিয়ার মনেও বোধহয় প্রেমের ভাব জেগে উঠল। গুন গুন করে ও গান গাইছে। সিলিন ডিওনের টাইটানিক সিনেমার গান -এভরি নাইটি ইন মাই ড্রিমস। আমি একটা সিটে দুজনের মতো জায়গা দেখে লুলিয়ার হাত ধরে বললাম, “চলো এখানেই বসি। “লুলিয়া আবদার করে বললো, “না ওই ওদের মতো লেকের পারে পা ঝুলিয়ে বসবো।” অগত্যা লুলিয়ার সঙ্গে সেই ভাবেই বসলাম। স্নিগ্ধ হাওয়ায় মন মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। বাঁদিকে বা দান দিকে যেদিকেই তাকাই, সেদিকেই যুগলের জড়াজরি দেখে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। লুলিয়া পরিবেশ টাকে বেশ আত্মস্থ করে নিয়েছে। বেশ গলা ছেড়েই গান ধরেছে, “এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় একই বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু। ”
মনে হল লুলিয়া সিনেমাটার চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। ও হয়তো পরিবেশের গুনে নিজেকে সুচিত্রা সেন ভেবে ফেলেছে। কারণ আমার হাতটা জড়িয়ে নিয়ে ধরে ওর কলের ওপর রেখেছে। লুলিয়া সুচিত্রা সেন হলেও আমি নিজেকে অশোক কুমার মানতে পারলাম না। তবে একথা মানতেই হবে চারিদিকে অসম্ভব রোমান্টিক পরিবেশ। এখানে এলে যে কোনো নর বা নারী যতই রুক্ষ স্বভাবের হোকনা কেন মনে প্রেম জেগে উঠবে। প্রেমের পাঠ নেওয়ার জন্য এটা একটা আদর্শ পরিবেশ। অনেক দূরের একটা টিম টিমে আলো জলে পরে পরিবেশ টাকে একটা অন্য মাত্ৰা দিয়েছে। লুলিয়ার উষ্ণ স্পর্শে মনটা যেন জলের ঢেউয়ের সঙ্গে অজানা উদ্দেশ্যে ভেসে চলেছে। হঠাৎ সেই স্বপ্নময় ঘোরটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল একটা কর্কশ কণ্ঠে। “দাদা চিপস নিন “। কোনোরকম অনুরোধ উপরোধ নয় সরা সরি হুকুম। শুনেই রাগ হয়ে গেল। বললাম, “লাগবে না “। ভালো করে তাকিয়ে দেখি একজন মাঝবয়সী মহিলা হাতে কটা চিপস এর প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা গলা ছড়িয়ে বললো, “আমি লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করিনি, নিতে বলেছি”। লুলিয়াও গলা ছড়িয়ে বললো, “নেবোনা বললাম তো জুলুম নাকি, নেবোনা বললাম তো,।”মহিলা বললো, “পর পুরুষের সঙ্গে ফস্টি নস্টি করতে পার আর গরিব বিধবাকে সাহায্য করতে পারো না?।”এক কথা দু কথা হতে হতে রীতিমতো ঝগড়ায় পরিণত হল। আমাদের ঝগড়া শুনে আরো দুটো ফেরিওয়ালা এসে মহিলার সঙ্গে এক জট হয়ে গেল। মহিলা নিজের দল পেয়ে আরো জোর দিয়ে বললো, “নিতেই হবে। এখানে প্রেম করতে হলে এই ট্যাক্স দিতেই হবে। “লুলিয়া উঠে দাঁড়িয়ে সমানে তর্ক করে যেতে লাগলো। আমি বাস্তব পরিস্থিতি টা দ্রুত চিন্তা করে নিলাম। তারপর মধ্যস্থতার জন্য আমি বললাম, “ঠিক আছে একটা প্যাকেট দিন। “কুড়ি টাকা দিয়ে একটা চিপস এর প্যাকেট কিনে পরিস্থিতি সামাল দিলাম। ওরা চলে গেল। লুলিয়া দেখি মুখটা গম্ভীর করে বসে পড়লো। আমি পরিবেশটা হালকা করার জন্য বসে বললাম, “নাও চিপস খাও ঝাঁসির রানী। “লুলিয়া হাত বাড়িয়ে চিপস এর প্যাকেট টা নিয়ে লেকের জলে ফেলে দিলো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হল? ফেলে দিলে কেন?, “। লুলিয়া বললো, আমি অন্যায়ের সাথে কম্প্রোমাইজ করা একদম পছন্দ করিনা। মুখটা একদম থমথেমে হয়ে আছে। আমি ওর মুডটা হালকা করার জন্য বললাম, “তাহলে তোমার কি পছন্দ? আমাকে? কথা গুলো যেন জাদুর মতো কাজ করলো। লুলিয়া বিদ্যুৎ গতিতে আমার দিকে ফিরে, আমার মুখটা ওর মুখের কাছে এনে নিজের ঠোঁট আমার ঠোঁটে চেপে ধরলো। চুম্বনের আর্তিটা মিটলে, আমাকে জরিয়ে ধরে আমার বুকে মাথা রেখে আত্মসমর্পণ করলো। আমিও ওর প্রেম গ্রহণ করলাম।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।