ক্যাফে গদ্যে সংগ্রামী লাহিড়ী

সংগ্রামী লাহিড়ী নিউ জার্সির বাসিন্দা, বৃহত্তর নিউইয়র্ক বলা যায় | পরিচয় - শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কন্সাল্ট্যান্ট, নেশায় লেখিকা | শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী | উত্তর আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে বসে বদলে যাওয়া প্রবাস-জীবনের ডায়রী লিখছেন |

মহাশুক্রবার

সেল সেল সেল!
কী অমোঘ টান এই দু-অক্ষরের শব্দের, সে জানতে আর কারুর বাকি নেই।
সস্তায় পেলে মানুষ বাঘের দুধও কিনবে, তা সে কাজে লাগুক বা না লাগুক। কত ডিসকাউন্টে পাওয়া গেল, সেটাই মুখ্য বিষয়। বাকি সব গৌণ।
আটলান্টিক পেরিয়ে কলম্বাস-আবিষ্কৃত এই মহাদেশ কনজিউমার-দের দেশ, রিটেল স্টোরের দেশ। অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে কেনাবেচার ব্যবসার ওপর। এহেন শিবঠাকুরের আপন দেশের দোকানদারগণ থ্যাংক্সগিভিং এর ঠিক পরের দিনটিকে বেছে নেন বিরাট অঙ্কের ছাড়ের জন্যে। ক্রেতাকুল আলোর পানে পতঙ্গের মত স্টোর-অভিমুখে ধাবিত হন। থ্যাংক্সগিভিং উইকএন্ডে চারদিনের ছুটি কেনাকাটার মহাযজ্ঞে খুবই সুবিধে করে দেয়। এ দিনটিই হল ব্ল্যাক ফ্রাইডে, ক্রেতা ও বিক্রেতার মহাশুক্রবার।
নভেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহের বিষ্যুৎবারে থ্যাংক্সগিভিং। জ্ঞাতিগুষ্টি, ভাইবেরাদর একসঙ্গে হয়ে পারিবারিক মিলনমেলা। টার্কি রোস্ট করে ওয়াইন সহযোগে টেবিলে বসে বিরাট ভোজ। তার আগে অবিশ্যি থ্যাঙ্কিউ-র পালা সেরে নিতে হয়। পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। ক্ষেতে ফসল ভাল উঠেছে, তার জন্যে থ্যাঙ্কিউ। সুখেদুঃখে বছরটা কেটে গেল, তার জন্যে থ্যাঙ্কিউ। পরিবারের সবাই একসঙ্গে মিলতে পেরেছি, তার জন্যেও থ্যাঙ্কিউ।
খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে মানুষ রেডি হন পরের দিনের জন্যে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে। ক্রিসমাস শপিংএর শুরু।
দুনিয়ার যত রিটেল স্টোর গত একমাস ধরে বাড়িতে ফ্লায়ার পাঠিয়েছে। তাতে বিশদে লেখা আছে ঐদিন কোন দোকান ঠিক কোন জিনিসটি কত সস্তায় বেচবে। সেসব ফ্লায়ার নিয়ে রিসার্চ বহু আগেই শেষ। এবার শুক্কুরবারে দোকানের ঝাঁপটি খুললেই ঝাঁপ দিয়ে জিনিসগুলি শপিংকার্টে ভরে ফেলতে হবে। তাহলেই যুদ্ধজয়।
এদেশের সঙ্গে আমার জান-পহচান সেই দুহাজার সালেরও আগে, মানে আক্ষরিক অর্থেই আগের মিলেনিয়ামে । তখনো আমি এদেশের পাকাপোক্ত বাসিন্দা নই। কাজ নিয়ে আসি, মাসকয়েক করে থাকি। তো এমনই এক সফরকালে জানতে পারলাম সেই মহাশুক্রবারের কথা। এক বন্ধুর কাছে।
থ্যাংকসগিভিংএর পরের দিন এই শুক্রবারের অমোঘ আকর্ষণ হল সেল, অর্থাৎ দামে বিরাট ছাড়। বড় বড় রিটেল স্টোর খুব ভোরে তাদের দরজা খোলে আর সেদিন নাকি অবিশ্বাস্য কম দামে জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। শুনে তো আমি চমৎকৃত। অ্যাতো সস্তা? এ যে চৈত্র সেলের গড়িয়াহাট-শ্যামবাজারকেও হার মানায়! কী কাণ্ড!
অবশ্য কেষ্ট পেতে গেলে কষ্ট করতে হয়। বিনি-চেষ্টায় কি আর সস্তায় সওদা মেলে? বন্ধুই বললো, সে সব বস্তু কেনার জন্যে লোকে নাকি সারা রাত লাইন লাগায়। রীতিমতো ক্যাম্প করে দোকানের সামনে রাত্রিবাস। যাতে লাইনের প্রথম দশজনের মধ্যে থাকা যায়।
এবং পুলিশের ঘুম ছুটে যায়। ক্যাম্প মানেই তো জেনারেটর দিয়ে আলো জ্বালানো, প্রোপেন গ্যাসের ব্যবহার। আগুন লাগতে কতক্ষণ? তাই পুলিশের থ্যাংক্সগিভিংয়ের ছুটি নেই।
বড়-মেজ-ছোটো সব স্টোরই মোটামুটি ব্ল্যাক ফ্রাইডের আয়োজন রাখে। তবে বিশেষ কিছু দোকান তাদের ব্ল্যাক ফ্রাইডের সেলের জন্যে বিখ্যাত। সে সব দোকানের ফ্লায়ার নিয়ে অনেক আগে থেকে গবেষণা শুরু হয় – কোন প্রার্থিত বস্তু কোথায়, কতো কমে পাওয়া যাবে। এমন কী উৎসাহী ক্রেতা আগেই স্টোরে গিয়ে সরেজমিনে দেখে এবং মেপে আসে কোন শেলফে কী রাখা আছে। শুক্রবার ভোরে দোকান খোলামাত্র যাতে চটপট প্রার্থিত বস্তু গুলি শপিং কার্টএ ভরে ফেলা যায়। শুনতে পেলাম, সত্যিকারের ভালো ডিলে দেওয়া জিনিস নাকি দোকান খোলার পনের মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
সত্যি বলতে কী, এসব শুনে বেশ উজ্জীবিত বোধ করলাম। আমার একটা ডিজিট্যাল ক্যামেরার শখ ছিল। এটা সেই যুগের কথা যখন ফিল্ম-গোটানো ক্যামেরা জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে তার ডিজিট্যাল প্রতিদ্বন্দ্বীকে, তবে তার দাম সবসময় সাধ্যের মধ্যে নয়। এই সুযোগে শখ মেটাতেই হবে। মনে আছে ভোর চারটেয় অ্যালার্ম দিয়ে উঠে প্রায় শ’খানেক লোকের পিছনে লাইন দিয়েছিলাম এবং ক্যামেরাও পেয়েছিলাম! মুগ্ধ হয়েছিলাম আমার আগে যারা এসে লাইন লাগিয়েছে তাদের কমিটমেন্ট দেখে। রাতভর ঠান্ডা হিমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কী সোজা কথা?
এই মেগা সেল-ইভেন্টের ইতিহাসটি জানতে ইচ্ছে হল। পড়েটড়ে দেখলাম, বেশিদিনের পুরোনো ট্র্যাডিশন নয়। মোটামুটি ষাটবছর আগে, উনিশশো একষট্টিতে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ কথাটি ফিলাডেলফিয়ার পুলিশের নথিতে পাওয়া যায়। থ্যাংক্সগিভিংয়ের পরের দিন ফিলাডেলফিয়া শহরের মফস্বল থেকে ট্রেন-বাস-গাড়ি বোঝাই করে মানুষ শহরে আসতো আর্মি-নেভির ম্যাচ দেখতে আর সেইসঙ্গে ক্রিসমাসের কেনাকাটা করতে। রথ দেখা,কলা বেচা – দুইই একসঙ্গে করে নেওয়ার বাসনা। দোকানগুলোও খদ্দের ধরার জন্যে ভাল ডিসকাউন্ট দিত। কাতারে কাতারে মানুষ, ট্র্যাফিক, খেলার মারামারি, তারমধ্যে আবার শপলিফ্টিং – পুলিশ একেবারে ল্যাজেগোবরে হয়ে যেত। তাই পুলিশের খাতায় ওই নাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই কুখ্যাত দিনই এখন সেলের মহিমায় মহিমান্বিত।
বেশ কিছু বছর পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যাতায়াত করে ক্লান্ত আমি একসময় দেশ ছাড়ি। এদেশেই পাকাপাকি ঘাঁটি গাড়ি। সেই পুণ্য-শুক্রবারের অভিযান চলেছিল আরও বেশ কয়েক বছর। তারপর একদিন আবিষ্কার করলাম যে ব্ল্যাক ফ্রাইডের কল্যাণে আমার বাড়ি ভর্তি দরকারী-অদরকারী জিনিস, তাদের অনেকেই এখনো বাক্স থেকেও বার হয় নি। কোনো দিন বেরোবে বলেও আশা নেই। আপাতত আমার গ্যারাজ আর বেসমেন্ট ভর্তি হাফ ডজন ক্রক পট, গোটা চারেক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, দুখানা কিচেন গ্রিল, অগুন্তি মিক্সার, জানা-অজানা ডিভিডি এবং আরও কত কী! সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিল যে!
সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করলাম আর ওধার মাড়াবো না। গোল্লায় যাক ব্ল্যাক ফ্রাইডে। যে জিনিস আমার দরকার নেই তা কিনে আমি কী করবো? প্রায় সেই বৈদিক যুগের যাজ্ঞবল্ক্য-পত্নী মৈত্রেয়ীর মতো উপলব্ধি – যেনাহম নামৃতাস্যাং…. কিন্তু কনজিউমার মার্কেটিং কি অত সহজে পিছন ছাড়ে? সব ডিল এখন অনলাইন। স্টোরে যাবার দরকারটা কী? তারপর হয় ফ্রিতে ডেলিভারি, নাহলে সময়মত টুক করে একবার দোকানে গিয়ে জিনিসটি তুলে নিও। কত সুবিধে!
ব্ল্যাক ফ্রাইডের সঙ্গে এখন আবার এসে জুড়েছে সাইবার মানডে। মহাশুক্রবারের ঠিক পরের সোমবার যত অনলাইন রিটেলার ডিল দেবে। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? আজ্ঞে হ্যাঁ, টানা এক সপ্তাহ জুড়ে ডিসকাউন্ট আর সেলের মহাযজ্ঞ – ব্ল্যাক ফ্রাইডে উইক। ঘরে বসেই কিনে ফ্যালো এমন সব জিনিস যা তোমার ইহজীবনে কাজে লাগবে না, কিন্তু দুর্দান্ত সস্তা দাম। তাই আপাতত এখন আমার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে ব্ল্যাক ফ্রাইডে উইকের প্রলোভনের সঙ্গে। দেখা যাক কে জেতে!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।